ক্রিকেট বিশ্বকাপে বাংলাদেশের অনেক ক্রিকেটারই ম্যাচ জিতিয়েছেন বাংলাদেশকে। তাঁদের মধ্যে চারজনকে দিয়ে সেই কৃতিত্বের স্মৃতিচারণ করিয়েছি আমরা যেন সেটা এবারের জন্য হয় উৎসাহ-অনুপ্রেরণা। সেই কঠিন দিনগুলোতে জয় পাওয়া সম্ভব হলে এবার কেন আরো বেশি জয় পাওয়া যাবে না, এ বোধ যেন সঞ্চারিত হয় বাংলাদেশ দলে।
মিনহাজুল আবেদীন
প্রতিপক্ষ স্কটল্যান্ড ভেন্যু এডিনবরা ১৯৯৯ (পারফরম্যান্স : ১১৬ বলে ৬৮* এবং ৩-০-১২-১)‘৯৯ বিশ্বকাপ স্কোয়াডে আমি ছিলাম না। কোন পরিপ্রেক্ষিতে আমাকে বাদ দেওয়া হয়েছিল, সেটি ন্যায় কি অন্যায় ছিল_তা সবার জানা। আমি শুধু জানি, দেশবাসীর ভালোবাসার জোরে পরে আমাকে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে ঢোকানো হয়েছিল। এত যে ভালোবাসা, তার প্রতিদান আমি দেব না!
সুযোগটা এল স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে। দেশ ছাড়ার সময় এই একটি ম্যাচ জেতার ব্যাপারেই আমরা সবাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম। কিন্তু টস হেরে ব্যাটিংয়ে নামতেই পড়ে গেলাম ঘোর বিপদে। স্কোরবোর্ডে ২৬ রান উঠতেই ৫ উইকেট হাওয়া। আমাদের ব্যাটসম্যানরা ভুল শট খেলেছে ঠিক কিন্তু স্কটিশরা বোলিংও করছিল দুর্দান্ত। ১০০ ওভারের ম্যাচের ১০ ওভার যেতে না যেতেই হারের শঙ্কা জেঁকে ধরে আমাদের।
সত্যি বলতে কি, ওই সময়টায়ও আমি ঘাবড়াইনি। আস্থা ছিল নিজের সামর্থ্যের ওপর। খেলে গেছি তাই নিজের মতো। সিঙ্গেলস-ডাবলস নিয়ে আস্তে আস্তে নিজের ইনিংস গড়লাম। দলের ইনিংসটাও দাঁড়িয়ে গেল তাতে। আমি অপরাজিত ছিলাম ৬৮ রানে। দল করল ১৮৫। ২৬ রানে ৫ উইকেট চলে যাওয়া দলটির জন্য যা কম নয়।
এর পরও অবশ্য ম্যাচটি হেরে যাচ্ছিলাম প্রায়। ওদের হ্যাভিন হ্যামিল্টন দারুণ এক ইনিংস খেলেছিল। সে রান আউট হওয়ার পরই এক রকম নিশ্চিত হয়ে যায় আমাদের জয়। সত্যিই যখন ম্যাচটি জিতে গেলাম, ঠিক যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। আর এখনো বিশ্বাস হয় না, বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম ম্যান অব দ্য ম্যাচ আমি!
