শুক্র গ্রহ বা ভেনাস (Venus) সৌরজগতের দ্বিতীয় গ্রহ। কারণ সূর্য থেকে দূরত্বের দিক থেকে হিসেব করলে সূর্যের একেবারে কাছের গ্রহ হচ্ছে বুধ গ্রহ, আর এর পরই শুক্র গ্রহের অবস্থান। বুধ আর পৃথিবীর মতই এই গ্রহটিও কঠিন পদার্থ দিয়ে তৈরি বলে একে পার্থিব গ্রহ বলা হয়। পৃথিবী এবং শুক্রের মধ্যে গাঠনিক উপাদান, আকার-আকৃতি, মুক্তি বেগ এবং অন্যান্য মহাযাগতিক আচরণে মিল রয়েছে বলে শুক্রকে পৃথিবীর বোন গ্রহ বা “sister planet” বলে।
এটি এমন একটি গ্রহ যাকে দুটি ভিন্ন ভিন্ন তাঁরা নামে ডাকা হয়। ভোড় রাতের আকাশে শুকতাঁরা আর সন্ধ্যার আকাশের সন্ধ্যাতাঁরা একই খ-বস্তু, যা সত্যিকার অর্থে একটি গ্রহ, আর এই গ্রহটিই হচ্ছে শুক্রগ্রহ। অনেক যায়গায় এই গ্রহটি যখন ভোরের আকাশে উদিত হয় তখন লুসিফার বা শয়তান নামেও ডাকা হয়ে থাকে।
শুক্র গ্রহের লাতিন নামকরণ করা হয়েছে রোমান প্রেমের দেবী ভিনাসের নামানুসারে। পৌরাণিক কাহিনীতে ভেনাস (শুক্র) ভালকানের স্ত্রী।
সৌন্দর্যে দেবী ভেনার্স মূর্তী
কক্ষপথ
আমরা জানি সব গ্রহের কক্ষপথ উপবৃত্তাকার, কিন্তু শুক্রের কক্ষপথ উপবৃত্তাকার না হয়ে প্রায় গোলাকার। তাই এর উৎকেন্দ্রিকতা শতকরা এক ভাগেরও কম। আগেই বলেছি শুক্র হচ্ছে দূরত্বের দিক থেকে সূর্যের দ্বিতীয় গ্রহ, তাই বুধ গ্রহেরই মতো এই গ্রহটিকেও শুধুমাত্র সূর্যোদয়ের কয়েক ঘণ্টা আগে এবং সূর্যাস্তের কয়েক ঘণ্টা পরে দেখা যায়। আরো পরিস্কার ভাবে বললে- সূর্য থেকে শুক্রের দূরত্ব কখনোই ৪৭ ডিগ্রীর বেশী হয় না, ফলে সূর্যদয়ের পূর্বে বা সূর্যাস্তের পরে তিন ঘন্টার সামান্য বেশী সময় ধরে একে পৃথিবী থেকে দেখতে পাওয়া যায়। অবশ্য যখন শুক্র তার উজ্জ্বলতম অবস্থায় থাকে তখন দিনের বেলায়ও একে দেখা যায়। চাঁদ ছাড়া শুক্র গ্রহই একমাত্র জ্যোতিষ্ক যা পৃথিবীর আকাশ থেকে রাত এবং দিন উভয় সময়েই দেখা যায়। আর সূর্য ও চাঁদের পরে শুক্রই হচ্ছে তৃতীয় উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক পৃথিবীর আকাশে। আরো জোনে রাখুন পৃথিবীর সবচেয়ে নিকটতম গ্রহ হচ্ছে এই শুক্র গ্রহ।
শুক্র গ্রহের অন্তঃসংযোগের সময় এটি পৃথিবীর সবচেয়ে নিকটে আসে; তখন শুক্র থেকে পৃথিবীর দূরত্ব হয় চাঁদ থেকে পৃথিবীর গড় দূরত্বের প্রায় ১০০ গুণ। ১৮৫০ সালের ১৬ই ডিসেম্বরে শুক্র গ্রহ যখন পৃথিবীর কাছে পৌঁছেছিল তখন এর দূরত্ব ছিল ৩৯,৫৪১,৮২৭ কিলোমিটার। ২১০১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত এটিই থাকবে সর্বনিম্ন দূরত্ব। কারণ এই দিনটিতে আবারো শুক্র গ্রহ ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর ৩৯,৫৪১,৫৭৮ কিলোমিটারের মধ্যে এসে পরবে।
