মাথার উপর বিশাল আকাশ। ঘন সবুজ গাছপালার ছায়ায় ঘুমিয়ে আছে প্রাচীন সমৃদ্ধ নগর মহাস্থানগড়। এখানে রাত জেগে চাঁদ ঘুমায়। চাঁদের অপরূপ সুষমায় পাল, সেন রাজারা গল্প করে। হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করার গল্প। বিলুপ্ত সভ্যতাকে পুনরুজ্জীবিত করার গল্প। আপনি কান পাতলে নিশ্চয় সেবস গল্প শুনতে পাবেন। ভগ্নপ্রায় পাকা বাড়ির প্রতিটি ইট আপনাকে গল্প বলে শুনাবে। কোথাও পড়ে থাকা এক টুকরা পাথর আপনাকে সেসব গল্প বলবে। আর ধ্বংশের শেষ সীমায় পৌছায় পুকুর -ইন্দারা-পাতকুয়ার কথা শুনে আপনার চোখ টলমল করবে। ভ্রমন প্রেমীদের জন্য এ সময়টা খুবই মনোরম। শিউলী ফোটা শরৎ সকালের প্রকৃতির স্নিগ্ধ পরশ। ঘাসের বুকে জমে থাকা শিশির কোণা আপনার পা ধুয়ে দেবে। অদূরে চরজাগা করতোয়ার বুকে পাল তোলা সারি সারি নৌকা। দূরের মেঠো পথ থেকে ভেসে আসে ভাওয়াইয়া গানে আপনি মোহাবিষ্ট হবেন। এখানে খেটে খাওয়া মানুষের সুন্দর আচরণ বিলুপ্ত সভ্যতার সুন্দর পরিচয়ই বহণ করে। তার আগে অবশ্য আপনার চোখ কিছুটা পরিতৃপ্ত হবে বিশ্বের ১১তম দীর্ঘতম সেতুর গায়ে হাত বুলিয়ে। এতবড় যমুনা নদীর ওপর দিয়ে প্রতিদিন যে হাজার হাজার যন্ত্রদানব ওপারে যাচ্ছে তা না দেখলে বিশ্বাস করবেন না। মহাস্থান খননের ফলে যে সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায় তা হলো হিন্দু-বৌদ্ধ সভ্যতা। এখনও হিন্দু ধর্মের হিন্দু তীর্থস্থান মহাস্থানের আশপাশে রয়েছে। করতোয়ার পশ্চিম পাশে জাহ্নবী নামক দেবী স্থানে স্নান করলে তীর্থ লাভ হয় বলে অনেকে মনে করে। এছাড়া কালীদহে পদ্মার বাড়ী বানাইয়া পদ্মপুরাণ ও মথুরার শ্রী কৃষ্ণের কংসবধ লীলা, গোকুলে নন্দ ঘোষের বাড়ি, কুটিশ্বরী কালীঞ্চুরী দেবী, ভূতিকেশ্বর, উগ্রমাধব, শিব, সূর্য-মন্ডপ,কু প্রভৃতি কল্পিত তীর্থস্থান ও দেব-দেবীবেষ্টিত মহাত্মযুক্ত স্থান এ মহাস্থানগড়। জনশ্র“তি আছে ভগবানের ষষ্ঠ অবতার পরশুরামের গড় এই মহাস্থান। তিনি পালরাজ রাম বা কৈবত্ত নায়ক ভীম। চৈনিক পরিব্রাজক যুয়ান চুং ৬৩৯-৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত ভ্রমণ করেন। তার সি-মু-কি নামক গ্রন্থে পন্ডুবর্ধন নগরের কথা উল্লেখ আছে। পুন্ডুবর্ধনই হলো আজকের এই মহাস্থান।
রাজধানীর আশপাশে শহর থাকে। মহাস্থান গড় ছিল রাজধানী। এর আশপাশে প্রায় ১১ মাইল পর্যন্ত সুরক্ষিত ছিল যার প্রমাণ প্রত্মতাত্ত্বিকদের খুঁড়াখুঁড়ির ফলে বেরিয়ে এসেছে। এই মহাস্থানগড় প্রাচীন কালে কোন রাজা কর্তৃক প্রথম প্রতিষ্ঠিত তার কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই।