দেশের মানুষের ভালোবাসায় আমি বিশ্বকাপ খেলেছি। সেখানে এমন একটা ম্যাচে এমন একটা ইনিংস খেলে দলকে জেতালাম। পুরস্কার নেওয়ার মঞ্চে উঠে তাই কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি দেশবাসীকে। অমন একটা সুযোগ করে দেওয়ার জন্য এখনো ধন্যবাদ জানাই স্রষ্টাকে।
খালেদ মাহমুদ
প্রতিপক্ষ পাকিস্তান, ভেন্যু নর্দাম্পটন ১৯৯৯ (পারফরম্যান্স : ৩৪ বলে ২৭ ও ১০-২-৩১-৩) স্বপ্নের বিশ্বকাপ যাত্রার আগে আমাদের দলের একটা আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন হয়েছিল। সেখানে সহ-অধিনায়ক হিসেবে আমার জন্য ছিল কেবল একটি প্রশ্ন, বিশ্বকাপে কতটি ম্যাচ জিতবে বাংলাদেশ? উত্তর দিয়েছিলাম দুটি। একটি স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে, বাকি চার ‘বড়’ দলের মধ্যে অন্তত একটিকে শিকারের ঘোষণা দিয়েছিলাম। পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ ম্যাচের আগে আবছাভাবে এটি আমার মাথায় ছিল। বলছি না যে এ কারণেই আমি সেদিন অমন দুর্দান্ত খেলেছিলাম। ব্যাট হাতে ২৭ রানের পর বোলিংয়ে তিন উইকেট। পাকিস্তানের বিপক্ষে ৬২ রানের জয়ে আমি যে অবদান রাখতে পেরেছিলাম, এই খুশি রাখি কোথায়!
ওই বিশ্বকাপে পাকিস্তান ছিল দুরন্ত ফর্মে। ওই অশ্বের গতি রোধ করা যাবে বলে ভাবেনি কেউ। আমরাও যে খুব ভেবেছি, তা নয়। তবে সবারই ইচ্ছা ছিল, প্রথম বিশ্বকাপের শেষটা যেন ভালো হয়। ৯ উইকেটে ২২৩ রান তুলে সে পথে আমরা এগিয়েছি অর্ধেক। তবে বাকি অর্ধেক পাড়ি দিলে যে ইতিহাস গড়া হবে, ভাবিনি তখনো।
স্কোয়াডের যারা বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পায়নি, তাদের এদিন রাখা হয় একাদশে। আমি হাতে পেয়ে যাই নতুন বল। এমন নয় যে, আগে কখনো নতুন বলে বোলিং করিনি। আত্মবিশ্বাস তাই ছিলই। তার পালে হাওয়া লাগে ‘টিপিক্যাল ইংলিশ কন্ডিশন’-এর কারণে, যা আমার সুইং বোলিংয়ের জন্য আদর্শ। প্রথম স্পেলেই শহীদ আফ্রিদি, ইনজামাম উল হক ও সেলিম মালিকের উইকেট তুলে নিই। তাতেই ভেঙে যায় পাকিস্তানের মেরুদণ্ড। এর পরও ভয় ছিল। বিশেষত যতক্ষণ ওয়াসিম আকরাম ছিলেন উইকেটে। নান্নু ভাই (মিনহাজুল আবেদীন) ওকে আউট করার পরই নিশ্চিত হই যে, আমরা জিতছি। এরপর কী যে আনন্দ করেছিলাম সেদিন!
তবে শুধু আনন্দ না, বিষাদও ছুঁয়ে গিয়েছিল সেই দিনটায়। কারণ গর্ডন গ্রিনিজ। পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের দিন টিম বাসে ওকে দেখেছি। কাঁদেনি। কিন্তু গর্ডনের কণ্ঠে বোঝা যাচ্ছিল ভেতরের রক্তক্ষরণটা। আমাদের বলল, ‘এটি তোমাদের শেষ ম্যাচ। মাথা উঁচু করে শেষ করো। আমার কাছ থেকে যা শিখেছ, সেটি মাঠে প্রয়োগের চেষ্টা করো।’ ব্যাটিং করার সময় ড্রেসিং রুমে দেখেছি গর্ডনকে। এক কোনায় চুপচাপ বসা। আমরা ফিল্ডিংয়ে নামার পরই বোধহয় ও চলে গিয়েছিল। অবিস্মরণীয় জয়ের উল্লাসে তাই গর্ডনকে পাইনি আমরা। ড্রেসিংরুমে ফিরে ফোন দিয়ে বললাম, ‘তুমি কি জানো, আমরা জিতেছি। আমাদের সঙ্গে সেলিব্রেট করবে না?’ গর্ডন বলল, ‘সেটি আর হয় না। আমি এখন অনেক দূরে চলে গেছি।’ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলি আমি। সঙ্গে আরো অনেকে।
সেদিন জয়ের তীব্র আনন্দের মাঝেও গর্ডনের বিদায়ের বিষাদ সঙ্গী হয়ে ছিল আমাদের।
