পৃথিবী বিখ্যাত পুরাকাহিনীর দেশ গ্রীস, প্রাচীন কল্পনার স্বপ্নভুমি গ্রীস। স্বতন্ত্র সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ ইউরোপের এই দ্বীপ দেশটি মানুষকে মোহিত করেছে যুগে যুগে। প্রাচীন সভ্যতার সেই স্বর্ণযুগ এখন আর না থাকলেও তার রত্নরাজি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দেশটি জুড়ে। আর আপনি তা সবচাইতে বেশি উপভোগ করতে পারবেন সান্তোরিনি দ্বীপে গিয়ে।
আগ্নেয়গিরি থেকে উৎপত্তি হয়েছে গ্রীসের এই দ্বীপটির। এর আনুষ্ঠানিক নাম আসলে “থেরা” অথবা “থিরা” কিন্তু সাধারণত একে সান্তোরিনি বলেই ডাকা হয়। এর পূর্বে এই দ্বীপটির নাম ছিল ক্যালিস্টে এবং স্ট্রঙ্গাইলে। গ্রীসের মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দক্ষিণপূর্বে অবস্থিত ছোট্ট এই দ্বীপে রয়েছে নতুন-পুরনো ধাঁচের বেশ কিছু গ্রাম। এখানে গিয়ে আপনি যেমন পুরনো আমলের গ্রীসের স্বাদ অনুভব করতে পারবেন, তেমনই আধুনিক সব সুযোগ সুবিধার মাঝে থেকে আপনার ভ্রমণ উপভোগ করতে পারবেন। সাদা রঙের বাড়ি দিয়ে ভরে আছে পুরো শহর। বাড়িগুলোর ছাদ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নীল। এই দুই রঙের মিশেলে মনে হয় সাগর থেকে উঠে এসেছে এই দ্বীপের বাড়ীগুলো। শুধু এই শহরই নয়। পুরো সান্তোরিনিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো অনেক কিছুই।
সান্তোরিনিতে গেলে প্রথমে আপনার বেড়াতে যেতে হবে থেরা নগরীর প্রাচীন অংশটিতে। কামারি অঞ্চল থেকে পেরিসা অঞ্চলকে আলাদা করে রেখেছে এই থেরা। খ্রিস্টপূর্ব ৯ম শতাব্দিতে ডোরিয়ান জাতির মানুষের দ্বারা স্থাপিত হয় এই নগরী। প্রাচীন গ্রীসিয়, রোমান এবং বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে ভরপুর এই অঞ্চলটি।
এর রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই আপনি দেখতে পাবেন প্রাচীন রোমান ধাঁচের স্নানঘর, মোজাইকের বাড়ি এমনকি একটি দর্শনীয় “অ্যাগোরা” বা বাজার। আর এখানে যখন গ্রীক দেবতা অ্যাপোলোর সম্মানে উৎসব পালন করা হয় তখন এই শহরের সৌন্দর্য আপনার চোখ ধাঁধিয়ে দেবে! সাধারণত মঙ্গলবার থেকে রবিবার সকাল সাড়ে আটটা থেকে দুপুর তিনটা পর্যন্ত এই এলাকাটি উন্মুক্ত থাকে দর্শনার্থীদের জন্য।
সান্তোরিনি যে আগ্নেয়গিরি থেকে তৈরি হয়েছে তার আকৃতি হল “ক্যালডেরা” বা হাঁড়ির মতো। এর উঁচু দেয়াল এখনও কিছু স্থানে টিকে আছে এবং ঢালু হয়ে সমুদ্রে নেমে গেছে। উত্তরের “ওইয়া” শহর থেকে ৩০০ ধাপ নেমে গেলে আপনি ছোট্ট আমৌদি উপসাগরে নেমে যেতে পারবেন এবং ক্যালডেরার সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। নিরিবিলি এই আমৌদি উপসাগরে মাছ ধরা হয় এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কিছু দোকান যেখানে আপনি টাটকা মাছ দিয়ে তৈরি খাবার খেতে পারেন। পানি থেকে অল্প দূরত্বে বসেই আপনি উপভোগ করতে পারেন সান্তোরিনির সবচাইতে অপূর্ব সূর্যাস্ত।
