বগুড়া জেলা সদর থেকে আরো ১৮ কিলোমিটার উত্তরে ভাসু বিহারের অবস্থান। বিশ্বরোড নামে পরিচিত বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের পাশে দেখা মিলবে সমৃদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান মহাস্থানগড়। সেখান থেকে আরো ৬ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম দিকে গেলে দেখা মিলবে ভাসুবিহারের। মহাস্থানগড় প্রত্নস্থল হিসেবে বেশ পরিচিত হলেও ভাসু বিহারের খোঁজ খুব বেশি মানুষ জানে না। মহাস্থানগড়ের লোকারণ্যের কোলাহল ছাড়িয়ে শান্ত, নিরিবিলি ভাসু বিহারের কোলে পাওয়া যাবে অন্য রকম আমেজ।
ভাসুবিহার স্থানীয় নাম নরপতীর ধাপ। বিভিন্ন সময় গণমানুষের প্রতিনিধিত্ব করেছে এই ঐতিহাসিক প্রত্নস্থল। এর অবস্থান শিবগঞ্জ উপজেলার বিহার হাটে। বিহার হাটের কেন্দ্রীয় বিপননস্থল পার হয়ে পাকা সড়ক ধরে পশ্চিমে আরো খানিকটা এগিয়ে যেতে হবে। সেখানে পৌঁছে দেখা যাবে খোলা মাঠের ওপর একটি ছোট আকারের প্রাচীন ইটের ভবনের অংশবিশেষ, আর তার চেয়ে বড় আকারের দুটি ভবনের কাঠামো।
এখানে ১৯৭৩-৭৪ সালে প্রথমবারের মতো প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু হয় এবং তা পরবর্তী দুই মৌসুম অব্যাহত থাকে। খননের ফলে দুটি মধ্যম আকৃতির সংঘারাম এবং একটি মন্দিরের স্থাপত্তিক কাঠামো সহ প্রচুর প্রত্নবস্তু পাওয়া যায়। সংঘারাম সেই ধরনের ভবনকে বলা হয় যেখানে অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষু রা একসঙ্গে বসবাস করতো। তাদের শান্তিপূর্ণ অবস্থান, ধর্মচর্চা আর শিক্ষা গ্রহণের কেন্দ্র হিসেবে সংঘারামগুলো ইতিহাসজুড়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে গেছে।
ছোট সংঘারামটির আয়তন উত্তর-দক্ষিণে ৪৯ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৪৬ মিটার। এর চার বাহুতে ভিক্ষুদের ২৬টি কক্ষ রয়েছে। কক্ষগুলির সামনে চারদিকে ঘোরানো বারান্দা এবং পূর্ব বাহুর মাঝখানে প্রবেশ পথ আছে। বড় সংঘারামটি ছোটটির মতই দেখতে তবে এর আয়তন ও কক্ষসংখ্যা বেশি। বড় আকারের একটি খোলা অংশকে ঘিরে এসব ছোট আকারের ঘরগুলি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আবাসকক্ষ। দেখে মনে হয়, খোলা বড় অংশটি ছিল মিলনায়তন। কল্পনা করুন, একটা বিশাল হলঘরে শত শত নবীন ভিক্ষু তাদের শিক্ষকের কাছে ধর্ম ও মানবতা শিক্ষা নিয়ে আলোচনায় মগ্ন হয়েছেন !
