Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.
Sports Image

খুলনার প্রয়াত ক্রিকেটার কাজী মানজারুল ইসলাম রানা আজ শুধুই স্মৃতি



দেশের ক্রিকেটের উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে ওঠা দুই ক্রিকেটার কাজী মানজারুল ইসলাম রানা ও সাজ্জাদুল হাসান সেতু। ৭ বছর আগে ২০০৭ সালের ১৬ মার্চ খুলনার কৃতি সন্তান রানা ও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার সেতু মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। দেশের হয়ে টেস্ট ক্রিকেটের অঙ্গনে নিজেকে ফুটিয়ে তোলার আগেই অভিমানী তারা দুজন চলে যান না-ফেরার দেশে। মানজারুল ইসলাম রানাকে মনে রেখেছে খুলনাবাসী। খুলনাবাসীর দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড রানার বাড়ির পাশে শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামের একটি গ্যালারির নামকরণ করেছে তার নামে।

পশ্চিম দিকে মিডিয়া গ্যালারির পাশের গ্যালারির নাম দিয়েছে মানজারুল ইসলাম রানা স্ট্যান্ড। এ জন্য বিসিবির কাছে খুলনাবাসী কৃতজ্ঞ। কিন্তু এখন কি অবস্থা ঐ স্ট্যান্ডের? বছর না ঘুরতেই হালকা কাঠের ফ্রেমে লেখা ‘রানা স্ট্যান্ডটি ভেঙে যায় দমকা বাতাসে। এরপর একটি ছোট প্যানা তৈরি করে গ্যালারির নিচের দিতে লাগিয়ে রেখেছে স্টেডিয়াম কর্তৃপক্ষ। মাঠের এক প্রান্ত থেকে যেটি ভালোভাবে দেখাও যায় না। খেলা চলার দিন বাদে আবার সেটি খুলে রাখা হয়। যেন রানার প্রতি সম্মান দেখানোর থেকে তার প্রতি অবমাননাই করছে প্যানাটি।

দেশের হয়ে ৬টি টেস্ট আর ২৫টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলা খুলনার ছেলে রানা ও ৫০টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলা সেতুকে আমরা কতটুকু মনে রাখতে পেরেছি? একটা সময় মনে হতো তাদের জন্য আমাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই? নাকি শুধু বছর ঘুরলেই কবরের সামনে দুই হাত বেঁধে কিছুক্ষণ সময় পার করা আর একটি পুষ্পমাল্য অর্পণ করে কর্তব্য শেষ করা। দেশের হয়ে সম্মান বয়ে আনা খুলনার এই দুই ক্রিকেটারকে নিয়ে খুলনাবাসীর দাবির প্রতি অবশেষে সুনজর দিয়েছে ক্রিকেট বোর্ড। রানার মৃত্যুর পরপরই খুলনাবাসী তাদের আবেগকে ধরে রাখতে পারেনি। খুলনার একমাত্র আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে রানার নামে একটি গ্যালারির নামকরণের দাবি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে।



স্টেডিয়ামের গা ঘেঁষে যাওয়া রাস্তার নামকরণ করা হয় মানজারুল ইসলাম রানার নামে। কিন্তু কিছুই আর বাস্তবে হয়ে ওঠে না। ২০০৭ সালের ১৬ মার্চ মর্মান্তিক মৃত্যুর পর রানার বাড়ির পাশের ঐ রাস্তার নামকরণের দাবিতে এলাকাবাসী একটি আবেদন করে। যে রাস্তাটি সে সময় মুজগুন্নি মেইন রোড নামে পরিচিত ছিল। সাত বছর পরে অদ্ভুত এক মিল। বাংলাদেশ-আফগানিস্তান ম্যাচ দিয়ে আজ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের পর্দা উঠছে। ঠিক সাত বছর আগে ২০০৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপে ভারতের মুখোমুখি হয়েছিল হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।

ম্যাচের আগে শোকে আচ্ছন্ন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ড্রেসিং রুম। কিছুক্ষণ আগেই তারা খবর পেয়েছে সতীর্থ ক্রিকেটার যাকে দেশে রেখেই ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়েছিল হাবিবুল বাশাররা, সেই মানজারুল ইসলাম রানা আর নেই। মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় আরেক সতীর্থ ক্রিকেটার সাজ্জাদুল হাসান সেতু আর সকলের মধ্যমণি হয়ে মানজারুল ইসলাম রানা বিদায় নিয়েছেন চিরতরে।

পরে শোককেই শক্তিতে পরিণত করেছিল টাইগাররা। যার ফলে ভারতকে হারিয়ে দিয়েছিল তারা। সতীর্থ ক্রিকেটারদের কাছে ম্যাচের আগে তাকে স্মরণ করার কথা ওপার থেকে যদি রানা দাবি করেন, তা কি খুব বেশিই আবদার হবে? আর যদি সেটা না হয় তাহলে রানাকে বলব, ক্ষমা করো। দুঃখিত, রানা আমরা তোমাকে মনে রাখতে পারিনি।