বগুড়া শহর থেকে মাত্র ৭ মাইল উত্তরে রংপুর সড়কের বাম পাশে সমতল ভূমি থেকে ২০-২৫ ফুট উঁচুতে উত্তর-দক্ষিণে ৩ হাজার ফুট দীর্ঘ এবং পূর্ব-পশ্চিমে ২ হাজার ফুট প্রস্থ বালি-পাথরে সংমিশ্রিত, গুল্ম আচ্ছাদিত হয়ে হাজার বছরের ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন সভ্যতার রাজধানী মহাস্থান।ইতিহাসে একে মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সেন রাজাদের প্রাদেশিক রাজধানী বলে উল্লেখ করেছে। ইতিহাস এবং প্রত্মতাত্ত্বিকদের পাওয়া দুর্মূল্য অলঙ্কারাদি, অস্ত্র-শস্ত্র, মুদ্রা ও বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি, দালানের ভগ্নাবশেষে এটাই প্রমানিত হয় যে- এখানে বিলুপ্ত সভ্যতা ছিল একটি সমৃদ্ধ সভ্যতা। মহাস্থানে বহু দর্শনীয় স্থান পুরনো সভ্যতার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্থানগুলো হলো বলখী (র :) মাজার, বেহুলার বাসরঘর, গোবিন্দ ভিটা, জাদুঘর, খোজার ভিটা, মানখালী, পূজারবাড়ি, জিউৎকুন্ড, শিলাদেবীর ঘাট, গোকুল, বৈরাগীর বাড়ি, ওঝা ধন্ধন্তরীর বাড়ি, নেতাই ধোপানী, কাসী তলা, ঘাঘট দুয়ার, গুপ্ত বারানসী ইত্যাদি।
সুলতান বলখীর (র :) মাজার : মহাস্থানে যাওয়ার সময় প্রথমেই হাতের বাম পাশে সুউচ্চ টিলার মতো গাছঘেরা যে জায়গা পড়বে সেটাই সুলতান বলখীর (র :) মাজার। রাজা পরশুরামের আমলে বলখী (র :) পীর মহাস্থানে আগমন করেন এবং ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে রাজদরবারে দূত পাঠান। এতে দু’পক্ষের মধ্যে যুদ্ধহয়। পরশুরাম পরাজিত ও নিহত হয়। তখনই পরশুরাম সভ্যতার অবসান হয়। প্রতি জুমারাত বা বৃহস্পতিবার রাতে মাজার শরীফে জুমারাতের জন্য অনেক যাত্রী আসে। মহররম, শবেবরাত ও দুই ঈদে প্রচুর ধূমধাম হয়। কোরবানি হয়। চৈত্র মাসে ওরস ও বারুনীর মেলা হয়। জ্যৈষ্ঠ মাসেও বারুনী মেলায় প্রচুর লোক সমাগম হয়। হিন্দু-মুসলমান সবাই ভক্তি, সেলাম ও শিরনী মানত করে।