যে মন্দিরের কাঠামো পাওয়া গেছে তার মাঝখানে বর্গাকার মন্ডপ এবং চারপাশে ধাপে ধাপে উন্নিত প্রদক্ষিণ পথ আছে। এখানে প্রায় ৮০০ প্রত্নবস্তু পাওয়া গেছে। তার মধ্যে ছিল ক্ষুদ্রাকৃতির মূর্তি, পোড়ামাটির ফলক ও সিলমোহর, মূল্যবান পাথরের গুটিকা, অলংকৃত ইট ও ফলক, মাটির প্রদীপ, পাত্রের টুকরা সহ অসংখ্য প্রত্নবস্তু। এখানে পাওয়া প্রত্নবস্তুগুলো বিভিন্ন সময়ে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ ও গবেষকরা সংরক্ষণ করে রেখেছেন।
চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এসেছিলেন এখানে, ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দের আশেপাশের সময়ে। তার ভ্রমণবিবরণীতে তিনি এটাকে ‘পো-শি-পো’ বা বিশ্ববিহার নামে উল্লেখ করেছেন। এটি বিদ্যাপিঠ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তার উল্লেখ পাওয়া যায় ঐতিহাসিকদের বর্ণনায়।। ব্রিটিশ আমলেও ভাসুবিহারকে স্থানীয় মানুষরা ‘ভুশ্বুবিহার’ নামে অভিহিত করতো। ‘পো-শি-পো’ বিহার সম্পর্কে হিউয়েন সাঙ লিখেছেন, ‘এর সন্নিকটে যেখানে গৌতম বুদ্ধ দেবগণকে অর্থাৎ রাজপুরুষ ও নেতৃবৃন্দকে বৌদ্ধধর্ম শিক্ষা দিতেন এবং সেখানে বিশ্রাম নিতেন’ ।
যেখানে তিনি বিশ্রাম নিতেন সেখানে তাঁর পদচিহ্ন সংরক্ষিত ছিল এবং সম্রাট অশোক সেখানে একটি ইটের স্তুপ তৈরি করে দেন। স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম সেই স্তুপটিকে হিউয়েন সাঙ বর্ণিত অশোকস্তুপ হিসেবে সনাক্ত করেছেন। সম্রাট অশোক মগধ যুদ্ধের পরে বৌদ্ধধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত হয়ে পড়েন। বিভিন্ন সময়ে তিনি বৌদ্ধস্তুপ নির্মাণ ও ভিক্ষুদের সহায়তা করেন। ভাসু বিহারেও সম্রাট অশোকের করে যাওয়া কীর্তির ছাপ খুঁজে পাওয়া যাবে।
শোনা যায়, ভাসুবিহারের মন্দিরে গৌতম বুদ্ধের একটি সোনার মূর্তি ছিল। যার নাম ‘অবলোকিতেশ্বর’- অর্থাৎ যে ঈশ্বর তাকিয়ে আছেন তাঁর ভক্তদের দিকে। যদিও বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময় তেমন কোনো মূর্তি পাওয়া যায়নি। তারপরও লোকমুখে ছড়িয়ে আছে এসব গল্পগাঁথা।
সময়ের আঘাতে ভাসুবিহার অবশ্য অনেকখানি ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে। শোনা যায়, এর গায়ে পোড়ামাটির অনেক অলংকরণ ছিল। এখন আর এসব চোখে পড়েনা। তাছাড়া অনেক সময় প্রত্নচোর আর অবিবেচকরা খুলে নিয়ে যায় কাঠামোর ইট। কঠোর হাতে এসব দমন করে রক্ষা করতে হবে এসব প্রাচীন প্রত্নসম্পদকে।
বিহার হাটের আশেপাশে আরও কিছু প্রত্নস্থল আছে। ‘পো-শি-পো’ বিহার ছাড়াও আছে সুলতান গিয়াস উদ্দিন আইওয়াজ কর্তৃক নির্মিত ‘বসনকোট’ দূর্গের অংশবিশেষ ও একটি প্রাচীন মসজিদ।
ভাসুবিহারে পা রাখলে এখানকার নৈসর্গিক দৃশ্য দেখেও মন জুড়িয়ে যাবে। খোলা প্রান্তরের বট, পাকুড় আর শিমুল গাছের কোলে প্রাচীন ঐতিহ্যের গর্ব হয়ে চিরকাল দঁড়িয়ে থাকবে ভাসুবিহার। এছাড়া গ্রাম বাংলার প্রকৃতি, স্নিগ্ধতা আর মানুষের সাহচর্য আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে এখানে।