মাশরাফি বিন মুর্তজা
প্রতিপক্ষ ভারত, ভেন্যু পোর্ট অব স্পেন ২০০৭ (পারফরম্যান্স : ৯.৩-২-৩৮-৪) ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের আবহটাই ছিল এমন যে, আমরা জিতছি। সেটি কিন্তু এমনি এমনি হয়নি। আগের বছর অনেক ম্যাচ জিতেছি, প্র্যাকটিস ম্যাচে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছি। এসব ব্যাপার তো ছিলই। আমার তেতে ওঠার পেছনে আরো কয়েকটি ঘটনা ছিল। বলছি।
ভারতের সঙ্গে একই হোটেলে ছিলাম আমরা। দেখতাম, আমাদের কেউ পাত্তাই দিত না। এ ছাড়া উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দিন ইরফান পাঠানের সঙ্গে একটু কথা কাটাকাটি হয়েছিল। রাজ, রাসেল ও আমি একসঙ্গে ছিলাম। পাঠান বলল, আমাদের নাকি একাই হারিয়ে দেবে। আমি বললাম, ‘নিজেদের কথা ভাবো। আমরা কিন্তু আগেও তোমাদের হারিয়েছি।’ হোটেলে একদিন শ্রীশান্তের সঙ্গেও এক চোট হয়ে গেল। আমাকে বলে, ‘শচীন, সৌরভ, দ্রাবিড়রা বিশ্বকাপ জেতেনি। এবার জিতব।’ স্পষ্ট মনে আছে, আমি বলেছিলাম, ‘এবারও হবে না। বাড়ি ফেরার জন্য ব্যাগ গোছাও।’ এসব টুকরো ঘটনার বাইরে আছে মানজার রানার মৃত্যু, যা আমার মনটাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিল। ও যে আমার কী ভালো বন্ধু ছিল! মনে আছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আসার দিন চারেক আগেও খুলনা গিয়েছিলাম রানার সঙ্গে দেখা করতে। ও আড্ডা মারতে চলে যাওয়ায় আমি বলেছিলাম, ‘তুই ওসবই কর। তোর আর জাতীয় দলে খেলা হবে না।’ রানা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলল, ঠিকই আবার জাতীয় দলে ফিরবে। আমার সেই বন্ধু আর পৃথিবীতে নেই! ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের আগে আমরা সবাই তাই খুব উদ্দীপ্ত ছিলাম। ম্যাচ যত এগিয়ে এসেছে, জয় ততই সম্ভব বলে ভেবেছি। শুরুতেই শেবাগের
উইকেট। আমার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা বল। এরপর উথাপ্পা। ৬ ওভারের স্পেল শেষে ড্রেসিং রুমে গিয়েছি জার্সি বদলাতে। সেখান থেকেই শুনলাম চিৎকার। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি টেন্ডুলকার আউট। কিসের জার্সি বদল! এক দৌড়ে আবার মাঠে ঢুকে পড়লাম। ১৫৭ থেকে ২ রান যোগ করতেই আমরা তুলে নিলাম ওদের ৫-৬-৭ নম্বর উইকেট। তখনই ভেবেছি, ম্যাচ জিতছি। শেষ দুটো উইকেট নিয়েছিলাম আমি। পরে তামিম, মুশফিক, সাকিবের ব্যাটিংয়ে অবিস্মরণীয় জয়।
আমি যত দিন জাতীয় দলে খেলছি, তার মধ্যে ওই জয়টাই স্মরণীয়। ম্যাচ শেষে আমার কানে ঘুরেফিরে বাজছিল পাঠান-শ্রীশান্তের কথাগুলো। আর রানা! আমি জানি, বন্ধু রানা আমাদের ওই জয় ঠিকই দেখেছিল। হোক না সেটি অন্য ভুবন থেকে।
মোহাম্মদ আশরাফুল
প্রতিপক্ষ বারমুডা ভেন্যু পোর্ট অব স্পেন ২০০৭ (পারফরম্যান্স : ৩২ বলে অপরাজিত ২৯) প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা ভেন্যু গায়ানা ২০০৭ (পারফরম্যান্স : ৮৩ বলে ৮৭) বিশ্বকাপে আমি দুটি খেলায় ম্যাচ অব দ্য ম্যাচ হয়েছি। প্রথমটিতে ভাবিনি, এ পুরস্কার পাব। আর দ্বিতীয়টিতে যে ম্যাচসেরা হয়েছি, সেটি ভাবলে এখনো গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানো কি চাট্টিখানি কথা!