বেহুলার বাসরঘর : মহাস্থান থেকে ২ কিমি দূরে ১৫০ কুঠুরীসমৃদ্ধ উঁচু টিলার নাম বেহুলার বাসরঘর। প্রত্মতত্ত্ব বিভাগের সাইনবোর্ডে বাংলা-ইংরেজি দু’রকমেই এ সম্পর্কিত তথ্য লিপিবদ্ধ আছে। লক্ষ্মীন্দরের পিতা চাঁদ পূজা না দিয়ে পদ্মার কোপে পতিত হয়। সর্পাঘাতে ৬ পুত্রের মৃত্যু হয়। সর্বশেষ পুত্র লক্ষ্মীন্দরকে রক্ষার জন্য লোহার বাসরঘর তৈরি করেন। কিন্তু পদ্মার আদেশে কালনাগের দংশনে লক্ষ্মীন্দরের মৃত্যু হয়।পদ্মপুরাণের এ কথাগুলো ঠোঁটস্থ করে ১০ বছর বয়সী বালক টিলার ওপরে বগলে একগাদা চটিবই নিয়ে পাখির সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে তার কাহিনী বর্ণনা করে যাচ্ছে। আপনি গেলে অবিভূত হয়ে একটি চটিবই ১০ টাকা দিয়ে না কিনে পারবেন না।
গোবিন্দ ভিটা : একেবারে মহাস্থানের দোরগোড়ায় জাদুঘরের বিপরীতে গোবিন্দভিটা। এর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে করতোয়া। করতোয়ার পূর্বকোণে এক গ্রাম বাঘপাড়া। সেখানে আরেক মন্দিরে দু’জন মুণি তপস্যায় ছিলেন বলে জায়গাটির নাম মুণিতলা বলেও পরিচিত।
জাদুঘর : মহাস্থানগড়ের এক পাশে গোবিন্দ ভিটা এবঙ অন্য পাশে বগুড়া প্রত্মতত্ত্ব জাদুঘর অবস্থিত। বেশ সুপরিসর। টিকিট কেটে জাদুঘরে সংরক্ষিত ৪৪টি শোকেসে কালের গর্ভে বিলীন হওয়া লুপ্তপ্রায় অলঙ্কারাদি, অস্ত্র-শস্ত্র, ছোট-বড় বিভিন্ন প্রকার মুদ্রা, হরেক রকমের দেব-দেবীর মূর্তি, দর্শনীয় ইট-পাথরসহ অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন। যেগুলো দেখে সহজেই অনুমান করা যায় মহানস্থানের মাটির নিচে কত অমূল্য সম্পদ এখনও পড়ে আছে।
খোজার ভিটা : মহাস্থানের প্রাচীর সংলগ্ন একটি ফুলবাগান আছে। পূজা-পার্বণে ফুল দরকার হতো বলে ফুলের বাগানের প্রয়োজন। আজ আর ফুল বাগানের চিহ্নমাত্রও নেই। ফুল বাগানের পাশেই বড় একটি পাথর বা শিবলিঙ্গ পড়ে আছে। এই জায়গাটির নাম খোজার ভিটা।
মানখালি : খোজার ভিটার উত্তর পাশে সুউচ্চ বাড়ির যে ভগ্নাবশেষ আছে তাই মানখালি। এ সম্পর্কে মানরাজার এক কাহিনী প্রচলিত আছে। এখন আর মানরাজা নেই বাড়িও খালি।তাই এ জায়গাটির নাম হয়েছে মানখালি।
পূজার বাড়ি : মানখালি থেকে কিছুদূর অগ্রসর হলে ১৭টি উঠান নিয়ে প্রকা বাড়ির যে ভগ্নস্তুপ চোখে পড়বে তাই পূজার বাড়ি। অসংখ্য ঘর এবং সেগুলোতে ৩৬০টি কক্ষ ছিল। প্রত্যেক কক্ষে এক একটি দেবতা ছিল বলে অনুমান করা হয়। প্রতিদিন নিত্যনতুন উপচারে পূজা দেয়া হতো। বাড়ির সামনেই জিউৎকু। এই কূপের জলে মরা মানুষ বাঁচিয়ে উঠত বলে ধারণা করা হয়। পূজার বাড়ি খননকরার সময় মস্তবড় দুটি কুঠুরী মেঝে পাকাসহ পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় এই দু’কুঠুরীতে বড় কোন মূর্তি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। আর বাকি কুঠুরীগুলো ছিল ক্ষুদ্রাকার।
