Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.
Travel Image

নওগাঁর দিবর দীঘিতে



বরেন্দ্র অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে নওগাঁ জেলার গুরুত্ব অপরিসীম। সেই সঙ্গে নওগাঁ জেলা বাংলাদেশের পরিচিত একটি জেলা। প্রাচীন বাংলার এক সমৃদ্ধ জনপদের নাম বরেন্দ্রভূমি। অনেক দর্শনীয় স্থান, পর্যটন কেন্দ্র থাকলেও এই জেলায় আরও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ইতিহাসকেন্দ্রিক স্থান। তার মধ্যে একটি দিবর দীঘি। নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলা থেকে ১৬ কি.মি. পশ্চিমে সাপাহার-নওগাঁ সড়কের পাশেই ঐতিহাসিক দিবর দীঘি অবস্থিত। দিবর দীঘির ঐতিহাসিক পটভূমি ছাড়াও এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বরেন্দ্র অঞ্চলের বিশেষ ভূমিরূপ এবং আদিবাসী সাঁওতালদের জীবনধারা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য অন্যতম।

ফিরে যাই পেছনে :
ইতিহাস অনেক কিছু বলে আর এই ইতিহাসই পরিচয় করিয়ে দেয় অজানাকে। তেমন দিবর দীঘির সম্পর্কে জানতে আমরাও তাকাব পেছনে ফিরি। দিবর বা ধীবর দীঘি নামে পরিচিত এই জলাশয় ও জলাশয়ের মাঝখানে স্তম্ভটি একাদশ শতাব্দীর কৈবর্ত্য রাজা দিব্যক, তার ভ্রাতা রুদোক ও রুদোকের পুত্র প্রখ্যাত নৃপতি ভীমের কীর্তি হিসেবে পরিচিত। ইতিহাস থেকে জানা যায়, পাল রাজা দ্বিতীয় মহীপালের (১০৭০-১০৭১ খ্রি.) অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বরেন্দ্রভূমির অধিকাংশ অমাত্য পদচ্যুত সেনাপতি বরেন্দ্রভূমির ধীবর বংশোদ্ভূত কৃতী সন্তান দিব্যকের নেতৃত্বে পাল শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় মহীপালকে হত্যা করেন। পরে দিব্যককে সর্বসম্মতিক্রমে বরেন্দ্রর অধিপতি হিসেবে নির্বাচন করা হয়। স্বল্পকাল পরে দিব্যক মৃত্যুবরণ করলে প্রথমে রুদোক ও পরে রুদোক-পুত্র ভীম সিংহাসনে আরোহণ করেন। এই তিন কৈবর্ত্য বংশীয় রাজা ২৫-৩০ বছর বরেন্দ্র ভূমি শাসন করেন বলে জানা যায়। পরে দ্বিতীয় মহীপালের ভ্রাতা রামপাল ভীমকে পরাজিত ও নিহত করে পালরাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। বাংলাদেশের এই প্রাচীন জয়স্তম্ভটি কোন কৈবর্ত্য রাজা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেনÑ আজ অবধি তা সঠিক জানা যায়নি। একটি অখণ্ড পাথর কেটে তৈরি এই স্তম্ভের নয়টি কোণ আছে। এর এক কোণ থেকে আরেক কোণের দূরত্ব ১২ ইঞ্চি। এই বিরট স্তম্ভের উপরিভাগে পর পর তিনটি বলয়াকারে স্ফীত রেখা (ইধহফ) আছে যা স্তম্ভের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। এর শীর্ষদেশে আছে নান্দনিক কারুকার্য যা বাহ্যত মুকুটাকারে নির্মিত। বর্ণনা মতে, পানির উপরে স্তম্ভের উচ্চতা প্রায় ১০ ফুট, পানির ভেতরে ১২ ফুট এবং মাটির নিচে সম্ভবত আরও ৮-১০ ফুট গ্রোথিত আছে। স্যার বুকানন হ্যামিলটনের মতে, স্তম্ভের সর্বমোট দৈর্ঘ্য ৩০ ফুট এবং স্যার আলেকজান্ডার কানিংহামের মতে ৩০ ফুট। কানিংহাম ১৮৭৯ সালে যখন এই দীঘি পরিদর্শন করেন তখন এর গভীরতা ছিল ১২ ফুট এবং প্রত্যেক বাহুর দৈর্ঘ্য ছিল ১২০০ ফুট। ধীবর দীঘির এই জয়স্তম্ভটি হাজার বছরের বাংলা ও বাঙালির শৌর্য-বীর্যের প্রতীক হিসেবে কালের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে আজও দণ্ডায়মান। গ্রানাইট পাথরে তৈরি এরকম প্রাচীন স্তম্ভ বাংলাদেশে আর কোথাও নেই।

