Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.
Sports Image

এক ক্ষণজন্মার গল্প



ব্রাজিল ফুটবলের জীবন্ত কিংবদন্তী পেলে কে তো সবাই চিনেন। তাকেই ধরা হয় ব্রাজিলের সর্বকালের সেরা ফুটবলার। কিন্তু ব্রাজিল ফুটবলের দ্বিতীয় সেরা ফুটবলারের নাম কি? অনেকেই হয়তো রোমারিও, রোনাল্ডো এমনকি নেইমারের নাম উচ্চারণ করতে পারেন! তবে সেই ব্যাক্তিটির নাম গ্যারিঞ্চা। তাকে বলা হয়ে থাকে সর্বকালের সেরা ড্রিবলার। কিন্তু কাগজ কলমে তিনি ছিলেন বিকলাঙ্গ! তাঁর সময়ে পেলের চেয়েও অনেক বেশি জনপ্রিয় গারিঞ্চা আর তার বাঁকানো পায়ের জাদুর জন্য পেয়েছিলেন ‘অ্যাঞ্জেল উইথ দ্য বেন্ট লেগস’ উপাধি। বিখ্যাত ‘ব্যানানা শট’ দিয়ে কর্নার থেকেও সরাসরি গোল করেছেন গারিঞ্চা!

মাতাল বাবার ঘরে জন্ম নেওয়া গারিঞ্চার গঠন অন্যরকম। তার ডান পা কিছুটা বাইরের দিকে বাকানো ছিল আর বাঁ পা ডান পায়ের তুলনায় ছয় সেন্টিমিটার ছোট ছিল, কিছুটা ভেতরের দিকে বাঁকানো ছিল। অবাক লাগার মতো বিষয়, কাগজে কলমে তিনি ঠিকমতো হাটতেও পারার কথা নায়। কিন্তু বিধাতা কাউকে খালি হাতে পৃথিবীতে পাঠান না। তাইতো জীববিজ্ঞানকে পাশ কাটিয়ে খাটো ও বিকৃত গড়নের মানুষটি পায়ের জাদুতে যা করে দেখিয়েছিলেন তার ধারে কাছেও কেউ যেতে পারেনি আজ অবধি।

জানেন কি গ্যারিঞ্চা নামটা কোথা থেকে এসেছে? এই পর্তুগীজ শব্দটির মানে ক্ষুদ্রকায় পাখি। বয়সের তুলনায় ছোটখাটো গড়নের ভাইটিকে আদর করে ‘গ্যারিঞ্চা’ এই নামে ডাকতেন তার বোন।

বাঁকানো পায়ের পাতা আর এক পায়ের চেয়ে প্রায় ছয় সেন্টিমিটার ছোট আরেকটি পা নিয়ে জন্মেছিলেন। কিন্তু কিংবদন্তি ফুটবলার হওয়া তাঁর নিয়তি নির্ধারিতই ছিল। কোনো বাধাই তাই শেষ পর্যন্ত বাধা হয়ে উঠতে পারেনি। ১৯৫৪ বিশ্বকাপ আসতে আসতে পেশাদার ফুটবলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন তিনি। ক্লাব বোটাফোগোর হয়ে চমত্কার খেলছিলেন। কিন্তু একই পজিশনে খেলা জুলিনহো বা প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য ফুটবলের কারণে ১৯৫৪ বিশ্বকাপে শেষ পর্যন্ত ডাক পাননি গারিঞ্চা। এই ক্ষতি পুষিয়ে দিতেই যেন ১৯৫৮ এবং ১৯৬২ পর পর দুটি বিশ্বকাপ জয় করেন গারিঞ্চা। ১৯৩৪ ও ১৯৩৮-এর ইতালির পর দ্বিতীয় দল হিসেবে গারিঞ্চার ব্রাজিল জয় করে টানা দুটি বিশ্বকাপ।

অভিষেক ম্যাচের এক মিনিটের কম সময়ের মধ্যেই গারিঞ্চা বিপক্ষ দলের তিনজন খেলোয়াড় কাটিয়ে যে শটটি নেন তা পোস্টে লেগে ফিরে আসে। এক মুহূর্ত পরেই গারিঞ্চার বাড়িয়ে দেওয়া বল থেকে পেলের দুর্দান্ত শটটিও ফিরে আসে ক্রসবারে লেগে। গারিঞ্চা এর পরও একের পর এক ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন বিপক্ষের রক্ষণভাগকে। গারিঞ্চার অভিষেক ম্যাচের প্রথম তিন মিনিটকে বলা হয়ে থাকে ‘দি গ্রেটেস্ট থ্রি মিনিটস ইন ফুটবল হিস্ট্রি’।

শুধু প্রথম ম্যাচেই নয়, বিশ্বকাপের বাকি ম্যাচগুলোতেও একইভাবে প্রতিপক্ষের ঘুম হারাম করে ছাড়েন গারিঞ্চা। ফাইনালে সুইডেনের সঙ্গে ১-০-তে পিছিয়ে থেকেও ব্রাজিল ২-১-এ জেতে। গারিঞ্চার বাড়িয়ে দেওয়া বল থেকেই গোল দুটি করেন ভাভা। প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে এসেই বিশ্বকাপ জয় করেন গারিঞ্চা। ব্রাজিলও জেতে তাদের প্রথম বিশ্বকাপ শিরোপা, শুরু হয় বিশ্বকাপে ব্রাজিলের সাফল্যগাথার।

