জনপদের নাম কুমিল্লা। গোমতী পাড়ের শহর। ত্রিপুরার রাজারা এক সময় এ শহরের গোড়াপত্তন করেছিল গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপন কেন্দ্র হিসেবে। গোমতী পাড় বলে এ জনপদের সুখ্যাতি রয়েছে। ব্যাংক ও ট্যাংকের (পুকুর) শহর কুমিল্লা। তার পাশঘেঁষে গড়ে উঠেছে কমলাংক বা বর্তমান নাম কুমিল্লা। দক্ষিন এশিয়ার স্বপ্ন আয়তনের একটি দেশ হলেও পর্যটন শিল্পের বিচিত্রশাখায় সমৃদ্ধ এ জেলা। বিরল সৌন্দর্য এবং সভ্যতার আদি নিদর্শন এ অঞ্চলের মানুষের বর্ণাঢ্য জীবনধারা প্রকৃতির এ রূপ দেশী-বিদেশী ভ্রমন বিলাসীদের চিরকাল আকর্ষন করেছে। কুমিল্লা শহরের বুকজুড়ে রয়েছে আদি নিদর্শন বিহার, শালবন রুপবানমুড়া, ইটাখোলামুড়া, ময়নামতি ঢিবি, রানীর বাংলো, ময়নামতি জাদুঘর আরও আছে অপূর্ব প্রাকৃতিক ঘেরা সবুজ বৃক্ষবেষ্টিত লালমাটির লালমাই পাহাড়।
প্রাচীন সভ্যতার নীরব সাক্ষী ময়নামতি লালমাই : কুমিল্লা শহর থেকে ৮ কি.মি. পশ্চিমে অবস্থিত। টিলাগুলোর উত্তর অংশে ময়নামতি দক্ষিনে লালমাই। মাটির রঙ লাল ও টিলাগুলো ঢালু। ১৮৭৫ সালের আগ পর্যন্ত সব ছিল অজানা। বর্তমান কোটবাড়ি এলাকার রাস্তা তৈরির সময় ছোট ইমারতের ধ্বংসাবশেষে উন্মোচিত হয়ে পড়ে। ভূমির ওপর অসংখ্য কাঠের ফসিলের টুকরো দেখতে পাওয়া যায় যা র্ভূমগুলীয় পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে। ১৯১৭ সালে অধ্যক্ষ নলিনী কান্ত ভট্টশালী রনবংকমল¬ হরিকেল দেবের তাম্রশাসন (খ্রিস্টীয় তের শতক) উল্লেখিত দুর্গ বিহার পরিবেষ্টিত পট্টিকরা নগর বলে শনাক্ত করেন। প্রত্মতাত্ত্বিক খননের ও জরিপের ফলে মূল্যবান স্থাপত্যিক নিদর্শন আবিস্কৃত হয়।
শালবন বিহার : কালিবাজার সড়ক ধরে কুমিল্লা শহর থেকে কোট বাড়ি এসে দক্ষিন দিকগামী রাস্তা দিয়ে ১.৫ কিলোমিটার এগিয়ে গেলে শালমানপুর গ্রামে পৌঁছার পর হাতের বামে শ্রী ভবদেব মহাবিহার। কালের পরিক্রমায় গ্রামের নামানুসারে শালবন বিহার নামকরন হয়। তবে সংক্ষিপ্ত পরিচয়ে যেটা পাওয়া যায় ১৯৫৫-৬৮ সাল পর্যন্ত খনন কাজ পরিচালনার ফলে ছয়টি বসতি আমরে চিহ্নসহ একটি বর্গাকার বিহারের ভেতর প্রবেশের জন্য উত্তরবাহুর মাঝখানে একটি তোরন আছে। বিহারের প্রথম বসতি আমল খরগও রাত। খোলা চত্বরের মাঝখানে বিহারের তোরনের সিঁড়ি থেকে দক্ষিনে কেন্দ্রীয় মন্দিরের অবস্থান। মন্দিরটি ক্রুসাকার ভূমি পরিকল্পনায় নির্মিত। এই মন্দির পরিকল্পনাকে ইন্দোনেশিয়ায় জাভায় অবস্থিত কলসন মন্দির (৭৭৮ খ্রি.) মায়ানমার প্যাগানের আনন্দ মন্দির (১০৯০ খ্রি.) এবং বাংলাদেশের সোমপুর বিহার, পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের স্থাপত্যর কলার উৎস সূত্র হিসেবে গণ্য করা যায়। প্রদক্ষিণ পথের সঙ্গে খামওয়ালা হল ঘর সিঁড়ি গলিপথ ভজনালয় এবং ভজনালয় কোটাটিতে কুলিঙ্গসহ আসনের সংস্থান আজ ও অক্ষত রয়েছে। হলঘরের দক্ষিনে মূর্তি কোটার অবস্থান এবং রাখার জন্য বেদিও ছিল। চারপাশে রয়েছে প্রদক্ষিন পথ। কালের পরিক্রমায় মন্দিরের পরিসর কমে আসে। উল্লেখ্য, প্রত্যেক আমলে মন্দিরে ঢোকার জন্য উত্তর দিক থেকে সিঁড়ি ব্যবস্থা এবং চারপাশে ঘেরার উপযোগী পথের অস্তিত্ব ছিল বলে অনুমান করা যায়।
