এমন একটা সময় ছিল যখন বিনিময় মূল্য হিসেবে কড়ির প্রচলন ছিল। সেই কড়ি থেকে শুরু করে পরবর্তীতে পাঞ্চমার্কের প্রচলন হয়। যীশু খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় এক হাজার বছর আগে থেকে পাঞ্চমার্কের প্রচলন ছিল। তার পূর্বে এক পণ্য দিয়ে আরেকটি পণ্য বিনিময় হতো। পরবর্তীতে চীনে প্রথমবারের মত ধাতব মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়। এরপর বাইজেনটাই, গ্রিস, রোমান অঞ্চলে ধাতব মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়। একটি পর্যায়ে এসে চীনে প্রথমবারের মত কাগজি নোটের প্রচলন শুরু হয়ে যায়। সেখান থেকে অনেক বির্বতনের পর আস্তে আস্তে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ধাতব মুদ্রা ও কাগজি নোটের প্রচলন হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই তাদের নিজেদের ও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের সংগৃহিত মুদ্রা নিয়ে কারেন্সী মিউজিয়াম গঠিত হয়েছে। একটা সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরে ক্ষুদ্র পরিসরে কারেন্সি মিউজিয়াম ছিল। ২০১৩ সালের ৬ অক্টোবর ঢাকার মিরপুরে প্রথমবারের ন্যায় বাংলাদেশে একটি পূর্ণাঙ্গ ও সমৃদ্ধ কারেন্সি মিউজিয়াম গঠিত হয়। যার নামকরণ করা হয়েছে টাকা জাদুঘর। এর প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান। এখানে ‘টাকার গাছ’সহ বিভিন্ন শিল্পকর্মে অবদান রেখেছেন প্রথিতযশা শিল্পী হাশেম খান। এই টাকা জাদুঘরে গেলে দেখা যাবে প্রাচীন যুগ ও বর্তমান যুগের ধাতব মুদ্রা, ব্যাংক নোটসহ মুদ্রা সংরক্ষণের সকল উপকরণ। যেমন- কুষাণ রাজাদের মুদ্রা, হরিকেল রাজাদের মুদ্রা ও দিল্লির আটজন সুলতানের মুদ্রা। সুলতান আলাউদ্দীন মাসুদ শাহ, গিয়াসউদ্দীন বলবান, গিয়াস উদ্দীন তুঘলক শাহ, মুহম্মদ বিন তুঘলক, জালাল উদ্দিন ফিরোজ খলজী, আলাউদ্দীন মুহম্মদ খলজী, মইযউদ্দীন কায়কোবাদ, শামসউদ্দীন ফিরুয শাহ, গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর শাহ, ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ, আলাউদ্দীন আলী শাহ, শামস উদ্দীন ইলিয়াস শাহ, শিহাবউদ্দীন বায়াযিদ শাহ, জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ শাহ, নাসির উদ্দীন মাহমুদ শাহ, রুকন উদ্দীন বারকত শাহ, শামসউদ্দীন ইউসুফ শাহ, সাইফউদ্দীন ফিরুয শাহ, আলাউদ্দীন হুসাইন শাহ, মোগল সম্রাট আকবর, সম্রাট জাহাঙ্গীর, শিহাব উদ্দীন মুহম্মদ শাহজাহান, মুহাম্মদ শাহ, আহাম্মদ শাহ বাহাদুর, শাহা আলম, সম্রাট শাহ জাহান প্রমুখ শাসকদের সময়কার মূল্যবান মুদ্রা প্রদর্শিত হচ্ছে এই জাদুঘরে। এছাড়া এখানে আসাম রাজা রুদ্রসিংহ, শিবসিংহ, রাজেশ্বর সিংহ, লক্ষ্মী সিংহ, নরসিংহ ও গৌরীনাথ সিংহের সময়কার মুদ্রা প্রদর্শিত হচ্ছে। একই সাথে উয়ারী বটেশ্বর থেকে প্রাপ্ত পাঞ্চমার্ক টাকা প্রদর্শিত হচ্ছে জাদুঘরে। সেই সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের ম্যাপ সিরিজের দুর্লভ এক টাকা, পাঁচ টাকা, দশ টাকা ও একশ’ টাকার ব্যাংক নোট দেখতে পাওয়া যাবেই এখানে। দর্শনার্থীরা টাকা জাদুঘরে গেলে আরো দেখবেন বিশ্বের একশ’ বিশটি দেশের ব্যাংক নোট। এছাড়া একাধিক বিলুপ্ত দেশের ব্যাংক নোট টাকা জাদুঘরে প্রদর্শন করা হচ্ছে। যেমন- বৃটিশ ইন্ডিয়া, বৃটিশ বার্মা, বৃটিশ সিলন, জাপান বার্মা, জাপান ফিলিপাইন, চেকোস্লোভাকিয়া, যুগোস্লোভিয়া, ট্রান্সনেশিয়াসহ প্রাচীন চীনসহ একাধিক দেশের ব্যাংক নোট। বিশ্বের সবচেয়ে ছোট জার্মানির ব্যাংক নোট যেমন দেখতে পাওয়া যায়, তেমনি রাশিয়ার তৈরি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যাংক নোটেরও দেখা মেলে। দেখা মেলে পুর্তগিজ ইন্ডিয়া, পর্তুগিজ কেপভারদে, পর্তুগিজ মোজাম্বিক, কাতাংগা, ব্রিটিশ ইস্ট আফ্রিকা, মাস্কাট ও ওমান, কাতার অ্যান্ড দুবাই, রোডেশিয়া, জানজিবার, বৃটিশ ইন্ডিয়া, ইস্ট এন্ড ওয়েস্ট পাকিস্তানের ধাতব মুদ্রাও।
প্রতিদিন গড়ে প্রায় দুইশ’ পঞ্চাশ জন দর্শনার্থী টাকা জাদুঘর পরিদর্শন করছেন। টাকা জাদুঘর পরিদর্শন করতে কোনো প্রবেশ ফির প্রয়োজন হয় না। শিক্ষার্থী ও গবেষকরা টাকা জাদুঘর পরিদর্শন করে নিজেদের জানার পরিধিকে আরো বাড়াচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের দিক-নির্দেশনায় পরিচালিত হচ্ছে জাদুঘরটি। তাকে সহযোগিতা করছেন, ডেপুটি গভর্নর এস. কে. সুর চৌধুরী, ডেপুটি গভর্নর আবুল কাশেম, নির্বাহী পরিচালিক শুভঙ্কর সাহা ও উপ-মহাব্যবস্থাপক পরিমল চন্দ্র চক্রবর্তী। টাকা জাদুঘরকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এক সময়ে জাতীয় জাদুঘরের কিপার মুসলিম মুদ্রা গবেষক ড. রেজাউল করিম, উপ-মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ইসমাইল, উপ-পরিচালক খন্দকার আনোয়ার শাহাদাত ও কিপার ড. আছিয়া খানম। মাজার ব্যাপার হলো, এই জাদুঘরে পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে এক লক্ষ টাকার একটি স্মারক ব্যাংক নোটে দর্শনার্থীরা নিজেদের ছবি তুলে নিতে পারেন। এছাড়া টাকা জাদুঘরে একটি সেলস সেন্টার রয়েছে। এখানে স্বাধীন বাংলাদেশের সকল স্মারক ব্যাংক নোট ও স্মারক ধাতব মুদ্রা কেনা যায়। শনি থেকে বুধবার সকাল ১১.০০টা থেকে বিকাল ৫.০০টা পর্যন্ত টাকা জাদুঘর খোলা থাকে। বৃহস্পতিবার বন্ধ। শুক্রবার বেলা ৪.০০টা থেকে সন্ধ্যা ৭.০০টা পর্যন্ত সবার জন্য খোলা থাকে। দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে নিচতলায় আছে একটি কয়েন ক্যাফে। মিরপুর-১০ গোলচক্করে এসে সেখান থেকে মিরপুর-২ কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালের পাশেই অবস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং একাডেমি। এই একাডেমির ২য় তলায় অবস্থিত এই টাকা জাদুঘরটি। এর বিভিন্ন উপাদান ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। ঢাকার সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও সমৃদ্ধিতেও জাদুঘরটি ভূমিকা রাখছে।