১৯৫৮-এর বিশ্বকাপে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে ব্রাজিলের হয়ে দুজন খেলোয়াড়ের বিশ্বকাপ অভিষেক হয়। একজনের নাম পেলে, অন্যজন পেলের চেয়ে সাত বছরের বড় গারিঞ্চা। ব্রাজিলের ফুটবল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ দুই সন্তান। বরং কেউ কেউ মনে করেন, অসাধারণ ড্রিবলিং, দুরন্ত গতি, দুই পায়ের সমান দক্ষতা, জোরালো শট সব মিলিয়ে পেলের চেয়ে অনেক বেশি ক্যারিশম্যাটিক ছিলেন গারিঞ্চা। গারিঞ্চা এবং পেলে একই সঙ্গে খেলেছেন এমন ম্যাচে কেউ কখনো হারাতে পারেনি ব্রাজিলকে।

তবে গারিঞ্চা তাঁর সেরাটা জমিয়ে রেখেছিলেন ১৯৬২ চিলি বিশ্বকাপের জন্য। সেবার দ্বিতীয় ম্যাচেই ইনজুরির কারণে পেলে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়ায় গারিঞ্চার কাঁধে নতুন দায়িত্ব বর্তায়। কেবল গোল করালেই চলবে না, গোল করতেও হবে। বলাবাহুল্য দক্ষতার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করেন গারিঞ্চা। বিশেষত ইংল্যান্ড ও স্বাগতিক চিলির বিপক্ষে ম্যাচ দুটিতে অসাধারণ খেলেন। ৪ গোল করেন সেই দুই ম্যাচে। পুরো আসরে ভাভা, আমারিলদোদের দিয়ে করান একের পর এক গোল। চেকোস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে ফাইনালে প্রচণ্ড জ্বর নিয়েও খেলা চালিয়ে যান গারিঞ্চা। ব্রাজিলকে টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জিতিয়েই মাঠ ছাড়েন। বিশ্বকাপ শিরোপার পাশাপাশি জিতে নেন আসরের সেরা খেলোয়াড়ের গোল্ডেন বল এবং সর্বোচ্চ গোলদাতার গোল্ডেন বুটও।

১৯৬৬-তে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপেও খেলতে গিয়েছিলেন। গোড়ালির ইনজুরিতে ভুগতে থাকা গারিঞ্চা তবুও প্রথম দুটি ম্যাচে খেলেন। বুলগেরিয়ার সঙ্গে ২-০ গোলে জেতা ম্যাচটিতে গোলও করেন একটি। কিন্তু পরের ম্যাচেই হাঙ্গেরির সঙ্গে ব্রাজিল ৩-১ গোলে হারে। ব্রাজিলের তৃতীয় ম্যাচটিতে মাঠে না নামায় হাঙ্গেরির সঙ্গে ম্যাচটিই হয়ে যায় গারিঞ্চার শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ।

গ্যারিঞ্চা বেশিদিন খেলতে পারেননি হলুদ জার্সি গায়ে। ১৯৬৬ তেই শেষ হয়ে যায় তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। ততদিনে তিনি ৫০ ম্যাচ খেলে জাতীয় দলের হয়ে গোল করেছেন ১২টি। গোলের হিসাবে গ্যারিঞ্চাকে বিচার করতে যাওয়া হবে ভুল। দীর্ঘ সময় না খেলেও ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে কিংবদন্তির মর্যাদা পেয়েছেন এই ক্ষণজন্মা। পেলে এবং গ্যারিঞ্চার দারুণ একটা রেকর্ড আছে। এ দুজন একসঙ্গে মাঠে থাকতে ব্রাজিল কোনো ম্যাচে কখনো হারেনি। ৫০ ম্যাচ খেলে মাত্র একটিতেই পরাজিত হন, সেটি তার শেষ ম্যাচেই।

গ্যারিঞ্চা ১৯৭২ সালে সব ধরনের ফুটবলকে বিদায় জানান। তখন তিনি খেলতেন ব্রাজিলিয়ান ক্লাব অলেরিয়া অ্যাটলেটিকোতে। ফুটবলকে বিদায় জানানোর পর খুব বেশিদিন পৃথিবীতে থাকেনিন এই ক্ষুদে পাখি। ফুটবল ছাড়ার পর থেকেই তার জীবনধারা সম্পূর্ণ বদলে যায়। মদ্যপ হিসেবে বেশ নাম কামান তিনি।বেশ কয়েকবার দুর্ঘটনার কবলে পড়েছেন, জীবনের শেষ পর্যায়ে অতিরিক্ত মদ পান করায় লিভার নষ্ট হয়ে গিয়েছিল গ্যারিঞ্চার। এ রোগেই মাত্র ৪৯ বছর বয়সে তিনি পৃথিবীর সব মায়া ত্যাগ করেন। ১৯৮৩ সালের ২০ জানুয়ারি তিনি মৃত্যু বরণ করেন।