(চার)
ইতিমধ্যেই জনতার মাঝে গুঞ্জনের শব্দ বেড়ে যায়। দূর থেকে শুনলে মনে হতে পারে ওখানে হাট বসেছে। আসলে যে যেখানে বসে বা দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানেই সে তার নিকটবর্তী লোকের সঙ্গে মতবিনিময় করছিল। বিচারকদের সারিতেও সে রকমই দেখা যাচ্ছে। তাদের পেছনে যে সব অনুগত লোক দাঁড়িয়ে ছিল এবং তাদের মধ্যে বিষয়টা যারা বেশি জানে তাদের কেউ কেউ সেটা বিচারকদেরকে বুঝিয়ে বলছেন। এমন সময় কেঁদে কেটে বিপন্ন বিধ্বস্ত কল্পনাকে বৃত্তাকার জনতার মাঝখানে হাজির করলে হঠাৎ সভাজুড়ে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। কিন্তু ঘটনার নায়িকার পাশে যে নায়ককে হাজির করা হলো না সে কথা কেউ বলে না। সে প্রশ্ন যেন নিস্তব্ধতার মাঝে হারিয়ে যায়। এমন কি যে চেয়ারম্যান সাহেব একটু আগেই দুজনকেই হাজির কারার আদেশ দিয়েছিলেন সেখানে যে মাত্র একজন কে হাজির করা হলো তিনিও আর সে কথা বলেন না। নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে তিনি কল্পনাকে প্রশ্ন করেন, ‘আসাদের সঙ্গে তোমার কতদিনের সম্পর্ক ?’
কোন প্রকার ভনিতা ছাড়াই স্পষ্ট করে কল্পনা বললে, ‘এক বছরের।’
‘তোমার তো ছ’মাস আগে বিয়ে হয়েছে তাই না ?’
‘হুঁ।’
‘তাহলে তুমি বলছো বিয়ের আগে থেকেই তোমার সাথে তার সম্পর্ক ছিল ?’
‘হ।
‘তবে বিয়ে করলে কেন ?’
‘বাপ-মা দিছে।’
‘বাপ-মা যখন দিছে তখন তুমিও তা মেনে নিয়ে সেখানে এতদিন ঘর সংসার করেছো। আর এতদিন পর হঠাৎ কি মনে করে তার সঙ্গে প্রেম করতে গেলে।’
‘আমি যাই নাই। সেই আমার কাছে আসতো। নানা প্রকার লোভ দেখাতো। রাজি না হলে ভয় দেখাতো।’
‘সব ষড়যন্ত্র ! আমার মান সম্মান আর সহায় সম্পত্তি লুটে নেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র করে আমার ছেলের পিছনে মেয়েকে লাগিয়ে দিয়েছে। ভাবছে আমি ছেড়ে দেবো ?’ নীরব প্রশ্নোত্তরের মাঝে রইচ কেরানি হঠাৎ গর্জে ওঠলেন হিং¯্র বাঘের মতো। হ্যাচাকের তীব্র আলোয় তার চোখ জ্বলতে থাকে যেন বাঘের চোখের মতোই। তড়িঘড়ি চেয়ারম্যান তাকে থামানোর চেষ্টা করে। তিনি থামেন না। গর্জে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন পেছনে দাঁড়ানো ক’জন অনুগত লোক তাকে ধরাধরি করে বসায়।
একপাশে জনতার মাঝে কল্পনার চাচা সাত্তার মিয়া দাঁড়িয়ে ছিল, সে হঠাৎ বাজখাঁই গলায় কেরানির কথার প্রতিবাদ করলে চেয়ারম্যান তাকেও শাসিয়ে দিলেন। সাথে সাথে আরও দু’তিন জন তাকে ভর্ৎসনা করলো। কল্পনার বাবা জব্বার মিয়া এত লোকের মধ্যে কোথায় যে বসে বা দাঁড়িয়ে আছেন তা এখনো কারো চোখেই পড়েনি। মেয়ে পক্ষের অভিভাবক বিচার প্রার্থী হিসেবে তাকে বাধ্যতামূলক সামনের দিকেই সম্মানের সহিত বসানো উচিৎ ছিল। কিন্তু তারা কামলা শ্রেণীর মানুষ। তাই বোধ হয় তাদের সামনে পিছনে বসা বা না বসা নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই।
কেরানি আবার উত্তেজিত হয়ে হাত নেড়ে বলেন, গাঁয়ের লোকেরা কি জানে না আমার ছেলে কেমন আর তার মেয়ে কেমন ?’
প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে কেরানি এধার ওধার অপেক্ষমান লোকদের দিকে একবার অভিমানী চোখে তাকান সম্ভবত সমর্থনের আশায়। কিন্তু কেউই কথা বলে না। চোখে চোখ পড়ার ভয়ে অনেকেই অন্যদিকে তাকায়।
অবশ্যই গাঁয়ের লোকেরা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের অর্থ-সম্পদ আর চরিত্রের ইতিহাস জানে। না জানলে গাঁয়ে বাস করবে কি করে। মানুষ যখন, তখন তাকে বেঁচে থাকতে হলে অবশ্যই আরেক জন মানুষকে জানতে হবে। যেমন বনের পশুরা জানে কোন্ পশু কেমন। তারাও প্রত্যেকেই প্রত্যেকের ক্ষমতা এবং চরিত্র সম্পর্কে জানে। হরিণ যেমন বাঘকে জানে অথবা বাঘ যেমন হরিণকে জানে। জেনে শুনেই তারা যে যার মতো করে চলে। তেমনি গাঁয়ের লোকেরাও রইচ কেরানি এবং তার ঔরসজাত সন্তান এমনকি তার চৌদ্দ গুষ্ঠির ইতিহাসও জানে কেউ কেউ। আর জানলেই কি সব কথা বলা যায় সব সময় ?
এতক্ষণ মান্যগণ্য ব্যক্তিরা চুপচাপই ছিলেন। আর এই জন্য চুপচাপ ছিলেন যে, যেহেতু স্বয়ং চেয়ারম্যান সাহেব কথা বলছেন তাই তার কথার মধ্যে কথা বলা শোভা পায় না। আর যেহেতু শেষ পর্যন্ত চেয়ারম্যান তাদের উপরই দ- নির্ধারনের ভার বর্তাবেন তখন তারা কথা না বলেও থাকতে পারবেন না। কিন্তু হাজী কালাচান শেখ শোভা পাওয়া না পাওয়ার তোয়াক্কা না করেই হঠাৎ ধমকে উঠে বলেন- এই মেয়ে তোমার শরম নাই ? ঘরে স্বামী রেখে অন্য পুরুষের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি কর। লজ্জা নাই তোমার ?’
মূহুর্তে জনতার মাঝে গুঞ্জন ওঠে। সেটা তিরষ্কারের আর বিদ্রুপের। হাজী সাহেবের সাথে সবাই যেন একমত। সবাই যেন ঐ কথাটাই বলতে চাচ্ছিল যে,...
continue reading