(দুই)
কল্পনা তার ছোট ভাই-বোনের বিছানায় জানালার ধারে মরার মতো সটান্ শুয়ে থেকে গুনগুন স্বরে কাঁদছিল আর কী সব আবোলতাবোল ভাবছিল। চাচা সাত্তার মিয়ার গলা ফাটানো চিৎকার গালাগাল শুনে তার ভাবান্তর হলো, এবং সে যখন শুনতে পেলো কেউ সাক্ষি দিবে না, তখন তার ক্রোধটা আবার ধা ধা করে উঠলো আগের চেয়েও দ্বিগুন বেগে। তবে সেটা শত্রুর চেয়ে প্রতিবেশিদের উপরেই বেশি চড়াও হয়ে উঠলো। কারণ প্রেমিকের সাথে গোপন প্রণয়টা যারা হাতেনাতে ধরে রাষ্ট্র করে দিতে পারলো, এমনকি উপযাচক হয়ে সে খবরটা তার স্বামীর কানে পৌঁছে দিয়ে এক নিমেষেই তার দাম্পত্য সংসারের সমাপ্তি ঘটিয়ে দিতে পারলো, এখন তারা মামলার সাক্ষি হতে পারে না ?
যত ভাবে ততই ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ওঠে কল্পনা। ভাবনার মাঝে এক সময় কাপুরুষ প্রেমিকের কথা মনে পড়লে ক্রোধের মাঝেও একটা চিন্ চিনে ব্যথা বুকে অনুভব করে সে। মন ভুলিয়ে যে প্রণয়ে আবদ্ধ করে, সে কী করে গা বাঁচানোর জন্য পালিয়ে যায় ? ভয়েই যদি করিস তবে প্রণয়ে আবদ্ধ করলি কেন ? কেন আমার স্বামীর সংসার ভেঙ্গে দিলি ? কাপুরুষ, শয়তান, বদমাশ........ ! সে আর ভাবতে পারে না। তার ফুঁফিয়ে কান্না আসে। আবেগে কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে।
কিন্তু আবেগের মধ্যেও যখন নিজের অস্তিত্বের কথা ঝিলিক দিয়ে ওঠে মনে, তখন এক মূহুর্তে সে ফিরে আসে জীবন সমুদ্রের মাঝে, এবং তাকিয়ে দেখে চারপাশে কোথাও তার কূল নেই ; সে ভেসে আছে অথই জলে, তখন তার কণ্ঠরুদ্ধ আবেগ হঠাৎ শুস্ক পাথরে রুপান্তরিত হয়ে হৃদস্পন্দন যেন থামিয়ে দেয়। সে আর ভাবতে পারে না। ক্রোধে কুকড়ে আসা হালকা পাতলা দেহটাকে পুটলি বানিয়ে গুম হয়ে পড়ে থাকে।
তবে অনেকক্ষণ পর নিজের অজান্তেই সে এক কান্ড করে বসে। হঠাৎ বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে পাগলের মতো দিগদ্বিগ তাকায়, তারপর কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই উন্মাদের মতো ছুটে গিয়ে ইটের দালানওয়ালা বাড়ীর ভিতরে দক্ষিণ দুয়ারি ঘরটায় ঢুকে ভিতর থেকে খিল এঁটে দেয়, এবং ধপাস করে মেঝেতে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
ঘরটা আসাদের। সকালবেলার ছিপছিপ বৃষ্টির মধ্যে ঘটিত ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত সে পলাতক। অবশ্য তাৎক্ষণিক পারিবারিক শলাপরামর্শে তাকে ভাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। গ্রামের বিত্তশালী পরিবারের লোকদের প্রত্যেককেই আলাদা সংসার করতে দেখা গেলেও অস্তিত্বের প্রশ্নে তারা কিন্তু এক, অথবা রসুনের মতো একই মূলে বহুমুখি। আর সে জন্যেই দেখা গেলো আসাদের সতালো ভিন্ন সংসারী তিন ভাই, যারা ইতিপূর্বে বাপের সহায়-সম্পত্তির ভাগা-ভাগি নিয়ে বহুবার দ্বন্দ-সংঘাত করেছে তারাই আজ অবিবাহিত কনিষ্ঠ সৎ ভাই আসাদকে ইতর-গরীব চালচুলোহীন এক পরিবারের বিবাহিতা প্রেমিকা নারীর রাহু থেকে রক্ষা করার জন্য ছুটে আসে। কেউ লাঠি নিয়ে গেলো কল্পনার বাপ-চাচাকে মারতে, কেউ এলো আসাদের ঘর থেকে কল্পনাকে টেনে হেঁচরে বের করে দিতে। তাদের রক্তচোখের চাহুনিতে আর হুঙ্কারের আওয়াজে সমস্ত গ্রাম কেঁপে উঠলো। যে গ্রামবাসি ঘটনার প্রত্যাক্ষদর্শী হয়েও সাক্ষি দিতে এলো না, তারা হঠাৎ বিপুল শক্তি নিয়ে ছুটে এলো তাদেরকে সহায়তা করতে।
কিন্তু জব্বার মিয়া আর সাত্তার মিয়াকে লাঠিপেটা করা সহজ হলেও দালান ঘরের স্টীলের দরজা ভাঙ্গা সহজ কথা নয়। গা ঘামাতে হবে। সময়ও লাগবে। কেউ শাবল নিয়ে এলো, কেউ ধাক্কাতে লাগলো, কেউ জানালার গ্রিল কাটার চেষ্টা করতে লাগলো হেকসো ব্লেড দিয়ে। সামান্য একটি মেয়ের ভয়ে সকলেই যেন সন্ত্রস্ত। সমস্ত বাড়ী জুড়ে কী এক বিশ্রি কান্ড বেঁধে গেলো।
আসাদের ষাটোর্ধ বয়সী পিতা রইচ কেরানি বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিংহের মতো গর্জন করতে লাগলো। তবে যত গর্জনই করুক, মনে মনে সে কিন্তু ভীষন আশ্চর্য হয়েছে। কারণ তার ধারনা ছিল এর চেয়েও বড় কোন ঘটনা তার ছেলেরা ঘটালে, তাতে কেউ আদালতে মামলা করতে পারলেও অন্ততঃ বাড়ীতে এসে আক্রমন করার সাহস পাবে না। অথচ একজন বিত্ত বৈভবহীন লোকের সামান্য মেয়ে তার বাড়ীতে এসে আক্রমন করলো, যদিও তাকে সরাসরি অস্ত্র দিয়ে আঘাত করলো না, কিন্তু তাকে ভাবিয়ে তুললো। কারণ তার বহু সাধনায় গড়ে তোলা প্রভাব প্রতিপত্তির মাথায় সে যে ক্ষত সৃষ্টি করে দিলো, সে কেলেংকারির ঘা তো বাকি জীবনে আর শুকোবে না। তাছাড়া নারী ঘটিত...
continue reading