Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.
Travel Image

বাঁশ-বেতের তীক্ষ্ণ ফলার কারুশিল্প



অপরুপ সৌন্দর্যে মহিমান্বিত আমাদের এই বাংলাদেশ। চারদিকে সবুজের সমারোহ, বয়ে যাওয়া নদীর কলতান, পাখির কলকাকলী পাহাড়-পর্বত সব কিছু মিলিয়ে প্রকৃতি অপার এক মহিমা বিরাজ করছে আামাদের এইভূ-খন্ডে । প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে বিভিন্ন জাতি- গোষ্ঠি বাস করছে এই ব-দ্বীপে। বর্ণ,ধর্ম,জাতি এবং উপজাতির পরিচয়ের উর্ধ্বে ওঠে এসে ভ্রাতৃত্বপুর্ন সহাবস্থানে নজির আমাদের ইতিহাসকে করেছে গৌরবান্বিত। আমাদেরইএটি ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠির নাম ঋষি সম্প্রদায়। তারা আমাদের সমাজ এবং দেশেরই একটি সম্প্রদায় হলেও তাদেরকে নাগরিক উন্নয়নের ছোয়া র্স্পশ করেছে কমই। যে কারনে তারা অবহেলিত এবং অসহায় একটি সম্প্রদায়ে রুপ নিয়েছে। মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার ৮-১০ কিঃমিঃ উওর পশ্চিমে খালিয়া গ্রাম ব্রিটিশ আমলের প্রতিবাদী কবি কিরণ চাদ দরবেশ এর জম্মস্থান এখানে। এখানে ঋষি সম্প্রদায়ের প্রায় ২৫-৩০টি পরিবার বাস করে । কবি কিরন চাদ দরবেশের অনেক লেখনিতেও ঋষি সম্প্রদায়ের কথা আছে। খালিয়া, শংকদী গ্রাম ছাড়াও গোপলগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলায় ঋষি সমপ্রদায়ের কিছু পরিবারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ঋষি সম্প্রদায়ের লোকদের নিচু বর্ণের হিন্দু জাতি বলে আবার কেউ এদের উপজাতিও বলে । ঋষিদের মতে তারা হিন্দু ধর্মের একটি জাতি। নিজেদেরকে ক্ষতিয় বলে দাবী করেন। ক্ষতিয় মানে যোদ্ধা । কথিত আছে আগের দিনের ঋষিরা সাহসী যোদ্ধা । ঋষিদের নামের শেষে সিং,দাস, রায়, বিশ্বাস উপাধি দেয়া হয়। তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি আচার অনুষ্ঠান হিন্দুদের মতোই। ঋষিরা নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাষার অধিকারী । তাদের ধর্মীয় আচার- অনুষ্ঠানে রয়েছে নিজস্ব স্বকীয়তা। সনাতন ধর্মাবলম্বী । পূজা-পর্বন নিজেদের রীতি বা পশ্চিমা রীতিতে করে থাকে। বড় উৎসব দুর্গাপুজা । এছাড়া। এছাড়া দীপাবলী বা কালীপূজায় অনেক আনন্দ করে থাকে তারদের বাড়ীতে মন্দিরও আছে । বাংলাদেশি হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায় যেমন কলাগাছ পুতে সাতপাক অবশ্যই ঘুরতে হয় । গোত্র ভিওিক বিবাহ হয় । এক গোত্র বা গোষ্ঠি অন্য বিবাহ নেয় না, দেয় না । পরিবারের প্রধানরা বর- কনে পছন্দ করে । বিয়েতে মন্ত্রপাঠ হয় । পুরহিত বা তাদের ভাষায় নিম্ম শ্রেনী ব্রাম্মন মন্ত্র পাঠ করে। বিয়ের দিনক্ষন ব্রাম্মণ পাজি পুঁথি দেখে নির্ধারন করতে হয় । হিন্দুধর্ম মতে বিয়ে তারিখেই তাদের বিয়ের তারিখ হয় । বিয়েতে প্রচুর ধুমধাম ও আনন্দ হয় । বিয়েতে বর পক্ষ কোন যৌতুক নেন না উল্টো কনের পক্ষকে টাকা দিয়ে মেয়ে বিয়ে করতে হয়। হিন্দুদের মতো সব কিছু খায় শুকরও । তাদের মধ্যে শিক্ষা প্রায় নেই বললেই চলে। কাছে স্কুল থাকলেও অনেকেই প্রাইমারী পর্যন্ত লেখাপড়া করে। তবে ব্যতিক্রম দু’এক জন হাই স্কুল পর্যন্ত লেখা পড়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।