জিউৎকুন্ড : পূজাবাড়ির পূর্ব পাশে বড় ইন্দারার নাম জিউৎকুন্ড। জাদুমন্ত্র বলে কূপের জলে মরা মানুষ বাঁচানোর শক্তি জন্মেছিল বলেই এই কূপের নাম জিউৎকুন্ড। কূপটির ব্যস ১৬ ফুট, গভীরতা ৪৫ ফুট। কূপের গায়ে দুই সারি পাথর, যেগুলো সিঁড়ির কাজ করত। কূপের এক পাশে বড় একটি পাথর করুকাজ করা। মনে হয় পাথরের উপরে উঠে জল তোলা হতো।
গোকুল : তোমাকে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে। হিন্দু ধর্মের মহাবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয় পশ্চিম ভারতের মথুরার রাজা কংসকে বধ করার জন্য। শ্রীকৃষ্ণ গোকুলে নন্দঘোষের ঘরে প্রতিপালিত হন। পরশুরাম পশ্চিম ভারতের দুটি তীর্থস্থানের অনুকরণে এই কৃত্রিম গোকুল ও মথুরার নামাকরণ করে বলে শোনা যায়। মহাস্থান থেকে এক মাইল দক্ষিণে গোকুল গ্রাম অবস্থিত।
বৈরাগীর বাড়ি : এই বাড়িতে পরশুরাম সুলতান (র:) কাছে ধরা পড়েছিলেন। বাড়িটি রাজবাড়ি ছিল বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু কি জন্য একে বৈরাগীর বাড়ি বলা হয় তা অনুমেয় নয়। সম্ভবত রাজা কর্তৃক মুনি, ঋষির বা বৈরাগীর সেবা এই বাড়িতে চলত বলেই এই বাড়ির নাম হয় বৈরাগীর বাড়ি।
ওঝা ধন্মন্তরীর বাড়ি : মহাস্থানগড় থেকে দূরে হরিপুর, হাজরা দীঘি ও রামশহর গ্রামের মিলনস্থানে উঁচু ভিটার উপর পাকা বাড়ি। বিশাল বাড়ির উঠান। বাড়ির দক্ষিণে পুকুর। পুকুর পাড়ে হাট। পুকুরের জলে ওঝার রথের শালকাঠের তক্তা আজও চোখে পড়ে। স্বাস্থ্যকর স্থান। ওঝা ধন্ম্ন্তরী মহারাজের রাজ চিকিৎসক ছিলেন বলেই এতবড় এবং সুন্দর বাড়ি। বাড়িতে দারুঘরা নামক ঔষধালয় ছিল।
ফাঁসিতলা : বহুদিনের পুরনো এক বটগাছ কালীদহের পশ্চিমে খালাস দীঘির পাড়ে। এখানে রাজ আমলের গুরতর অপরাধীকে ফাঁসিতে ঝুলানো হতো বলে এই জায়গার নাম ফাঁসিতলা।
এ রকম অনেক দর্শনীয় স্থান মহাস্থানের আশপাশে। হিন্দু সভ্যতার রাজধানী হলেও আজ আর প্রাচীর কীর্তির কোন মন্দিরের চিহ্নমাত্রও নেই ধ্বংসস্তুপ ছাড়া। হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে সেই ইট-পাথরেই মসজিদ, মাজার তৈরি হয়েছে। মহাস্থানগড়ের অসাধারণ নির্মাণ নৈপুণ্য দেখে মনে হয় সেকালে এমন সুরক্ষিত, সুদৃঢ় দুর্গ ভারতে কমই ছিল। ৭ দিনের সফর শেষে মহাস্থান থেকে ঘর সাজানোর জন্য নানা রকম কাঠের তৈরী জিনিস যেমন, ফ্লাওয়ার ভাজ, কলম, খেলনা, পুতুল মালাসহ অনেক দৃষ্টিনন্দন জিনিস কেনা যাবে এখান থেকে।