নয়নাভিরাম বাংলার রূপ :
বাংলার অপার রূপ সবার চোখ জুড়ায়। আর তাই তো, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ নওগাঁর বরেন্দ্র এলাকার রূপে মুগ্ধ হয়েই বোধহয় ছুটে আসতেন বারবার কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ। থাক সে কথা, আমাদের বাংলা রূপ-সৌন্দর্যের কথা পৃথিবীর সবাই জানে। এবার আসা যাক দিবর দীঘিতে, ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ দিবর দীঘি, এলাকায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেরও কোন কমতি নেই। দীঘির মূল ঘাটে প্রবেশ করার সময় দু’পাশে উইপিং দেবদারু গাছ দিয়ে ঘেরা রাস্তা আপনাকে স্বাগত জানাবে। দীঘির পাড়ে কয়েকশ’ একর জায়গাজুড়ে রয়েছে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন গাছের সমন্বয়ে সামাজিক বনায়ন প্রকল্প এবং দীঘির পশ্চিম পাড়ে বিশাল আম-কাঁঠালের বাগান। দীঘির পশ্চিম দিক থেকে দক্ষিণ দিকে রয়েছে দীর্ঘ খাঁড়ি। বর্ষার সময় বনের ভেতর দিয়ে খাঁড়ির প্রবাহ আপনাকে সুন্দরবনের কথা মনে করিয়ে দেবে। এই খাঁড়ি বিভিন্ন এলাকা ঘুরে আত্রাই নদীতে মিশেছে। এখানকার প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে বরেন্দ্র অঞ্চলের বিশেষ ভূমিরূপ। যা দেখতে হলে আপনাকে বরেন্দ্র এলাকা ঘুরতেই হবে। বরেন্দ্রভূমির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত উঁচু-নিচু টিলার মতো বা ঢেউ খেলানো বিস্তীর্ণ মাঠ যুগ যুগ ধরে কালের সাক্ষী হয়ে আছে। দীঘির জলাশয় থেকে উপরের দিকে গ্যালারির মতো হয়ে ওঠে যাওয়া ভূমি সত্যিই অপরূপ। বর্ষাকালে দিবর দীঘি এলাকা এক ভিন্ন রূপ ধারণ করে। সে সময় এলাকাজুড়ে ধান চাষ করা হয়। উঁচু-নিচু ঢেউ খেলানো ধানক্ষেতে সবুজের সমারোহ দেখে আপনার প্রাণ ও চোখ দুটোই জুড়াবে। সন্দেহ নেই এখানে এলে আপনার মনে হবে প্রকৃতি ও ইতিহাস যেন দাঁড়িয়ে আছে হাতে হাত ধরে।

ভিন্ন জীবনধারার মানুষ :
বাংলাদেশের যেসব জেলায় সাঁওতালরা বসবাস করে নওগাঁ জেলা তাদের মধ্যে অন্যতম। নওগাঁর প্রায় সব উপজেলাতে সাঁওতালদের বাস চোখে পড়ে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাঁওতালরা তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য লালন করে চলেছে বছরের পর বছর। যা আমাদের সংস্কৃতিতে যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা। দিবর দীঘিকে ঘিরে দিবর গ্রামের সঙ্গেই রয়েছে সাঁওতালপাড়া। কিছুটা সময় নিয়ে আপনি খানিক সময় সাঁওতালপাড়ায় গিয়ে কাটাতে পারেন। সাঁওতালদের খাওয়া-দাওয়া, ঘর-বাড়ি, বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, নিজস্ব ভাষা, ঐতিহ্য সর্বোপরি তাদের জীবনধারা সম্পর্কে জানা আপনার অভিজ্ঞতার ঝুলিকে সমৃদ্ধ করবে। ভ্রমণের আগে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে বা ভ্রমণের সময় তাদের প্রস্তুতির জন্য কিছুটা সময় দিলে সাঁওতালরা তাদের ভাষায় গান, নাচ, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডসহ তাদের ঐতিহ্য তুলে ধরবে আপনাদের সামনে। যা আপনাদের জন্য বাড়তি বিনোদন হতে পারে।

কিভাবে যাবেন কোথায় থাকবেন :
দেশের সব জায়গা থেকেই জেলা সদর নওগাঁয় আসা যায়। এরপর বাস টার্মিনাল থেকে সাপাহারের বাসে উঠে দিবর দীঘির মোড়ে নামতে হবে। নওগাঁ থেকে দিবর দীঘির দূরত্ব ৫৫ কি.মি.। বাসে সময় লাগবে দেড় থেকে ২ ঘণ্টা। ঢাকা থেকেও সরাসরি দিবর দীঘিতে আসতে পারেন। প্রতিদিন ঢাকা থেকে হানিফ এন্টারপ্রাইজ, আল নাফি একাধিকবার সাপাহার পর্যন্ত চলাচল করে। সাপাহার এসে ভ্যান বা রিকশাযোগে দিবর দীঘি যেতে পারেন। ভাড়া জনপ্রতি ১০ টাকা। এবার থাকার কথা। সাপাহারে কিছু আবাসিক হোটেল আছে তবে এগুলো যদি আপনার মনে না ধরে সেক্ষেত্রে কষ্ট করে নওগাঁ সদরে এলে আপনি ভালো আবাসিক হোটেল পাবেন। এখানে থাকার জন্য ১৫০ থেকে ১৫০০ টাকা মধ্যে রুম পাবেন। এসি রুমও আছে সেক্ষেত্রে বাজেট বাড়াতে হবে। আর খাওয়ার জন্য সাব্বির, সম্রাট, আরামবাগ এই রেস্তোরাঁগুলো পাবেন হাতের কাছেই।