আমার প্রথম ম্যান অব দ্য ম্যাচ বারমুডার বিপক্ষে। ওরা মনে হয় ৯৪ রান করেছিল। সহজ জয়ের লক্ষ্যে নেমে দ্রুত তিনটি উইকেট চলে গেল। এরপর আমি আর সাকিব জুটি গড়ে ম্যাচ জেতালাম। আমি ছিলাম অপরাজিত ২৯। সাকিব ছিল ২৬ রানে। খেলা শেষে আমার নাম ঘোষণা করায় কিছুটা অবাক হয়েছিলাম। কারণ বোলাররা ভালো বোলিং করেছিল। আর ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বোলিংয়ে দুই উইকেট নিয়েছিল সাকিব। যা-ই হোক, ওই সময় আমার ইনিংসটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তখন আরো দু-একটি উইকেট হারিয়ে ফেললে জেতাটা কঠিন হতো। আর ওই ম্যাচ হারলে হয়তো আমরা দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠতে পারতাম না।
তবে দ্বিতীয় ম্যান অব দ্য ম্যাচ সব দিক দিয়েই আরো স্মরণীয়। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ইনিংসটি আমার ক্যারিয়ারেরই অন্যতম সেরা। সেদিন যা করতে চেয়েছি, হয়েছে। ৮৪ রানে ৪ উইকেট হারানোর পর কেউ আশা করেনি আমরা আড়াই শ পেরোব। ৮৩ বলে ৮৭ রানের ইনিংসে সেটি সম্ভব হয়েছিল। আউট হওয়ার বলটি আমি মেরেছিলাম ছক্কার জন্য। ভেবেছি তাহলেই ৯৩ হয়ে যাবে। শেষ ৫ বলে ৭ রান নিয়ে সেঞ্চুরি করতে পারব। আউট হওয়ায় কিছুটা খারাপ লেগেছিল। কিন্তু দল জেতার পর এইটুকুন মন খারাপের কথা কি আর মনে থাকে!
মিনহাজুল আবেদীন
প্রতিপক্ষ স্কটল্যান্ড ভেন্যু এডিনবরা ১৯৯৯ (পারফরম্যান্স : ১১৬ বলে ৬৮* এবং ৩-০-১২-১)‘৯৯ বিশ্বকাপ স্কোয়াডে আমি ছিলাম না। কোন পরিপ্রেক্ষিতে আমাকে বাদ দেওয়া হয়েছিল, সেটি ন্যায় কি অন্যায় ছিল_তা সবার জানা। আমি শুধু জানি, দেশবাসীর ভালোবাসার জোরে পরে আমাকে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে ঢোকানো হয়েছিল। এত যে ভালোবাসা, তার প্রতিদান আমি দেব না!
সুযোগটা এল স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে। দেশ ছাড়ার সময় এই একটি ম্যাচ জেতার ব্যাপারেই আমরা সবাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম। কিন্তু টস হেরে ব্যাটিংয়ে নামতেই পড়ে গেলাম ঘোর বিপদে। স্কোরবোর্ডে ২৬ রান উঠতেই ৫ উইকেট হাওয়া। আমাদের ব্যাটসম্যানরা ভুল শট খেলেছে ঠিক কিন্তু স্কটিশরা বোলিংও করছিল দুর্দান্ত। ১০০ ওভারের ম্যাচের ১০ ওভার যেতে না যেতেই হারের শঙ্কা জেঁকে ধরে আমাদের।
সত্যি বলতে কি, ওই সময়টায়ও আমি ঘাবড়াইনি। আস্থা ছিল নিজের সামর্থ্যের ওপর। খেলে গেছি তাই নিজের মতো। সিঙ্গেলস-ডাবলস নিয়ে আস্তে আস্তে নিজের ইনিংস গড়লাম। দলের ইনিংসটাও দাঁড়িয়ে গেল তাতে। আমি অপরাজিত ছিলাম ৬৮ রানে। দল করল ১৮৫। ২৬ রানে ৫ উইকেট চলে যাওয়া দলটির জন্য যা কম নয়।
এর পরও অবশ্য ম্যাচটি হেরে যাচ্ছিলাম প্রায়। ওদের হ্যাভিন হ্যামিল্টন দারুণ এক ইনিংস খেলেছিল। সে রান আউট হওয়ার পরই এক রকম নিশ্চিত হয়ে যায় আমাদের জয়। সত্যিই যখন ম্যাচটি জিতে গেলাম, ঠিক যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। আর এখনো বিশ্বাস হয় না, বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম ম্যান অব দ্য ম্যাচ আমি!
