সময়টা নভেম্বর ২০০১, বয়স মাত্র ১৮ বছর। ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হোম সিরিজ। ডাক পেলেন কৌশিক। বাংলাদেশ এ দলের হয়ে একটি মাত্র ম্যাচ খেলেছেন তখন। তবে অনুর্ধ ১৯ দলের হয় খেলার সময় কৌশিকের গতিময় ও আক্রমনাত্বক বোলিংয়ের জন্য নজর কাড়েন তৎকালীন অস্থায়ী কোচ ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাবেক ফাস্ট বোলার এন্ডি রবার্টসের।
এ দলে জায়গা পান তিনি ঐ রবার্টসের সুপারিশেই। তবে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি আজকের “নড়াইল এক্সপ্রেস” নামে খ্যাত ম্যাশকে। তার অসাধারণ পারদর্শিতা দেখানোর সুবাদে জাতীয় দলে সুযোগ পেয়ে যান ম্যাশ।
৮ নভেম্বর ২০০১, ভাগ্যের চাকা যেন খুলে গেল ছোট্ট মাশরাফির। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বল হাতে নামতে হবে তাকে। জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ তাও আবার টেস্ট!
একটু ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। কারন প্রতিপক্ষ দলে এন্ড্রু ফ্লাওয়ার, গ্রান্ট ফ্লাওয়ার, ক্রেইগ উইশার্ট এর মত মস্তবড় ব্যাটসম্যান রয়েছে পাশাপাশি বল হাতে হিথ স্ট্রিক তো আছেই। মাশরাফি ভীতু নন, উদ্দাম সাহস নিয়ে ১৯ তম টেস্ট ক্যাপ পরে সবুজ গালিচায় নেমে পড়লেন সঙ্গে খালেদ মাহমুদ সুজনেরও অভিষেক ঘটলো। জীবনের প্রথম ইনিংসে ব্যাট হাতে ২২ বলে ৮ রান করে হিথ স্ট্রিক এর বলে এন্ড্রু ফ্লাওয়ারের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরলেন সাজঘরে। পরে বল হাতে পেলেন সাফল্য ৩২ ওভারে ৮ মেডেন ১০৬ রান দিয়ে নিলেন ৪ উইকেট! ফলাফল ম্যাচ ড্র।
৫ অক্টোবর ১৯৮৩, নড়াইল জেলায় জন্মগ্রহণ করেন আজকের মাশরাফি। ছোটবেলা থেকে মাশরাফি ছিলেন দুরন্ত। লেখাপড়া ভালোভাবে মনোযোগ না দিয়ে বাবা গোলাম মর্তুজার বাধা ডিঙিয়ে ফুটবল, ব্যাডমিন্টন নিয়ে পড়ে থাকতেন আর পাশাপাশি বাড়ির পাশে চিত্রা নদীতে সাতার কাটাই ছিলো তার আসল কাজ। বন্ধুদের সাথে ঘুরাঘুরি করা, নারিকেল গাছে উঠে ডাব খাওয়া, নড়াইলের ফেরিঘাটে গিয়ে আড্ডা মারা ছিলো তার অন্যতম কাজ।আর এখনকার সময়ে গ্রামের বাড়ি নড়াইলে গেলে বাইক নিয়ে চিত্রা ব্রিজের উপর আড্ডা দিয়ে সময় পার করেন মাশরাফি।
মাশরাফি তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের অধিকাংশ সময়ই কাটিয়েছেন ইঞ্জুরীতে। তবুও থেমে থাকেননি বারবার ফিরে এসেছেন নতুনভাবে আলোকবর্তিকা হয়ে। সাত বার হাঁটুতে অস্ত্রোপচারের পরও তিনি এখনো খেলে যাচ্ছেন স্বাধীনভাবেই শুধু দেশের জন্য অতি ভালোবাসার কারনে। হাঁটুর একটি লিগমেন্টও নাই সবই ছিঁড়ে গিয়েছে আগেই। কোনো ইঞ্জুরীই যেন মাশরাফিকে আটকে রাখতে পারেনি।
২০০৯ সালে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ আইপিএলে ডাক পান তিনি সৌরভের কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে খেলার জন্য। একটি ম্যাচ খেললেও ভালো করতে পারেননি।
২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ থেকে অধিনায়কের দায়িত্ব কাধেঁ ওঠে ম্যাশের। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, প্রথম ম্যাচেই মারাত্বক ইঞ্জুরীতে পড়েন তিনি। কিন্তু দেড় বছর পর আবার স্বরুপে ফিরে আসার ইঙ্গিত নিয়ে ইউরোপ সফরে যান দলের সাথে। ইংলান্ড কে প্রথম বারের মত বাংলাদেশ পরাজিত করে মাশরাফির অধিনায়কত্বে। কিন্তু এরপর আবার ইঞ্জুরীতে, যার কারনে খেলা হয়নি ঘরের মাঠের ২০১১ বিশ্বকাপেও!
টাকার জন্য খেলেননা মাশরাফি বরং দেশের জন্যই মরিয়া হয়ে খেলেন। এমনও দিন গেছে যে ব্যাথার ইনজেকশন নিয়েই মাঠে নেমে গেছেন শিশুসুলভ মাশরাফি।
একদিন মাশরাফি বলেছিলেন ” জীবনে যে টাকা আমি আয় করেছি সে টাকা দিয়ে আমার ছেলেমেয়েরাও পর্যন্ত বসে খেতে পারবে, আমি দেশের জন্য ক্রিকেট খেলি, আমি আরো অনেক দিন ক্রিকেট খেলতে চাই দেশের স্বার্থে “
২০০৭ সালের বিশ্বকাপের সময় ভারতের যুবরাজের একটি কথা মনে পড়ে, ” ২০০৭ এর বিশ্বকাপে আমরা যখন সবাই মোহাএটাই আমাদের মাশরাফি। যার মত ক্রিকেটার বারবার এদেশে আসেনা, যুগে যুগে একজনই আসে। সন্মান জানই তার প্রতি হাজার সালাম।ম্মাদ রফিকের বোলিং নিয়ে ভাবছিলাম আর দলে খুব গবেষণা চলছিল তখন শচিন বলেছিল মাশরাফির উপরও নজর রাখতে হবে,ও ভয়ংকর । তখন ভাবিনি এতোটা ভয়ংকর “। সৌরভ গাঙ্গুলী বলেছিলেন “ইশ! আমাদের যদি একটি মাশরাফি থাকতো! “
২০০৫ সালের অষ্টোলিয়া সিরিজের সময় ড্রেসিংরুম থেকে মাশরাফিকে ডাক দেয় এক সাংবাদিক। তিনি অষ্ট্রেলিয়ার হয়ে ম্যাশকে খেলতে বলেন। কিন্তু ম্যাশ রাজি হননি। পরে আরেক বার ভারতের দুজন সাংবাদিক বলেছিলেন আমরা তোমাদের দুজন ভালো ব্যাটসম্যান দিব তোমরা শুধু মাশরাফিকে দিয়ে দাও। যদিও সেদিন কিছুটা মন থেকেই বলেছিল ওই সাংবাদিকেরা। কিন্তু মাশরাফি কোনো কথাই প্রশ্রয় দেননি সেদিন। দেশের জন্য জীবন দিয়ে হলেও খেলতে তিনি সবসময়ই প্রস্তুত।