আদিকাল থেকে মানুষ সর্বদাই সৌন্দর্য সচেতন ছিল। তবে এই সৌন্দর্য চেতনা নানা বিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। সব মানুষই চায় নিজেকে নতুনরূপে সাজিয়ে আত্নতৃপ্তি পেতে। প্রতিনিয়ত নতুন কৌশলে রঙে বর্ণে আবরণে এবং আভরণে নিজেদের সাজিয়ে চলেছে। এই সৌন্দর্য সচেতনতা যে কত বাহারি রকমের হতে পারে তা নিজ চোখে না দেখলে কল্পনাই করা যায় না। প্রাচীনযুগে বিষয়টি সাধারণ থাকলেও বর্তমান আধুনিক যুগে ব্যাপারটি তত সাধারণ নয়। আজ কর্পোরেট জগত, সংসার, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ব্যক্তিত্বের পূর্ণতা সৃষ্টিতে রূপ সচেতনতা আবশ্যকীয় স্থান দখল করেছে। এই দিক দিয়ে নারী বা পুরুষ কেউই পিছিয়ে নেই। শিশু, কিশোর, পুরুষ, প্রবীণ, খেলোয়াড় বা যে কোন পেশাজীবী এমনকি গৃহিনীরাও এখন বেশ রূপসচেতন। তাই বলা যায় সুন্দরভাবে সবার কাছে নিজেকে উপস্থাপনের কলাকৌশল প্রক্রিয়াই মূলত রূপচর্চা। তাই সমাজে সব ক্ষেত্রে নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে সবাই এখন রূপচর্চা সম্পর্কে অনেক সচেতন।
প্রসাধনের ইতিহাস সম্পর্কে পর্যালোচনা করে দেখা যায় কল্পিত দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্যে প্রাচীন যুগের মানুষেরা নিজেদের নানান রঙে-বর্ণে-অলঙ্কারে সাজিয়ে তুলত। সুরক্ষিত গুহায় মেয়েদের রেখে পুরুষরা গায়ে, মুখমন্ডলে রং-এর জাদু মেখে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বের হত শিকারে। জ্ঞানের পরিধি বাড়ার সাথে সাথে মানুষ হিংস্র পশু এবং তার চেয়ে হিংস্র ভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বা আত্মগোপন করতে তারা মুখ ও সারা শরীর চিত্রিত করা আরম্ভ করলো। এরপর সম্প্রদায় সৃষ্টির সাথে সাথে প্রসাধনের জটিলতাও বাড়লো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়,
১। প্রাচীন মিশরীয়রা শরীরে উল্কি এঁকে রাখত। তারা রেড়ির বীজ থেকে তেল বের করে গায়ে মাখতো সূর্যের আলো থেকে চামড়া বাঁচাতে। এছাড়া তারা মুখ ও চোখের পাতা রাঙাত বুনো রেড়ির তেলে সবুজ ম্যালাকাইট (তামার আকর) গুলে।
২। মিশরের বেনী হাসান নামক স্থানে রয়েছে খুমোটোপের সমাধিতে পুরাতাত্ত্বিকেরা খুঁজে পেয়েছেন এমন সব ছবি যা দেখে বোঝা যায় তখনকার দিনে দূর-দূরান্তে প্রসাধন সামগ্রীর ব্যবসা চলতো। মিশরে তখন চোখে কাজল দেয়ার প্রথা চালু হয়।
৩। ফেরাউনদের আমলে মিশরে চোখের পাতায় বা ভ্রূ আঁকতে কাজলের ব্যবহার অনেক বেড়ে গিয়েছিলো। ফারাও আখেন-আটেনের রানী নেফার তিতি সূর্মা দেয়া হরিণ চোখের জাদু দিয়ে বিচ্ছিন্ন উত্তর এবং দক্ষিণ নীল উপত্যকাকে সঙ্ঘবদ্ধ করেছিলেন এক সাম্রাজ্যের অধীনে। তৎকালীন মিশরে প্রসাধনী রং বলতে ছিলো কালো এবং সবুজ রং। রামেসিস ও টলেমিদের সময় মেয়েদের ঠোঁটে এবং কপালে গেরি মাটি বা কারমাইন-এর লাল রং প্রসাধন চালু হয়।