এখানকার লোকদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান মাধ্যম হল বেত-বাঁশের তৈরি আসবাবপত্র তৈরি করা। বাঁশ-বেতের সঙ্গে তাদের নিবিড় সম্পর্ক। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই শুরু হয় বাঁশ-বেতকাটা তৈরি নানা রকম পন্য তৈরির কাজ । বাঁশ-বেতের তীক্ষ্ণ ফলায় কখনো কখনো ক্ষত হয় হাতের তালু। সেই ক্ষত এক সময় শুকিয়ে যায়। আবার হয়। এই চক্রের মাঝে পড়ে আছেন দু’ শতাধি নারী-পুরুষ। তবে বাড়িতে থাকেন বলেই হয়তো বাঁশ-বেত থেকে ফলা তৈরি ও পন্য বানানোর কাজটা নারীদেও ওপরই পড়েছে। ঘুম থেকে উঠে সংসারের রান্নবান্না থেকে শুরু করে অন্যান্য সব কাজের সঙ্গে বসতে হয় বাঁশ-বেতের তৈরি জিনিস পত্র বানানোর কাজে। যুগ যুগ ধরে বাঁশ ও বেতের বিভিন্ন প্রকার জিনিস পত্র তৈরি করে আসছেন এই নারী কারু শিল্পীরা । জেলার খালিয়া গ্রামের ঋষি সমপ্রদায়ের মানুষ বংশপরস্পরায় বাশ-বেতের চাটাই, টুকলি , মোড়া, ডালা,কুলা, খালই,চালুণ, ডুলা,ঝুড়ি, আগৈল, ধামা, পোল, পৈক্কা, গোলা, ডোল,ফুলদানি, ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র তারা প্রতিদিন তৈরি করে । এছাড়া বাঁশের- বেতের তৈরি ছোপা, দেলনা, টেবিল, চেয়ার, শিশুদের খেলনার ঘোড়া গরু , হাতি ঢাক, ও তৈরি করে আসছেন । প্রায় দু’ শতাধিক মানুষের জীবিকা এই বাঁশ-বেতের ওপর নির্ভশীল। সংসারের গতি সচল রাখতে নারীরাই এই কাজের ভার কাঁধে নিয়েছেন। এক সময় গ্রামে বাঁশ-বেতের প্রাচুর্য ছিল। পুরুষেরা বাগান জঙ্গল থেকে বাঁশ-বেত কেটে নিয়ে এসেছেন বিনা পয়সায়। তা থেকে পুরুষদের পাশা পাশি নারীরা বেত তৈরি ও পন্য উৎপাদন করে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন । তাদের চাওয়া-পাওয়া খুব বেশী না হওয়ায় তাতে কোন সমস্যা হয়নি । কিন্তু কি করে যেন তাদের চোখের সামনে গ্রাম বদলে গেছে। সেই সময়টি আর নেই । বাঁশ-বেত এখন তাদের কাছে দুলর্ভ হয়ে উঠেছে , তাদের জীবিকা এখন হুমকিতে পড়েছে । এর কারন গ্রামের বন জঙ্গল বাগাণ কেটে সৃষ্টি করা হচ্ছে বসত বাড়ি , উড়াজ করা হয়েছে বাঁশ-বেত বাগান যার ফলে বাশ ও বেত শিল্প এখন সংকটে পড়েছে। শংকরদী গ্রামের রিনা রানী বলেন,আড়াইশ টাকা দিয়ে একটা বাঁশ কিনি তিন’শ টাকায় জিনিস বিক্রি করি ৫০ টাকা লাভ অয় । এতা দিয়ে ( এই টাকা দিয়ে ) সংসার চলে না। একই কথা শিল্পী, গীতা, বীনা, সন্ধ্যা রানী সহ অনেকের। মিনারানী দাস সহ অনেক কারিগরেরা বলেন, এখন এক দিকে বাঁশ-বেতের সমস্যা অন্যদিকে পুঁজির সমস্যা। যে মহাজন তাদের কাছ থেকে পন্য নেন তাদের কাছ থেকে আগাম টাকা নিলে ১৫০ টাকার পন্য ১০০ টাকায় দিতে হয়। সবিতা নামে এক বাশ শিল্পী বলেন এলাকার বাঁশ-বেতের কারিগরেরা মূলধন না থাকার কারনে ঠিক মতো পন্য বাজারে বিক্রি করতে পারেনা মহাজনদের কাছে তাদের তৈরি পন্য বিক্রি করতে হচ্ছে । এতে তারা প্রকৃত লাভটা পায় না। এছাড়া বাঁশ-বেতের দাম অনেক বেড়ে গেছে। এই কারিগরদের কাছে টিকে থাকার ক্ষেত্রে এখন মূলধনই বড় বাধা হয়ে উঠেছে। কারুশিল্পী গোবিন্দ দাস বলেন, এই কারিগরদের পেশার উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে কারিগরদের পুজি প্রদান, উৎপাদিত পন্য বাজারজাতের সুযোগ সৃষ্টি, সরকারী উদ্যোগে সরকারী খাস জমিতে বাঁশও বেতে চাষ করে বাশওবেতের বাগান সৃস্টি করে বাঁশও বেত শিল্পীদের মাঝে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি ও প্রকৃত মুল্যপ্রাপ্তির সুযোগ প্রদান, সামাজিক বনায়নের সুযোগ প্রদান বাশওবেত শিল্পীদের মান উন্নয়ন, আধুনিকায়ন ও নকশার প্রশিক্ষনপ্রদান, বিশেষস্থানে কেন্দ্র স্থাপন, পরিবেশবান্ধব পন্য হিসেবে সরকারী প্রচার, বাঁশ ও বেতশিল্পীদের হয়রানি না করার দাবী জানান । ঢাকা জগন্নাথ বিশ্ব বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিঞ্জান বিভাগের অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী বলেন খালিয়া ঋষি পাড়াকে একটি কারুপল্লী এলাকা বললে ভুল হবে না। কারও ওপর নির্ভর না করে সমবায়ের মাধ্যমে নিজেরা পন্য উৎপাদন ও বিক্রির ব্যবস্থা করতে পারে। এতে মহাজন যে লাভটা করে ,তা নিজেদের মধ্যে থাকবে ।