Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.
Travel Image

সোনারগাঁয়ের পানাম সিটিই আমাদের ব্যাবিলন



পানামনগর গৌরবোজ্জ্বল একটি অতি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক জনপদের নাম। এ জনপদটি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ পৌরসভা এলাকার বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের কাছে অবস্থিত। স্মৃতি-বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া এক নগরীর নাম কেবলই পানাম। লোনা ইট, কালো পাথরের টেরাকোটা ধূসর স্মৃতি এখনও ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পানাম ও তার আশপাশের গ্রামগুলোতে। নাচঘরে এখন আর নাচে না নর্তকী। বাজে না নর্তকীর পায়ের ঘুঙুর। দরবার ঘরে বসে না মানুষের মেলা। বণিক-পর্যটকদের সারি সারি ডিঙি নোঙর ফেলে না পানাম নগরীর ঘাটে। মেতে ওঠে না কেনাবেচার বর্ণিল উৎসব। ধন-দৌলতে ভরে ওঠে না খাজাঞ্চিখানা। হারিয়ে গেছে এ নগরীর জীবনের সব বর্ণাঢ্য আয়োজন, ভেঙে গেছে আলোময় জীবনের সাজানো সব খেলাঘর। থেমে গেছে প্রাণের প্রবাহ। শত শত বছরের অনাদর আর অবহেলার চিহ্ন গায়ে মেখে আজও দাঁড়িয়ে আছে ধ্বংসাবশেষ অট্টালিকাগুলো। সোনালি অতীতের সাক্ষী এসব অট্টালিকা এখনও নজর কাড়ে ভ্রমণপিয়াসী দেশী-বিদেশী পর্যটকদের।

১২৮১ খ্রিস্টাব্দ থেকে সোনারগাঁয়ে মুসলিম আধিপত্যের সূচনা হয়। ফখরউদ্দীন মুবারক শাহের সময় বা স্বাধীন সুলতানি আমলে সোনারগাঁ বাংলার রাজধানী হিসেবে মর্যাদা লাভ করে। তারপর পর্যায়ক্রমে শামসউদ্দীন ইলিয়াস শাহ, সিকান্দার শাহ, গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ, শামসুদ্দীন হামজা শাহসহ আরও অনেক শাসক শাসনকার্য পরিচালনা করে বাংলার ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করেন। তবে বার ভূঁইয়ার প্রধান ঈশা খাঁর সময় বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে সোনারগাঁ বিশেষ স্থান দখল করে আছে। সে সময় শাসকদের রাজকার্য পরিচালিত হতো পানাম নগরী থেকে। এর পাশাপাশি রাজাদের আমির-ওমরাহদের জন্য পানাম নগরী ও তার আশপাশের গ্রামগুলোতে গড়ে উঠেছিল নিপুণ কারুকাজ খচিত পাকা ইমারতরাজি।

স্মৃতির শহর পানামকে ঘিরে আছে প্রাচীন নগর ও রাজধানীকেন্দ্রিক নস্টালজিক স্মৃতি। যে স্মৃতির বেশির ভাগই কালের করাল গ্রাসে লুপ্ত আজ। ভগ্ন ইমারতের পুরা পলেস্তরা ঘন শ্যাওলার আবরণে অতীতের গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি আজ ঢাকা পড়ে আছে। কারণ পানাম সম্পর্কিত লিখিত তথ্যপঞ্জির খুব অভাব। হয়তো কিছু প্রমাণপঞ্জি ছিল, সেগুলো লোকচক্ষুর অন্তরালে এখনও রয়ে গেছে। বিস্ময়ের বিষয়, সোনারগাঁয়ের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে গ্রন্থ লেখা হলেও পানামনগর অবহেলিতই রয়ে গেছে। এখন প্রশ্ন হল, সোনারগাঁয়ের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে পানামের ইতিহাস স্থাপত্য কতটুকু গুরুত্ব বহন করে, সেটাই বিবেচ্য বিষয়। তবে এ কথা ঠিক, পানাম ও তার আশপাশকে ঘিরে পঞ্চদশ শতক থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত এক সমৃদ্ধ জনজীবন ছিল। এসব সমৃদ্ধ জনজীবনের ধারাপর্বেই পানামে গড়ে উঠেছিল এক সমৃদ্ধ ও নান্দনিক জীবনযাত্রা। যে জীবনযাত্রার নান্দনিকতার কারিশমার রেশ এখনও কিছুটা টিকে আছে ধ্বংসপ্রাপ্ত পানামনগর এবং তার আশপাশের গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খণ্ড খণ্ড নিদর্শনে।