৪। অন্য বহু প্রসাধনের মতো উল্কি (শরীরকে রং দিয়ে চিত্রিত করা) প্রসাধনেরও উৎপত্তি প্রাচীন মিশরে- খৃস্টপূর্ব ৪ থেকে ২ হাজার বছরের মধ্যে। এরপর প্রথাটি ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর সর্বত্র। সৌন্দর্যবোধ ছাড়াও উল্কির ব্যবহার একেক দেশে একেক তাৎপর্য বহন করে। মালয়ের অধিবাসীরা কলেরার প্রতিষেধক হিসেবে শরীরে সাদা, কালো ও লাল রঙের উল্কি আঁকতো। আবার আফ্রিকার কোনো কোনো আদিবাসী নারী নিজেদের বিধবা বোঝাতে ব্যবহার করে উল্কি। অ্যামেরিয়রা বিশ্বাস করতো উল্কি দিয়ে শুধু এই জীবনে নয়, মৃত্যুর পরেও তাদেরকে ঠিক চিনে নিতে পারবে তাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবরা।
কালের বিবর্তনে আজকের সভ্য জগতেও নারীর সৌন্দর্য প্রসাধনের পাশে উল্কির প্রচলন শুরু হয়েছে। তবে সেটি প্রাচীন প্রক্রিয়ায় শারীরিক নির্যাতন সহ্য করে নয়। অত্যন্ত সহজ উপায়ে আধুনিক নারীরাও উল্কি এঁকে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে থাকেন। আজকাল বিউটি পার্লারে গিয়ে মেয়েরা হাতে, গলায়, পায়ে ও গালে ফুল ফোঁটা এঁকে থাকেন। এগুলো অতীতের উল্কিরই বিকল্প পদ্ধতি। গ্রীসে মেয়েরা শরীরে রং-এর প্রলেপ ব্যবহার করতো। গালে লাগাতো লাল রং আর মুখে এবং গায়ে সাদা রং-ও ব্যবহার করতো।
এ থেকেই হয়তোবা আধুনিক প্রসাধনে এসেছে গালে রুজ এবং ব্লাশার লাগানোর প্রচলন। আধুনিক প্রসাধনে এগুলো তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন রংয়ে। গায়ের রং অনুসারে ব্যবহার করছে আজকের নারীরা সৌন্দর্যকে আরও ফুটিয়ে তুলতে। কে না চায় গাল দুটো দেখাক আপেলের মতো। তাই তো আপেল রং-এর গাল বানাতে ব্যবহৃত হচ্ছে রুজ, ফেস পাউডার, ব্লাসারের মতো প্রসাধনী। বিশ্বের নানাদেশে বহু নামি দামি কোম্পানি প্রসাধন সামগ্রী বানাতে ব্যস্ত। প্রসাধন বিজ্ঞানীরা রীতিমতো গবেষণা চালাচ্ছেন এর মান নিয়ে। সারা বিশ্বে প্রসাধন সামগ্রীর ব্যবসা এক বিরাট লাভজনক ব্যবসা। তাই নিত্য নতুন আঙ্গিকে প্রসাধনের প্রসার ঘটছে সারা বিশ্বে। পাল্লা দিয়ে চলছে একেক কোম্পানি।
৫। ক্লিওপেট্রার অপরূপ সৌন্দর্য অধিকারিণী ছিলেন। ধাত্রী বিদ্যা ও ভেষজ বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন তিনি। ক্লিওপেট্রার মতো সুন্দরী লাবণ্যময়ী প্রসাধন বিশেষজ্ঞরা যখন ভেষজ বিদ্যার চর্চা শুরু করলেন তখন পুরোহিতদের জাদু মন্ত্র সম্পূর্ণ খসে পড়লো। তাছাড়া আজকাল মুখের চামড়া পেলব রাখতে মেয়েরা যে ‘ফেস মাস্ক’ নামক প্রসাধন ব্যবহার করে- রানী ক্লিওপেট্রাই