কলেজের গণ্ডিই পেরুতে না পারা স্টিভ জবস উদ্ভাবন করেছেন অ্যাপল কম্পিউটার, গান শোনার যন্ত্র আইপড, আইফোন, আইপ্যাডের মতো যুগান্তকারী সব জিনিস। একক ও যৌথভাবে ৩৪২টি পণ্যের পেটেন্ট আছে তাঁর। পুরোনাম স্টিভেন পল জবস। যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোক্তা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবকে পার্সোনাল কম্পিউটার বিপ্লবের পথিকৃৎ বলা হয়।
শৈশবে পথ চলা
স্টিভেন পল জবস ১৯৫৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের সান ফ্রান্সিসকোতে জন্মগ্রহণ করেন। অবিবাহিত মা-বাবা জোয়ান ক্যারোল এবং আবদুল ফাত্তাহ জান্দালি এর সন্তান স্টিভকে দত্তক নেন পল ও ক্লারা জবস। স্টিভ নামটিও তাঁদের দেওয়া। তিনি বেড়ে উঠেছেন এমন এক জায়গায়, যেটি পরবর্তী সময়ে বিশ্ব তথ্যপ্রযুক্তির তীর্থস্থান হয়ে ওঠে। জায়গাটি সিলিকন ভ্যালি। একটা সময় ক্যালিফোর্নিয়ার ওই স্থানটি ইলেকট্রনিক বর্জ্যের ভাগাড় ছিল। অনেক প্রকৌশলী তাঁদের গ্যারেজ গড়ে তুলেছিলেন সেখানে। জবস বোধ করি তাঁদের দেখেই উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। শৈশব কালেই ১৯৬৯ সালের দিকে স্টিফেন উজনিয়াক নামের এক তরুণের সঙ্গে পরিচয় হয় জবসের। ইলেকট্রনিকসের প্রতি দুজনের গভীর আগ্রহ থাকায় বয়সে তাঁর চেয়ে পাঁচ বছরের বড় উজের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে জবসের।
কলেজ থেকে ঝরে পড়া
স্টিভ জবস কুপারটিনো জুনিয়র হাই স্কুল এবং হোমস্টিড হাই স্কুলে পড়ার পর ১৯৭২ থ্রিস্টাব্দে তিনি হাই স্কুল শেষ করেন এবং রীড কলেজ়ে ভর্তি হন। কিন্তু রিড লিবারেল আর্টসের ওপর বেশ ব্যয়বহুল একটি কলেজ ছিল। অসচ্ছল পল-ক্লারা দম্পতির পক্ষে সেই ব্যয়ভার বহন করা কষ্টকর ছিল। জবসের জন্মদাত্রী মাকে তাঁরা কথা দিয়েছিলেন, ছেলেটাকে ভালো কোথাও পড়াবেন। সেই কথা রক্ষা করতে রিড কলেজেই ভর্তি করালেন জবসকে। কিন্তু এক সেমিস্টারের বেশি আর এগোতে পারেননি জবস। ঝরে পড়েন। যদিও তিনি পরবর্তীতে কলেজ ছেড়ে দেন তার পরেও তিনি ক্যালিগ্রাফীসহ আরো কিছু ক্লাসে যোগদান করেছিলেন। এই সম্পর্কে তার বক্তব্য ছিল "যদি আমি ওই কোর্সে না যেতাম তবে ম্যাকের কখনোই বিভিন্ন টাইপফেস বা সামঞ্জস্যপূর্ণ ফন্টগুলো থাকতো না।"
ঘর ছেড়ে আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন
১৯৭৪ সালে জবস ক্যালির্ফোনিয়াতে পুনরায় চলে আসেন। এ সময় তিনি নিয়মিত স্টিফেন উজনিয়াকের সাথে হোমব্রিউ কম্পিউটার ক্লাবের সভাগুলোতে উপস্থিত থাকতেন এবং ভিডিও গেমস নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আটারিতে টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি এসময় মূলত ভারতে যাবার জন্য অর্থ জমানোর চেষ্টা করছিলেন। আর তাই আলোকিত জীবন গড়তে মাত্র ১৯ বছর বয়সে ঘর ছেড়েছিলেন স্টিভ জবস। চলে এসেছিলেন ভারতে।