মানজারুল ইসলাম রানা কখনো বিশ্বকাপ খেলেননি। কিন্তু, বিশ্বকাপ না খেলেই তিনি হয়ে আছেন বাংলাদেশের বিশ্বকাপ ইতিহাসের অংশ। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে মানজার ছিলেন পোর্ট অব স্পেনের মাঠে, ছিলেন বাংলাদেশের প্রতিটি খেলোয়াড়ের সঙ্গে ছায়াসঙ্গী হয়ে। ভারতকে হারিয়ে বাংলাদেশ সেদিন প্রমাণ করেছিল মানজারুল ইসলাম রানার আধ্যাত্মিক উপস্থিতি। মানজারুল ইসলাম রানা ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচের আগে খুলনায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়েরা ত্রিনিদাদে বসেই শোনের এই মর্মন্তুদ সংবাদ।

১৯৮৪ সালের ৪ জানুয়ারি খুলনায় জন্মগ্রহন করা মানজারুল ইসলাম রানার বাঙলাদেশ দলে টেস্ট অভিষেক ঘটে ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০০৪ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। তার আগে ঘটে ওয়ানডে অভিষেক। ৭ নভেম্বর ২০০৩ মোহাম্মদ রফিকের ইনজুরির কারনে তিনি সুযোগ পান জাতীয় দলে। বাংলাদেশের একমাত্র বোলার হিসেবে জীবনের প্রথম ওভারের ৩য় বলে ইংল্যান্ড অধিনায়ক মাইকেল ভনকে স্রেফ বোকা বানিয়ে যখন তিনি আউট করেন, তখন তার বয়স মাত্র ১৯ বছর। সেই থেকে শুরু। ধীরে ধীরে একজন পারফেক্ট অলরাউনডার হয়ে উঠতে থাকেন মানজার। তৎকালীন বাংলাদেশ দলে রফিককে সাপোর্ট দেবার মত একজন কার্যকরী বাঁহাতি স্পিনার এবং একই সাথে লেটঅর্ডারে প্রয়োজনের সময় দ্রুত রান তোলার দক্ষতা থাকায় কোচ ডেভ হোয়াটমোরের ভরসার জায়গায় পরিনত হন তিনি।

২০০০ সালের ২২ নভেম্বর প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে খুলনা বিভাগের হয়ে রানার অভিষেক ঘটে। সে ম্যাচে তিনি ব্যাট করেননি। ৩০ জানুয়ারি ২০০৩ এবং ৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ এর মধ্যে রানা ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেননি। ২০০৩ সালের ৭ নভেম্বর চট্টগ্রামে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে রানার অভিষেক ঘটে। মোহাম্মদ রফিক এর স্থলাভিষিক্ত হয়ে তিনি তার তৃতীয় বলেই মাইকেল ভনকে আউট করেন। তিনি প্রথম বাংলাদেশী ক্রিকেটার যিনি তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে প্রথম ওভারেই উইকেট নিয়েছেন।২০০৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে রানার টেস্ট অভিষেক ঘটে। এই ম্যাচে তিনি ২০.২ ওভার বল করে ৬৬ রান দিয়ে ২ উইকেট নেন। টেস্টে তার প্রথম শিকার শন আরভিন। এই ম্যাচের ১ম ইনিংসে অপরাজিত ৩৫ ও ২য় ইনিংসে ৩২ রান করেন।



প্রয়াত মানজারুল ইসলাম রানার স্মরণে গ্যালারীর নামকরণ করা হয়েছে। এমন কিছুই আশা করছিলেন রানার মাতা। অবশেষে রানার মায়ের সামান্য চাওয়া পূরণ হয়েছে। খুলনার শেখ আবু নাসের ক্রিকেট স্টেডিয়ামের আন্তর্জাতিক গ্যালারী স্ট্যান্ডের পশ্চিম অংশ প্রয়াত ক্রিকেটার মানজারুল ইসলাম রানার নামে নামকরণ করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। আন্তর্জাতিক গ্যালারী এখন থেকে মানজারুল ইসলাম রানা স্ট্যান্ড নামে পরিচিত হবে।



১৯৮৪ সালে খুলনায় জন্মগ্রহন করেন রানা। ২৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার ২০০৭ সালের ১৬ মার্চ এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। তরুণ এই ক্রিকেটার তাঁর ক্যারিয়ারে ২৫টি ওডিআই ও ৬টি টেস্ট খেলেছেন। প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর কেটে গেলেও খুলনার ক্রীড়াঙ্গনে না থেকেও বেঁচে আছেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই খুলনাবাসী দীর্ঘদিনের দাবী ছিল শেখ আবু নাসের ক্রিকেট স্টেডিয়ামের একটি অংশ যেন প্রয়াত রানার নামে নামকরণ করা হয়।