দেশের মানুষের ভালোবাসায় আমি বিশ্বকাপ খেলেছি। সেখানে এমন একটা ম্যাচে এমন একটা ইনিংস খেলে দলকে জেতালাম। পুরস্কার নেওয়ার মঞ্চে উঠে তাই কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি দেশবাসীকে। অমন একটা সুযোগ করে দেওয়ার জন্য এখনো ধন্যবাদ জানাই স্রষ্টাকে।
খালেদ মাহমুদ
প্রতিপক্ষ পাকিস্তান, ভেন্যু নর্দাম্পটন ১৯৯৯ (পারফরম্যান্স : ৩৪ বলে ২৭ ও ১০-২-৩১-৩) স্বপ্নের বিশ্বকাপ যাত্রার আগে আমাদের দলের একটা আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন হয়েছিল। সেখানে সহ-অধিনায়ক হিসেবে আমার জন্য ছিল কেবল একটি প্রশ্ন, বিশ্বকাপে কতটি ম্যাচ জিতবে বাংলাদেশ? উত্তর দিয়েছিলাম দুটি। একটি স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে, বাকি চার ‘বড়’ দলের মধ্যে অন্তত একটিকে শিকারের ঘোষণা দিয়েছিলাম। পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ ম্যাচের আগে আবছাভাবে এটি আমার মাথায় ছিল। বলছি না যে এ কারণেই আমি সেদিন অমন দুর্দান্ত খেলেছিলাম। ব্যাট হাতে ২৭ রানের পর বোলিংয়ে তিন উইকেট। পাকিস্তানের বিপক্ষে ৬২ রানের জয়ে আমি যে অবদান রাখতে পেরেছিলাম, এই খুশি রাখি কোথায়!
ওই বিশ্বকাপে পাকিস্তান ছিল দুরন্ত ফর্মে। ওই অশ্বের গতি রোধ করা যাবে বলে ভাবেনি কেউ। আমরাও যে খুব ভেবেছি, তা নয়। তবে সবারই ইচ্ছা ছিল, প্রথম বিশ্বকাপের শেষটা যেন ভালো হয়। ৯ উইকেটে ২২৩ রান তুলে সে পথে আমরা এগিয়েছি অর্ধেক। তবে বাকি অর্ধেক পাড়ি দিলে যে ইতিহাস গড়া হবে, ভাবিনি তখনো।
স্কোয়াডের যারা বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পায়নি, তাদের এদিন রাখা হয় একাদশে। আমি হাতে পেয়ে যাই নতুন বল। এমন নয় যে, আগে কখনো নতুন বলে বোলিং করিনি। আত্মবিশ্বাস তাই ছিলই। তার পালে হাওয়া লাগে ‘টিপিক্যাল ইংলিশ কন্ডিশন’-এর কারণে, যা আমার সুইং বোলিংয়ের জন্য আদর্শ। প্রথম স্পেলেই শহীদ আফ্রিদি, ইনজামাম উল হক ও সেলিম মালিকের উইকেট তুলে নিই। তাতেই ভেঙে যায় পাকিস্তানের মেরুদণ্ড। এর পরও ভয় ছিল। বিশেষত যতক্ষণ ওয়াসিম আকরাম ছিলেন উইকেটে। নান্নু ভাই (মিনহাজুল আবেদীন) ওকে আউট করার পরই নিশ্চিত হই যে, আমরা জিতছি। এরপর কী যে আনন্দ করেছিলাম সেদিন!