জবস ভারতে নিম কারোলি বাবার সাথে সাক্ষাত করার জন্য রিড কলেজের বন্ধু ড্যানিয়েল কোটকেকে সাথে নিয়ে কৈঞ্চি আশ্রমে যান। কিন্তু তা প্রায় জনশূন্য অবস্থায় ছিল, কারণ নিম কারোলি বাবা ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে মারা যান। এরপর তারা চলে যান হরিয়াখান বাবার আশ্রমে। ভারতে তারা কয়েকবার বাস ভ্রমণ করেন। দিল্লি থেকে উত্তর প্রদেশ, সেখান থেকে ফিরে হিমাচল প্রদেশ এরপর পুনরায় দিল্লি ফিরে আসেন। সাত মাস অবস্থানের পর জবস ভারত ত্যাগ করেন। ভারত থেকে ফেরার পর জবসের নতুন আবির্ভাব ঘটে। তার মস্তক মুন্ডিত ছিল এবং তিনি ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় পোশাক পরিহিত অবস্থায় ছিলেন। এছাড়া তিনি বৌদ্ধধর্মের অনুসারি হয়ে ওঠেন। রপ্ত করেছিলেন ভিন্ন ধারার জীবনযাপন। রীতিমতো উপবাস করতেন। ফলমূল খেয়ে কাটিয়ে দিতেন দিনের পর দিন। সেই থেকেই ভগ্নস্বাস্থ্য তাঁকে অধিকার করে বসেছিল কি না জানা যায়নি।
অ্যাপলের যাত্রা
আধ্যত্মিক জ্ঞান অর্জন শেষে আবারও সিলিকন ভ্যালির ইলেকট্রনিক বর্জ্যের ভাগাড়ে ফিরে এলেন জবস। বন্ধু উজের সঙ্গে কম্পিউটার বোর্ড বানানোর কাজ শুরু করলেন। আশপাশের অনেকে সার্কিট বোর্ডটি বেশ পছন্দ করল। এরপর আর্কেড ভিডিও গেম ব্রেকআউটের জন্য সার্কিট বোর্ড তৈরির কাছে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। প্রত্যেক চিপের জন্য $১০০ দেওয়ার প্রস্তাব দেয় অ্যাটারি। সার্কিট বোর্ড ডিজাইনে জবসের একটু বিশেষ জ্ঞান ছিল এবং তিনি ওজনিয়াকের সাথে সমানভাবে ফি ভাগ করে নেওয়ার চুক্তি করেন কিন্তু ওজনিয়াকের সাথে একটা শর্ত ছিল। আর তা হলো চিপের সংখ্যা কমাতে হবে। অ্যাটারি ইঞ্জিনিয়ারদের বিস্মিত করে ওজনিয়াক চিপের সংখ্যা ৫০-এ নামিয়ে আনেন। ডিজাইন এতটাই দূর্ভেদ্য ছিল যে অ্যাসেম্বলি লাইন নকল করা প্রায় অসম্ভব ছিল। অ্যাটারি প্রস্তাবিত $৫,০০০ এর পরিবর্তে তাদেরকে মাত্র $৭০০ দিয়েছিল।
এরপর টেলিফোন নেটওয়ার্ককে নিপূনভাবে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় টোন উত্পএন্ন করতে ওজনিয়াক একটি কম খরচের “ব্লু বক্স” তৈরি করেন। এতে দীর্ঘ দূরত্বের টেলিফোন কল বিনামূল্যে করা যেত। জবস সিদ্ধান্ত নেন যে তারা এটি বিক্রয় করে অর্থ উপার্জন করতে পারেন। এই অবৈধ ব্লু বক্সের চোরাগোপ্তা বানিজ্য ভালই চলে এবং এটি জবসের মনে বীজ বুনে দেয় যে ইলেকট্রনিক্সের ব্যবহার মজাদার এবং লাভজনক হতে পারে। এটি তাদেরকে দেখিয়েছিল যে কিভাবে বড় কোম্পানিগুলোকে হারিয়ে দিতে পারে।
স্টিভ জবস এবং ওজনিয়াক এর কম খরচের “ব্লু বক্স” তৈরি
১৯৭৫ সালে, জবস ওজনিয়াকের সাথে হোমব্রিউ কম্পিউটার ক্লাবের সভায় নিয়মিত উপস্থিত হতে শুরু করেন। তিনি এডুইন এইচ. ল্যান্ডের ব্যাপক প্রশংসা করেন, যিনি ইন্সট্যান্ট ফটোগ্রাফির উদ্ভাবক এবং পোলারইড কর্পোরেশনের প্রতিষ্ঠাতা। সার্কিট বোর্ড ডিজাইন এবং ব্লু বক্স সাফল্যের পর ১৯৭৬ সালে জবস এবং ওজনিয়াক নিজেদের ব্যবসা শুরু করেন। তারা তাদের কোম্পানির নাম দেন “অ্যাপল কম্পিউটার কোম্পানি”। প্রথম দিকে সার্কিট বোর্ড বিক্রয়ের মাধ্যমে তারা এই কোম্পানি চালু করেন।