স্মৃতির পাতা-
মায়ের স্মৃতির পাতায় প্রতিটি মূহুর্ত আছেন কাজী মানজারুল ইসলাম রানা। রূপসা পাড়ে ক্রিকেট আনন্দের রেণু ছড়ালেই এক মায়ের হৃদয়ে হাহাকার ওঠে। ছেলের স্মৃতি হানা দেয় মায়ের মানসপটে। তখন সবার মনে পড়ে রানা নামে এক ক্রিকেটার ছিলেন। সাত বছর আগে মানজারুল ইসলাম রানা চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। তার মা দিনাতিপাত করেন ছেলের স্মৃতি নিয়ে। গোটা বাড়িতে তিনি একা। মানজারুলের মা জামিলা খাতুন বলেন, ছেলের চাকরি হলে তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারতেন। কয়েকবার মাহফুজকে ঢাকায় ডেকেছেন বিসিবির কর্মকর্তারা। কিন্তু তার চাকরি হয়নি। তিনি বলেন, ‘খুলনায় খেলা হলে কর্মকর্তারা টিকিট পাঠান। মাঠে নেয়ার জন্য গাড়ি পাঠান। বিভিন্ন সময় খবর নেন। কিন্তু ছেলেটার চাকরির ব্যাপারে শুধু আশ্বাস দেন।’



মানজারুল ইসলাম রানার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, দোতলা বাড়ির প্রবেশ মুখে সাজানো রয়েছে রানার পাওয়া পুরস্কারগুলো। দোতলায় রানার ঘরটি মা সব সময় পরিচ্ছন্ন রাখেন। ঘরে অন্য কারও প্রবেশাধিকার নেই। ঘরটি বেশ পরিপাটি। যেন রানা এখনও এ বাড়িতেই থাকেন। কিন্তু রানা সাত বছর ধরে স্মৃতির পাতায়।

স্মৃতির পাতা-
কেউ ভুলতে পারেনি কাজী মানজারুল ইসলাম রানাকে। ভুলতে পারেনি প্রাক্তণ কোচ ডেব হোয়াটমোর তাই তো সতীর্থের সাথে চলে গেছে রানার বাড়ি, রানার কবর দেখতে। ২০০৭ বিশ্বকাপের সময় বাংলাদেশের কোচ ডেভ হোয়াটমোর, অধিনায়ক হাবিবুল বাশার। দুজনের ভূমিকা বদলেছে। তবে দুজনই এখন খুলনায়। হোয়াটমোর গিয়েছেন ধারাভাষ্য দিতে, হাবিবুল দলের নির্বাচক হিসাবে। খুলনায় খেলা হলে অবধারিতভাবে জীবন্ত হয়ে ওঠে মানজারুল স্মৃতি। এ শহরটায় আগেও এসেছেন হোয়াটমোর। তবে মানজারুল চলে যাওয়ার পর এই প্রথম। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ দলের সাবেক কোচের স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছেন প্রয়াত শিষ্যের কথা মনে পড়ে।



হাবিবুল তাকে আগেই বলেছিলেন রানার কবর দেখাতে নিয়ে যাবে। আজ বেরিয়ে পড়লেন অন্যলোকে চলে যাওয়া শিষ্যের জন্য প্রার্থনা করতে। হাবিবুল তো ছিলেনই, হোয়াটমোরের সঙ্গে ছিলেন প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ, মিনহাজুল আবেদীন ও ধারাভাষ্যকার আতাহার আলী খান। জিয়ারত করা হলো রানার কবর। ‘যেখানে থাকো, ভালো থেকো’—হোয়াটমোরের মনের ভাষা হয়তো এমনই ছিল।

এরপর রানার বাড়িতে যান সবাই। মা জামিলা খাতুনের সঙ্গে দেখা করেন। মায়ের চোখে অশ্রু টলমল। অশ্রু সংক্রামিত করে অন্যদেরও। অতিথিরা যান রানার ঘরে। সব আগের মতোই ছিমছাম গোছানো। ওয়ার্ডরোবের ওপর হেলমেট, ছোট-বড় কয়েকটা ট্রফি। সংবর্ধনায় পাওয়া বিশাল একটা প্লেট। বিষণ্ন মনে নিস্পলক অতিথিরা চেয়ে থাকেন রানার রেখে যাওয়া স্মৃতিগুলোর দিকে। শুধু রানাই নেই!

কাজী মানজারুল ইসলাম রানার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটাঙ্গণের তথ্য শেয়ার করা হলো।