পানামে পরিলক্ষিত হয় নিপুণ কারুকাজ খচিত অসংখ্য প্রাচীন ইমারতরাজি। এখানে সরু রাস্তার দুই ধারে গড়ে উঠেছিল অট্টালিকা, সরাইখানা, মসজিদ, মন্দির, মঠ, ঠাকুরঘর, গোসলখানা, কূপ, নাচঘর, খাজাঞ্চিখানা, টাঁকশাল, দরবারকক্ষ, গুপ্তপথ, প্রশস্ত দেয়াল, প্রমোদালয় ইত্যাদি। পানাম নগরীতে দেখা যায় ৪০০ বছরে পুরনো মঠবাড়ি। এর পশ্চিমে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যকুঠি (নীলকুঠি)। রয়েছে পোদ্দারবাড়ি, কাশিনাথের বাড়ি, আর্টগ্যালারিসহ নানা প্রাচীন ভবন। তবে অধিকাংশ রয়েছে জীর্ণ, ভগ্নাবস্থায়। পানামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পঙ্খীরাজ খাল। এ খাল পানামের গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলো ছুঁয়ে পুবদিকে মেনিখালি নদ হয়ে মেঘনা নদীতে মিশেছে। খালের ওপর আদমপুর বাজারের কাছে রয়েছে মোগল আমলের সেতু (পঙ্খীরাজ সেতু)। তিনটি খিলানের ওপর নির্মিত এ সেতু ১৪ ফুট প্রশস্ত। তলদেশ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ২৮ ফুট এবং দৈর্ঘ্য ১৭৩ ফুট। এ সেতুটি কে কখন নির্মাণ করেন তার কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। শেরশাহের আমলে নির্মিত সোনারগাঁ থেকে সিন্ধু পর্যন্ত প্রায় ৩০০ মাইলের ঐতিহাসিক গ্র্যান্ড ট্রাংক রোডের কিছু অস্তিত্ব পানামে আজও দৃষ্ট হয় বলে হাল আমলে তা পাকা করা হয়েছে।

শুধু বর্ণাঢ্য অনুপম স্থাপত্য ইমারতরাজির জন্য পানাম বিখ্যাত নয়, পানামের সামগ্রিক গুরুত্ব কিন্তু অন্য কারণে। চতুর্দশ শতকে পানাম ও তার আশপাশের গ্রামগুলোতে বিকশিত হয়েছিল এক সমৃদ্ধ চারুকারুকলাজাত শিল্পের। যে শিল্পের কারণে পানামের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল এ উপমহাদেশ ছাড়িয়েও পাশ্চাত্যে। বিশ্বখ্যাত মসলিনের আদিস্থান ছিল সোনারগাঁয়। পানাম নগরী ছিল মসলিনের বিশাল আড়ং। পৃথিবীখ্যাত মসলিন শবনম, মলমুলখাস, আব-ই-রওয়া উৎপাদিত হতো পানাম নগরের আশপাশ ঘিরেই। জেমস টেলরের মতে, আড়ংয়ের তাঁতখানা সোনারগাঁয়ের পানাম নামক স্থানে ছিল এবং মসলিন শিল্প কেনাবেচার এক প্রসিদ্ধ বাজার ছিল এই পানাম নামক স্থানটি। ৫ মিটার প্রশস্ত ও ৬০০ মিটার দীর্ঘ একটি সড়কের দুই পাশে এক তলা, দোতলা ও তিনতলা দালান রয়েছে পানামে। প্রায় ৫২টি ভবন রয়েছে। অবশ্য এর বেশির ভাগই ধ্বংসপ্রাপ্ত। সম্প্রতি এ নগরীকে সরকারের প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের আওতায় আনা হয়েছে।

পানামের সব ভবনের অসংখ্য কক্ষের ইট ধসে পড়ছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে কারুকাজগুলো। তবুও কোনভাবে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অবকাঠামোগুলো। ভুতুড়ে পানামনগরের ভবনগুলোর অন্ধকার কক্ষে একাকী দাঁড়ালে ভয়ে গা শিউরে ওঠে। ভবনের অবকাঠামোগুলো মনে করিয়ে দেয় সে সময়ের বর্ণিল সব আয়োজন। প্রতিটি ইটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা অজানা ইতিহাস। সোনারগাঁয়ের পানাম এখন সিটি অব ব্যাবিলন।