তবে শুধু আনন্দ না, বিষাদও ছুঁয়ে গিয়েছিল সেই দিনটায়। কারণ গর্ডন গ্রিনিজ। পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের দিন টিম বাসে ওকে দেখেছি। কাঁদেনি। কিন্তু গর্ডনের কণ্ঠে বোঝা যাচ্ছিল ভেতরের রক্তক্ষরণটা। আমাদের বলল, ‘এটি তোমাদের শেষ ম্যাচ। মাথা উঁচু করে শেষ করো। আমার কাছ থেকে যা শিখেছ, সেটি মাঠে প্রয়োগের চেষ্টা করো।’ ব্যাটিং করার সময় ড্রেসিং রুমে দেখেছি গর্ডনকে। এক কোনায় চুপচাপ বসা। আমরা ফিল্ডিংয়ে নামার পরই বোধহয় ও চলে গিয়েছিল। অবিস্মরণীয় জয়ের উল্লাসে তাই গর্ডনকে পাইনি আমরা। ড্রেসিংরুমে ফিরে ফোন দিয়ে বললাম, ‘তুমি কি জানো, আমরা জিতেছি। আমাদের সঙ্গে সেলিব্রেট করবে না?’ গর্ডন বলল, ‘সেটি আর হয় না। আমি এখন অনেক দূরে চলে গেছি।’ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলি আমি। সঙ্গে আরো অনেকে।
সেদিন জয়ের তীব্র আনন্দের মাঝেও গর্ডনের বিদায়ের বিষাদ সঙ্গী হয়ে ছিল আমাদের।
মাশরাফি বিন মুর্তজা
প্রতিপক্ষ ভারত, ভেন্যু পোর্ট অব স্পেন ২০০৭ (পারফরম্যান্স : ৯.৩-২-৩৮-৪) ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের আবহটাই ছিল এমন যে, আমরা জিতছি। সেটি কিন্তু এমনি এমনি হয়নি। আগের বছর অনেক ম্যাচ জিতেছি, প্র্যাকটিস ম্যাচে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছি। এসব ব্যাপার তো ছিলই। আমার তেতে ওঠার পেছনে আরো কয়েকটি ঘটনা ছিল। বলছি।
ভারতের সঙ্গে একই হোটেলে ছিলাম আমরা। দেখতাম, আমাদের কেউ পাত্তাই দিত না। এ ছাড়া উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দিন ইরফান পাঠানের সঙ্গে একটু কথা কাটাকাটি হয়েছিল। রাজ, রাসেল ও আমি একসঙ্গে ছিলাম। পাঠান বলল, আমাদের নাকি একাই হারিয়ে দেবে। আমি বললাম, ‘নিজেদের কথা ভাবো। আমরা কিন্তু আগেও তোমাদের হারিয়েছি।’ হোটেলে একদিন শ্রীশান্তের সঙ্গেও এক চোট হয়ে গেল। আমাকে বলে, ‘শচীন, সৌরভ, দ্রাবিড়রা বিশ্বকাপ জেতেনি। এবার জিতব।’ স্পষ্ট মনে আছে, আমি বলেছিলাম, ‘এবারও হবে না। বাড়ি ফেরার জন্য ব্যাগ গোছাও।’ এসব টুকরো ঘটনার বাইরে আছে মানজার রানার মৃত্যু, যা আমার মনটাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিল। ও যে আমার কী ভালো বন্ধু ছিল! মনে আছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আসার দিন চারেক আগেও খুলনা গিয়েছিলাম রানার সঙ্গে দেখা করতে। ও আড্ডা মারতে চলে যাওয়ায় আমি বলেছিলাম, ‘তুই ওসবই কর। তোর আর জাতীয় দলে খেলা হবে না।’ রানা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলল, ঠিকই আবার জাতীয় দলে ফিরবে। আমার সেই বন্ধু আর পৃথিবীতে নেই! ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের আগে আমরা সবাই তাই খুব উদ্দীপ্ত ছিলাম। ম্যাচ যত এগিয়ে এসেছে, জয় ততই সম্ভব বলে ভেবেছি। শুরুতেই শেবাগের