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে ভরা আরেকটি এলাকা হল আক্রোতিরি। দ্বীপের দক্ষিণ দিকে ক্যালডেরার পাড় দিয়ে এর অবস্থান। এটা প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৯৬০ এর শেষের দিকে। খ্রিস্টপূর্ব ১৬শ শতকের দিকে এর ভবনগুলো তৈরি হয়েছিল বলে মনে করা হয়। অগ্ন্যুৎপাতের ফলে অনেকাংশে ধ্বংস হয়ে গেলেও বছরের পর বছর খননকার্যের মাধ্যমে একে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে এবং এখন এই এলাকাটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। এখানকার বাড়িগুলোতে দেখতে পাওয়া যায় প্রাচীন সব ফ্রেস্কোর নকশা এবং মৃৎপাত্র। কোনও দুর্ঘটনায় দর্শনার্থীরা যাতে আহত না হয় সেই উদ্দেশ্যে এই এলাকার ওপরে একটি নিরাপদ ছাদ তৈরির প্রক্রিয়া চলছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি প্রত্নতত্ত্ব এবং ইতিহাসের প্রতি যদি আপনার আগ্রহ থেকে থাকে তাহলে আপনি চলে যেতে পারেন প্রিহিস্টোরিক থিরা মিউজিয়ামে। থেরার কেন্দ্রের এই ছোট্ট মিউজিয়ামটিতে রয়েছে আক্রোতিরির খননকার্যের সময়ে প্রাপ্ত সব নিদর্শন এমনকি হাজার বছর আগের অন্যান্য অনেক নিদর্শনও আছে। এক ঝলকের জন্য আপনাকে অতীতে ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে পারে এই মিউজিয়াম। আর সান্তোরিনির সামুদ্রিক ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চাইলে যেতে পারেন ওইয়া শহরের থিরা মেরিটাইম মিউজিয়ামে।
সান্তোরিনির মতো একটি দ্বীপে এসেছেন আর এর সমুদ্রসৈকতে বেড়াবেন না তাই কি হয়? আগ্নেয়গিরি থেকে উৎপত্তি হবার কারণে সান্তোরিনির সৈকতগুলোর রয়েছে বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এর মাঝে একটি হল কামারি সৈকত। ফিরা শহর থেকে প্রায় চার মাইল দক্ষিণপূর্বে অবস্থিত সূক্ষ্ম কালো বালির এই সৈকতটি সান্তোরিনির সবচাইতে বড় সৈকত। ভ্রমনবিলাসিদের জন্য কামারি হল এই দ্বীপের সবচাইতে বড় আকর্ষণ কারণ এখানেই রয়েছে সবচাইতে বেশি হোটেল, রেস্ট্যুরেন্ট, দোকান ইত্যাদি। তবে এই সৈকতের সমস্যা একটাই, আর সেটা হলো এখানে বড্ড ভিড় হয়। ভিড় এড়াতে চাইলে আপনি যেতে পারেন রেড বীচে। অগ্ন্যূৎপাতের লাল বালি জমে থাকার কারণে এর এই নাম। আক্রোতিনি যাবার রাস্তার শেষ মাথায় এর অবস্থান। তবে এখানে যাবার সবচাইতে সহজ উপায় হল নৌকো।
এত কিছুতেও যদি আপনার মন না ভরে তবে ভোজনরসিকদের জন্য রয়েছে ব্যবস্থা। গ্রীসের প্রতিটি অঞ্চলেরই রয়েছে নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যের বিভিন্ন খাবার। সান্তোরিনিতে পর্যটকদের জন্য রাস্তায় রাস্তায় বিক্রি হয় জাইরো পিটা স্যান্ডউইচ। আর এ অঞ্চলের আগ্নেয়গিরি থেকে উদ্ভুত মাটির কারণে এখানকার ফল এবং সব্জির স্বাদেও রয়েছে ভিন্নতা। মূল ভূখণ্ড থেকে অন্যরকমের খনিজ চলে আসে গাছের শরীরে। এ কারণে এখানকার খাবার এবং ওয়াইন এর রয়েছে অন্যরকম কদর।