বার্ড : এখানে ঘুরতে আসা অনেক পর্যটকই বার্ড প্রতিষ্ঠানটির নাম শুনলে ভাবেন এখানে অনেক অনেক পাখি থাকবে। যেমন নাম তেমনটা হওয়া উচিত। এর আশা দুইই। ছায়া সুনিবিড়ি মমতা ঘেরা রাস্তা। দু’পাশে নানা রকমের নানা রংয়ের ফুল ও ফলের বাগান। পাখির কূজন আর ফুলের গন্ধে চারদিক ঘিরে রেখেছে বার্ডকে। কিস্তর সবুজের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে কৃষ্ণচূড়া আর রঙ্গন। এ অপরূপভার গড়ে তোলেন ড. আখতার হামিদ খান। বার্ড মূলত বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত মানুষের প্রশিক্ষন একাডেমি।
ওয়ার সিমেন্টি : ১৯৪১-৪৫ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ৭৩৭ জন সৈনিকের সমাধি ক্ষেত্র ময়নামতি। সবুজ বনানী আর ফলে ফুলে ভরা বাগানও বিশালকার স্তম্ভ। আশ্চর্য এবং লক্ষ্যনীয় বিষয় এই যে, বেশির ভাগ সৈনিকের বয়স ছিল ২০ থেকে ২২ বছর। জীবনের শুরুটা যখন ঠিক তখনই যুদ্ধে মহীয়ান তারা বীর সৈনিক। দেখা যাবে শহরের শুরুতেই খাবার পথে রাস্তার বাম দিকে।
ময়নামতি জাদুঘর : বাংলাদেশে বেশ কয়টি জাদুঘর আছে তার মধ্যে ময়নামতি উল্লেখযোগ্য। এ জাদুঘরে স্থান পেয়েছে (খ্রি : অষ্টম শতাব্দীর) শ্রী ভবদেব মহাবিহার, কোটিলা মুড়া, চাপত্র মুড়া, রুপবান মুড়া, ইটাখোলামুড়া আনন্দবিহার, রানীর বাংলো ও ভোজ রাঙার বাড়ি ইত্যাদি থেকে উদ্ধারকৃত মূল্যবান পুরাবস্ত। জাদুঘরটি আকারে নির্মিত এবং পাশে বিশ্রাগার আছে ও ফুলের বাগান দিয়ে ঘেরা সবুজে সবুজে।
ইটখোলা মড়া : উত্তর পশ্চিম কালিবাজার সড়কের সংলগ্ন উত্তর কোটবাড়ি এলাকায় অবস্থিত। পাশাপাশি দুটি প্রাচীন প্রতœস্থাপনার ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। এগুলো একটি মন্দির ও অপরটি বিহার। আবি®কৃত পুরাবস্তুগুলোর মধ্যে চুনবালিজাত উপকরনে তৈরি একটি বড় আকারে লোকত্তর বৃদ্ধ (আবক্ষ অংশ ব্যতীত) আজও বিদ্যমান। রূপবানমুড়া ইটাখোলা মুড়ার দক্ষিনে কালিবাজার সড়কের ওপারেও রুপবান মুড়া। টিলাটি সড়ক পথ থেকে ১১. মি উঁচুতে। তিনটি বসতি আমলের অস্তিত্ব রয়েছে এই শৈলিতে। রুপবান মুড়া ক্রুসাকার ভূমি পরিকল্পনায় নির্মিত। পেছনের অংশটি মূর্তিকোঠা এবং সামনেরটি মণ্ডপ। মূর্তির চারদিকে ঘোরানো পথ আছে। প্রত্মমানের বিচারে মন্দির ও বিহারটি খ্রি. অষ্টম শতাব্দীর নির্মিত যা আজও কালের সাক্ষী।
ধর্ম সাগর : ত্রিপুরা রাজ্যের অধিপতি মহারাজ ধর্মানিক্য ১৪৫৮ সালে জনগনের পানি ও জলের সুবিধার জন্য এ দীঘি খনন করেন। দীঘির একপাশে তাম্রলিপি পাঠ আছে ফলকে। বিশ্রামের জন্য রয়েছে বেদি যা অবকাশ নামে পরিচিত। দীঘিটির বাম পাস ঘেঁষে রয়েছে ড. আখতার হামিদ খানের বাংলো যা রানীকুঠির নামে পরিচিত। এছাড়াও রয়েছে যার অবদানে বাংলা আজ বাংলা নামে পরিচয় এমন কৃতী সন্তান ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের বাড়ি, বিপ্লবী অতীন্দ্র মোহন সেনের বাড়ি এবং রয়েছে নজরুল ইসলামের কুমিল্লা জীবনের অনেক স্বাক্ষর। বলা যায় শিক্ষা শিল্পসাহিত্য সংস্কৃতির পাদপীঠে কুমিল্লা প্রাচীন ঐতিহ্য সমৃদ্ধ হিসেবে এ উপমহাদেশে সুপরিচিত। এছাড়াও রয়েছে তার ব্যাংক ট্রাংক রোড নাম, খাদিশিল্প, তাঁত কুঠির, মৃত কারুশিল্প, রসনার তৃপ্তির জন্য রসমালাই আর রয়েছে ভাললাগার শীতলপাটি যা আজও আপন আলোয় শহরটিকে সমৃদ্ধ করেছে। কুমিল্লায় বিভিন্ন স্থানে যেতে যেতে অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্যের মুখোমুখি হবেন আপনি। এভাবে কেটে যাবে অনেকটা সময়। অবসর যাপনের এমন চমৎকার জনপদ পাওয়া দুষ্কর।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা সায়েদাবাদ থেকে একাধিক বাস ছেড়ে যায় কুমিল্লার স্টেশন শাসনগাছার উদ্দেশ্যে। ভাড়া ১১০-১৩০। তারপর সেখান থেকে আপনি সহজেই যেতে পারবেন এই সব দেখতে।