অ্যাপল কম্পিউটার বিক্রি শুরু
১৯৭৬ সালে ওজনিয়াক একক প্রচেষ্টায় অ্যাপল-১ কম্পিউটার উদ্ভাবন করেন। ওজনিয়াক কম্পিউটারটি জবসকে দেখালে, জবস তা বিক্রয় করার পরামর্শ দেন। তখন তারা এটিকে বিক্রয়ের জন্য রোনাল্ড ওয়েনকে সাথে নিয়ে জবসের গ্যারেজে অ্যাপল কম্পিউটার প্রতিষ্ঠা করেন। এ বছরই ৬৬৬.৬৬ ডলারে অ্যাপল ১ কম্পিউটার বিক্রি শুরু হয়। ওয়েন অল্প কিছু দিন ছিলেন। অতঃপর তিনি জবস এবং ওজনিয়াককে ছেড়ে চলে যান। তিনি ছিলেন অ্যাপলের প্রাথমিক সহ-প্রতিষ্ঠাতা।
ওয়েন চলে যাওয়ার পরও জবসের উৎসাহে উজ কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ তৈরি ও অ্যাসম্বলিংয়ে মন দিলেন। ১৯৭৭ সালের কিছুদিনের মধ্যেই অ্যাপল-১ এর চেয়ে উন্নতমানের একটা কম্পিউটার তৈরি করে ফেলেন। নাম দেওয়া হয় ‘অ্যাপল-২’। দুই বন্ধু আঁচ করতে পারলেন, অ্যাপল-২ বাজারের যেকোনো কম্পিউটারের চেয়ে গুণে-মানে সেরা হবে। হলোও তা-ই। কিন্তু ব্যবসা করতে হলে মূলধন লাগবে। আর তাই তারা ইন্টেলের তত্কানলীন সাবেক পন্য বিপণন ব্যবস্থাপক মাইক মার্ককুলা এর কাছে যান অর্থ প্রাপ্তির আশায়। মাইক মার্ককুলা তাদের কর্মকাণ্ডের গুরুপ্ত বুজতে দেরি করেননি। এই দুই হীরার টুকরা বন্ধুকে ঠিকই চিনলেন প্রসেসর নির্মাতা ইন্টেল করপোরেশনের সাবেক এই কর্মকর্তা। প্রতিভাবান বন্ধুদ্বয়কে আড়াই লাখ ডলার পুঁজি দিলেন। এর ফলে ১৯৭৭ সালের ৫ জুন প্লাস্টিক কেসে রঙিন মনিটর সমৃদ্ধ অ্যাপল টু বাজারে আসে। দেখতে দেখতে দুই বছরের মাথায় ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেল। বিশ্বজুড়ে তখন পার্সোনাল কম্পিউটার কেনার হিড়িক। সেই জোয়ারে ১ নম্বর কাতারে সবার পছন্দের তালিকায় উঠে এল অ্যাপল-২। ব্যবসা রমরমা হয়ে উঠল। ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরের দিকে স্টিভ জবসের সম্পদের পরিমাণ ২০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেল। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৫।
পূজিবাজারে আত্মপ্রকাশ
অ্যাপল-২ এর সাফল্যের পর জবস নতুন নতুন পণ্য তৈরির চিন্তা করতে থাকেন এবং তার প্রতিষ্ঠানের জন্য যোগ্য লোক খুঁজতে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় ইন্টেল কর্মকর্তা জে এলিয়ট এর সাথে এক আকর্ষিক সাক্ষাত হয় জবসের। সেই সময় ঈগল কম্পিউটার নামে একটি প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য ইন্টেল ত্যাগ করা জে এলিয়ট বসে বসে নিজের দূর্ভাগ্যের কথা পত্রিকায় পড়ছিল। কারণ ঠিক সেই সময় ঈগল কম্পিউটারের মৃত্যুর খবর পত্রিকায় প্রকাশ হয়। তখন তার সাথে ২৫ বছর বয়সী তরুণ জবসের পরিচয় হয়। তাদের আলাপের মাঝখানে তারা দু’জন আবিস্কার করে দুজনেরই দাড়ি আছ আর দুজনেই কম্পিউটার পছন্দ করে। জবস নিজের অ্যাপল কম্পিউটার কোম্পানির কথা জে এলিয়ট কে বলেন যেখানে জবস এই তরুণ বয়সেই কোম্পানির বোর্ড চেয়ারম্যান। জে তখনো সেভাবে অ্যাপলের নাম শোনেনি। শোনার কথাও নয়। কাজেই ২৫ বছর বয়সী জবসের কোম্পানি নিয়ে তেমন আগ্রহও তার হয়নি। অন্যদিকে জবস দেখেছে ৪৪ বছর জে'র মধ্যে এমন কিছু আছে যা সে খুঁজছে কিছু দিন ধরে। জে’র কাছ থেকে জেনেছে সে নতুন কিছু করতে আগ্রহী এবং আইবিএমের ধীরে চলা নীতি তার পছন্দ নয়। কাজেই জবস জে কে অ্যাপলে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। জে বিনীত ভাবে জানায়, “আমাকে এফোর্ড করা তোমাদের দ্বারা সম্ভব নয়।" এই ঘটনার মাত্র কয়েকদিন পরে পূজিবাজারে আত্মপ্রকাশ করে অ্যাপল। অ্যাপলের বাজার মূল্য হয় ২৫০ মিলিয়ন ডলার। কোম্পানি আর জবসের পক্ষে জে এলিয়ট কে কেনা সম্ভব হয়। দুই সপ্তাহ পরের শুক্রবারে জে এলিয়ট অ্যাপলে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন।
অন্যান্যদের সঙ্গে জবসের পার্থক্য
পূজিবাজারে আত্মপ্রকাশ করার পর এপলের কর্মচারীদের বেতন সামান্য বাড়ে। ইন্টেলের কর্মকর্তারা বলেন যে- “অ্যাপল কোথাও যাবে না। তুমি একটা মস্ত বড় ভুল করছো"। কম্পিউটার জগতের অন্যান্যদের সঙ্গে জবসের পার্থক্য তার শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত নিশ্চুপ থাকা। কাজের মাধ্যমেই অন্যের জবাব দেয়া। নিশ্চুপ জবসের মাথায় সব সময় নতুন নতুন প্রযুক্তি খেলা করত। আর তাই জবস পিএআরসি, জেরক্সের রিসার্চ সেন্টারে এমন কিছু বানানোর চেষ্টা করছিলো যা পরে মাউস নামে পরিচিত হয়। সে সময় পিএআরসি এমন মেইন ফ্রেম কম্পিউটার ডিজাইন করার চেষ্টা করছিল যার দাম হবে দশ থেকে বিশ হাজার ডলার। কারণ আইবিএমের সঙ্গে লড়তে হবে। তবে স্টিভের মাথায় আর্থিক লাভের কথা ছিল না। তার মাথায় ছিল “ সবার জন্য কম্পিউটার”।
মহা ত্যাদোর জবস
জবসের একটি বড় বাহাদুরী হচ্ছে তিনি তার কোম্পানিতে লোককে ধরে রাখতে পারেন। তখন অ্যাপল থেকে লোক চলে যাওয়ার হার ছিল মাত্র ৩%, যা সবচেয়ে কম। অথচ জবস কিন্তু মহা ত্যাদোর লোক। সে সময় অ্যাপল টু বাজারে চলছিলো। গবেষণা হচ্ছে লিসা নামে একটি প্রজেক্টের। সেটি হবে পরের অ্যাপল। জবসের নিত্যনতুন চাহিদায় অতিষ্ঠ হয়ে একদিন সেই প্রোডাক্টের প্রজেক্ট ম্যানেজার সরাসরি স্টিভকে বলে দিল, “আপনি এখানে না আসলেই আমি খুশি হবো?” নিজের কোম্পানিতে কেউ তাকে পাত্তা দেয় না, ইঞ্জিনিয়াররা তার কথা শুনে না। অন্য যে কেউ হলে খুবই হতাশ হয়ে পড়তো, তাই না। কিন্তু জবস হতাশ হতেন না। কারণ এরা সবাই জবস এর নিজের বাছাই করা লোক এবং জবসের নতুন নতুন পরিকল্পনার বাস্তবায়নের হাতিয়ার। জবস ঠিকই তাদের কাছ থেকে কাজ আদায় করে নিতেন।