ঘূর্ণন
শুক্র গ্রহের আরেকটি মজার বিষয় হচ্ছে – সূর্যের প্রায় সব কটি গ্রহই সূর্যকে কেন্দ্র করে পশ্চিম থেকে পূর্বে ঘুরছে কিন্তু এই গ্রহটি ঘুরছে পূর্ব থেকে পশ্চিমে। আমাদের পৃথিবীতে সূর্য পূর্ব থেকে উদিত হয়ে পশ্চিমে অস্ত যেতে দেখি, কিন্তু শুক্র গ্রহে সূর্য পশ্চিম দিকে উদিত হয়ে পূর্বে অস্ত যাচ্ছে। যদি কোনো দিন মানুষ সেখানে দাঁড়াতে পারে তাহলে এই বিচিত্র জিনিস দেখে নয়ন জুড়াবার সুযোগ পাবে।
শুক্রের আহ্নিক গতি হচ্ছে পৃথিবীর হিসাবে ১১৬.৭৫ দিনের সমান। আর তার নিজের কক্ষপথে সূর্যকে একবার ঘুরে আসতে সময় লাগে পৃথিবীর হিসাবে ২২৪.৭০ দিন। এবার বলুন- শুক্রীয় কত দিনে শুক্রীয় এক বছর হয়? উত্তর হচ্ছে – শুক্রের মাত্র ১.৯২ দিনেই শুক্রের এক বছর হয়ে যায়, অদ্ভুত তাই না!
চাঁদের যেমন কলা দেখা যায় তেমনি টেলিস্কোপ দিয়ে শুক্রেরও কলা দেখা যায়।
কলার প্রক্রিয়া
২০০২ সালের একটি শুক্র কলার চিত্র।
পৃথিবী থেকে বড় কোনো টেলিস্কোপে দেখলে শুক্রের রং এমন দেখাবে।
আবহাওয়া
শুক্রপৃষ্ঠ দেশের উপরে ৬৫ কি.মি. পুরু একটি মেঘের স্তর রয়েছে। এই স্তরের উপরে ৭৬ কি.মি উঁচুতে আরো একটি স্বচ্ছ স্তর রয়েছে। মেঘের স্তরটি প্রতি ৪ দিনে একবার গ্রহের কক্ষের চার দিকে আবর্তিত হয়। পৃথিবীর আকাশে যেমন বিদ্যুত চমকাতে দেখা যায় তেমনি শুক্রের আকাশেও বিদ্যুৎ চমকাতে দেখা যায়।
শুক্র গ্রহের আবহমন্ডলের প্রায় সবটাই (৯৭ ভাগ) কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস। আর প্রায় আড়াই ভাগ রয়েছে নাইট্রোজেন, অন্যদাকে মাত্র ০.৪ ভাগ অক্সিজেন গ্যাস রয়েছে শুক্রের বায়ু মন্ডলে। শুক্র গ্রহে কিছু হাইড্রোজেন, এ্যামোনিয়া এবং নামমাত্র জলীয়বাষ্পের অস্তিত্ব রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে উইকিতে দেখা যাচ্ছে এইসমস্ত উপাদানের পরিমাণ দেয়া আছে এমন-
৯৬.৫% কার্বন ডাই অক্সাইড ৩.৫% নাইট্রোজেন .০১৫% সালফার ডাই অক্সাইড .০০৭% আর্গন .০০২% বাষ্প .০০১৭% কার্বন মনোক্সাইড .০০১২% হিলিয়াম .০০০৭% নিয়ন trace কার্বনিল সালফাইড trace হাইড্রোজেন ক্লোরাইড trace হাইড্রোজেন ফ্লোরাইড
ঘন কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর স্তর ভেদ করে সূর্যের তাপ শুক্র পৃষ্ঠে পতিতো হয় ঠিক ই কিন্তু সেখান থেকে আর ফিরে আসতে পারে না। ফলে শুক্রের তাপ মাত্রা হয়ে যায় আনেক, ৭৫০ ডিগ্রী কে. পর্যন্ত। আবহাওমণ্ডলের উপাদান আর তাপের কথা বিবেচনা করে শুক্র গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব থাকার সম্ভবনা অনায়াশেই নাকচ করে দেয়া যায়।