তার প্রবর্তক। মধু, ডিমের সাদা অংশ এবং ‘গাধার খুর’ নামে এক প্রকার গাছের পাতার রস মিশিয়ে তিনিই এই প্রাকৃতিক অভিনব ফেস প্যাকটি তৈরি করতেন। প্রাচীন মিশরীয় প্রসাধনে আইবিস, বিড়াল, কুমিরের রক্ত, কাঁকড়া, বিছার লেজ, ইঁদুরের নখ, গাধার খুর ইত্যাদি যতসব উদ্ভট উপাদানের নাম পাওয়া যায়, পরবর্তীতে আবিষ্কৃত হয় যে, এগুলো হলো এক রকম উদ্ভিজ্জ্য উপাদানের আটপৌরে নাম।
৬। উপমহাদেশে রূপচর্চার ইতিহাসও একইভাবে প্রাচীন। মহাকবি কালিদাসের অমর কাব্যগুলোয় আবরণ, আভরণ ও প্রসাধনে তৎকালীন বঙ্গ ললনাদের সৌন্দর্য কিভাবে বিকশিত হয়ে উঠতো তার নিখুঁত বর্ণনা আমরা পাই। যেমন :
হস্তে লীলা কমলম্ অলকে বালকুন্দানুবিদ্ধং
নীতা লোধ্র প্রসব রজসা পান্ডুতাম্ আননশ্রীং।
চুঢ়াপাশে নবকুরু বকং চারু কনে শিরিষং
সীমন্তে চ তুদুপগমজং যত্র নীণং বধুনাম্।
মোঘল সম্রাজ্ঞীদের জন্যেই বিভিন্ন ভেষজ উপাদান দ্বারা রূপচর্চা স্বীকৃতি পেয়েছে।
৭। প্রসাধনের ব্যাপারে ইউরোপে নব জাগরণ এনেছিলো ফ্রান্স। ফ্রান্সকে সমগ্র ইউরোপের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ধরা হতো। তাই আজও ফরাসি পারফিউম সারা পৃথিবীর মধ্যে প্রথম স্থান দখল করে রেখেছে।
ইতিহাসের মত বর্তমান বাংলাদেশে সৃজনশীলতা ও মেধায় স্বকর্ম সংস্থানের মাধ্যমে এসব রূপচর্চায় এসেছে বাড়তি মাত্রা, উদ্ভাবন হয়েছে নতুন নতুন পেশার ক্ষেত্র। দেশীয় ফ্যাশন হাউস, গৃহসজ্জা ও রূপচর্চার আঙিনায় বিচরণ করছে নতুন প্রজন্ম। ফ্যাশন ডিজাইনার, বিউটিশিয়ান ইত্যাদি নতুন পেশা তৈরির মাধ্যমে নতুন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে মানুষ। দেশকে আরো সুন্দরভাবে সাজিয়ে তুলতে বর্তমান প্রজন্ম এক বিশাল কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত হয়েছে। এমনকি এই ক্ষেত্র থেকে দেশের অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখা শুরু করেছে। বিভিন্ন উৎসব আসলেই ফ্যাশন হাউসগুলো নিত্য নতুন ফ্যাশনের পসরা নিয়ে সবার সামনে হাজির হয়। প্রত্যেক বছর এই ফ্যাশন পরিবর্তন হতেই থাকে। এভাবেই আমাদের পোশাক শিল্প হয়ে উঠেছে বিশ্বমানের যার চাহিদা এখন বিদেশেও।
মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেরাও রূপচর্চার প্রসাধনী নিয়ে চিন্তা করছে। কারণ আজকের কর্পোরেট যুগে সবাইকে হতে হয়েছে স্মার্ট। অন্যদিকে গৃহসজ্জার দিকেও পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ। ইন্টেরিয়ন ডিজাইন কোম্পানীগুলো এদিক দিয়ে সৌন্দর্যকে নিয়ে গিয়েছে নতুন এক উচ্চতায়। সর্বোপরি, এর মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক তরুণ-তরুণীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।