উইকেট। আমার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা বল। এরপর উথাপ্পা। ৬ ওভারের স্পেল শেষে ড্রেসিং রুমে গিয়েছি জার্সি বদলাতে। সেখান থেকেই শুনলাম চিৎকার। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি টেন্ডুলকার আউট। কিসের জার্সি বদল! এক দৌড়ে আবার মাঠে ঢুকে পড়লাম। ১৫৭ থেকে ২ রান যোগ করতেই আমরা তুলে নিলাম ওদের ৫-৬-৭ নম্বর উইকেট। তখনই ভেবেছি, ম্যাচ জিতছি। শেষ দুটো উইকেট নিয়েছিলাম আমি। পরে তামিম, মুশফিক, সাকিবের ব্যাটিংয়ে অবিস্মরণীয় জয়।
আমি যত দিন জাতীয় দলে খেলছি, তার মধ্যে ওই জয়টাই স্মরণীয়। ম্যাচ শেষে আমার কানে ঘুরেফিরে বাজছিল পাঠান-শ্রীশান্তের কথাগুলো। আর রানা! আমি জানি, বন্ধু রানা আমাদের ওই জয় ঠিকই দেখেছিল। হোক না সেটি অন্য ভুবন থেকে।
মোহাম্মদ আশরাফুল
প্রতিপক্ষ বারমুডা ভেন্যু পোর্ট অব স্পেন ২০০৭ (পারফরম্যান্স : ৩২ বলে অপরাজিত ২৯) প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা ভেন্যু গায়ানা ২০০৭ (পারফরম্যান্স : ৮৩ বলে ৮৭) বিশ্বকাপে আমি দুটি খেলায় ম্যাচ অব দ্য ম্যাচ হয়েছি। প্রথমটিতে ভাবিনি, এ পুরস্কার পাব। আর দ্বিতীয়টিতে যে ম্যাচসেরা হয়েছি, সেটি ভাবলে এখনো গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানো কি চাট্টিখানি কথা!
আমার প্রথম ম্যান অব দ্য ম্যাচ বারমুডার বিপক্ষে। ওরা মনে হয় ৯৪ রান করেছিল। সহজ জয়ের লক্ষ্যে নেমে দ্রুত তিনটি উইকেট চলে গেল। এরপর আমি আর সাকিব জুটি গড়ে ম্যাচ জেতালাম। আমি ছিলাম অপরাজিত ২৯। সাকিব ছিল ২৬ রানে। খেলা শেষে আমার নাম ঘোষণা করায় কিছুটা অবাক হয়েছিলাম। কারণ বোলাররা ভালো বোলিং করেছিল। আর ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বোলিংয়ে দুই উইকেট নিয়েছিল সাকিব। যা-ই হোক, ওই সময় আমার ইনিংসটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তখন আরো দু-একটি উইকেট হারিয়ে ফেললে জেতাটা কঠিন হতো। আর ওই ম্যাচ হারলে হয়তো আমরা দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠতে পারতাম না।
তবে দ্বিতীয় ম্যান অব দ্য ম্যাচ সব দিক দিয়েই আরো স্মরণীয়। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ইনিংসটি আমার ক্যারিয়ারেরই অন্যতম সেরা। সেদিন যা করতে চেয়েছি, হয়েছে। ৮৪ রানে ৪ উইকেট হারানোর পর কেউ আশা করেনি আমরা আড়াই শ পেরোব। ৮৩ বলে ৮৭ রানের ইনিংসে সেটি সম্ভব হয়েছিল। আউট হওয়ার বলটি আমি মেরেছিলাম ছক্কার জন্য। ভেবেছি তাহলেই ৯৩ হয়ে যাবে। শেষ ৫ বলে ৭ রান নিয়ে সেঞ্চুরি করতে পারব। আউট হওয়ায় কিছুটা খারাপ লেগেছিল। কিন্তু দল জেতার পর এইটুকুন মন খারাপের কথা কি আর মনে থাকে!