পৃষ্ঠদেশ
ঘন ও পুরো মেঘের স্তরের কারনে পৃথিবী বা মহাশূন্য থেকে টেলিস্কোপের সাহায্যে কিছুতেই শুক্রের পৃষ্ঠদেশ দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু রাশিয়া ও আমেরিকার ভেনেরা ও পাইওনিয়ার ভেনাস অরবিটার, সেই সাথে অন্যান্য ভেনাস মিশনের ফলাফল থেকে এটা জানা গেছে যে শুক্র গ্রহের পৃষ্ঠ দেশের শতকরা ৭০ ভাগই মোটামুটি সমতল। এই সমতল অংশের ২০ শতাংশ আবার নিম্নভূমি। শুক্রের সবচেয়ে উঁচু স্থানটির নাম দেয়া হয়েছে Maxweell montes, সমতল ভূমি থেকে এর উচ্চতা ১১ কি.মি.।এই Maxweell montesটি ইশতার টেরা নামক অঞ্চলে অবস্থিত।
Maxweell montes
শুক্র অভিযান
আগেই বলেছি ঘন মেঘের কারণে শুকের সারফেজ দেখা অসম্ভব, তাই শুক্র গ্রহের তথ্য সংগ্রহের জন্য অনেকগুলি মহাকাশযান শুক্র অভিযানে পাঠানো হয়েছে। সেগুলির মধ্যে পাইওনিয়ার, ভেনাস- ১ ও ২ এবং ভেনেরা ১১, ১২, ১৩ ও ১৪ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাইওয়নিয়ার মহাকাশযান শুক্র গ্রহের কাছ থেকে অনেক সব ছবি তুলে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। সেগুলি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে শুক্র গ্রহে বিশাল পাহাড়, সমতলভূমি ও অনেক আগ্নেয়গিরি রয়েছে। পাইওনিয়ারের পাঠানো তথ্য উপাত্ত ও ছবির সাহায্যেই শুক্রের মোটামুটি একটি মানচিত্র দাঁড় করানো গেছে।
The Pioneer Venus orbiter
তাছাড়া ভেনেরা-১৪ ও ১৫ শুক্র গ্রহে নেমে শুক্রপৃষ্ঠের অনেক ছবি তলে সেগুলি পৃথিবীতে পাঠিয়েছে ।
আরো কিছু টুকি টাকি তথ্য:
# শুক্রের ব্যাস ১২,১০৪ কিলোমিটার।
# শুক্র গ্রহের উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো চৌম্বকক্ষেত্র নেই।
# শুক্রের পৃষ্ঠদেশ প্রচণ্ড রকমের শুষ্ক।
# শুক্র গ্রহের মুক্তি বেগ বা এসকেপ ভেলোসিটি প্রতি সেকেন্ডে ৬.৫ মাইল।
# শুক্র গ্রহের কোনো উপগ্রহ বা চাঁদ নেই।
# শুক্র গ্রহে প্রাণের কোনো অস্তিত্ব নেই।
# শ্রক্রের উজ্জ্বলতা সবচেয়ে কম যখন থাকে তার মান হয় -৩.৮ আর স্বচেয়ে বেশি উজ্জ্বলতার মান হচ্ছে -৪.৬।
# সূর্য থেকে শুক্রের দূরত্ব 108,208,930 কি.মি.
# শুক্রের Mass: 4,868,500,000,000,000,000,000,000 কেজি।
# শুক্র গ্রহ একটি অস্বচ্ছ সালফিউরিক এ্যাসিডের মেঘ দ্বারা আবৃত। এই মেঘ প্রচণ্ড reflective ও ঘন হওয়ায় সাধারণ আলোয় শুক্রের পৃষ্টদেশ দেখা সম্ভব হয় না।
# পৃথিবী, মঙ্গল ও শুক্রকে অনেক স্থানেই তিন বোন বিবেচনা করা হয় তাদের অনেক মিলের জন্য।
# আকৃতির তুলনা
বাম দিক থেকে- বুধ, শ্রক্র, পৃথিবী, মঙ্গল।