Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.
Lifestyle Image

ভ্যালেন্টাইন ডেঃ একটি মানবিক প্রেমের ইতিহাস



সব থেকে বেশি জনপ্রিয় হয়েছে বোধ হয় ১৪ই ফেব্রুয়ারী ভ্যালেন্টাইন ডে বা প্রেমিক-প্রেমিকা দিবস। আসলে প্রেম নিরন্তন ও চির নবীন। সে মানে না স্থান-কাল-পাত্র, ভূ-খন্ড। যুদ্ধের রক্তভূমিতেও দুটি বিপরীত লিঙ্গের মানুষ একে অপরকে খুঁজতে থাকে দৃঢ়বদ্ধভাবে বাঁচার স্বপ্নে। তাই এই দিনটি জনপ্রিয় হয়েছে সন্দেহ নেই। এই প্রেমের সাথে শরীরী একটা সম্পর্ক আছে বলেই এই দিনটি নিয়ে বিতর্কও কম নেই। অনেকের মতে এই দিনটি যুব সমাজের সর্বনাশ ডেকে আনছে। অবশ্য এই ধারনাটিও মিথ্যে নয়। কারন এই দিনটিতে যতটা না হৃদয়ের আকর্ষণ থাকে, তার চেয়ে বেশি শরীরী আহ্বান ও বানিজ্যিক উপহারের লেনাদেনা। তার প্রমাণ এই ১৪ই ফেব্রুয়ারীকে ঘিরে সপ্তাহ ব্যাপী এত অদ্ভূত ডে-এর ঘোষনা। যার কোনো উদ্দেশ্য নেই, সমাজে সার্থকতাও নেই। ৭ই ফেব্রুয়ারী ‘রোজ ডে’, ৮ই ফেব্রুয়ারী ‘প্রোপোজ ডে’, ৯ই ফেব্রুয়ারী ‘চকলেট ডে’, ১০ই ফেব্রুয়ারী ‘টেডি ডে’, ১১ই ফেব্রুয়ারী ‘প্রমিস ডে’, ১২ই ফেব্রুয়ারী ‘কিস ডে’, ১৩ই ফেব্রুয়ারী ‘হাগ ডে’, ১৪ই ফেব্রুয়ারী ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’। এই দিনগুলি অর্থাৎ ৭ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারী পড়লেই বোঝা যায় দিনগুলির সেই অর্থে সামাজিক তাৎপর্য নেই। কিন্তু ১৪ই ফেব্রুয়ারীর কথা সম্পূর্ণ আলাদা। এর সাথে জড়িয়ে আছে এ মর্মান্তিক মানবতার ইতিহাস- বিশ্ব প্রেমের ইতিহাস। একঝলক দেখে নেওয়া যাক সেই ইতিহাসের প্রেক্ষাপট-এই ঘটনার সময়কাল আজ থেকে দু’হাজার বছর আগে ২৬৯ খ্রীষ্টাব্দের সমসাময়িক। তখন রোমে ‘জুনো’ দেবীর আরাধনা উপলক্ষে এক উৎসব ছিল যার নাম লিউপার কেলিয়া। ‘জুনো’ ছিলেন প্রেমের দেবী। লিউপার কেলিয়া ছিল সেই প্রেমের বন্ধনের উৎসব। উৎসবটি মজার। একটা কাঁচের জারে অবিবাহিত মেয়েরা তাদের নাম কাগজে মুড়ে রেখে দিতেন। অবিবাহিত পুরুষেরা এ জার থেকে একটি করে নাম তুলে নিয়ে ওই মেয়ে সাথে এক সপ্তাহ মেলামেশার সুযোগ পেত। যদি তাদের মনের মিলন হত তাহলে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হত, না হলে আবার পরবর্তী বছরের জন্য অপেক্ষা। এই আনন্দময় উৎসবের সূচনাকাল ছিল ১৪ই ফেব্রুয়ারী।
এই জনপ্রিয় উৎসবে এক সময় নেমে এল রাজতন্ত্রের কালো ছায়া। রোমান স¤্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস সব দেবদেবীর আরাধনা বন্ধ করে নিজের ধর্মই রাষ্ট্রধর্ম বলে ফতোয়া জারি করেন। এই স¤্রাট ছিলেন খুবই যুদ্ধপ্রিয়। তাই এই লিউপার কেলিয়া উৎসবের ওপর তাঁর বিশেষ রোষানল ছিল। কারন অধিকাংশ যুবক বিবাহিত জীবন বেছে নেওয়ার যুদ্ধে যেতে চাইত না। ফলে সেনার অভাব পূরণ করতে তিনি বিবাহও নিষিদ্ধ করেন। এর অবমাননায় চরম শাস্তি পেতে হত।
যে কোনো ধর্মেই যখন কোনো করাল ছায়া আসে তখনই আবির্ভাব হয় মহামানবের। এখানেও একজন ধর্মযাজক আবিভূর্ত হলেন যার নাম সন্ত ভ্যালেন্টাইন। তিনি এই রাজধর্মের তীব্র বিরোধীতা করেন। আমি আগেই বলেছি, রক্তভূমিতে দাঁড়িয়েও জন্ম নেয় প্রেম। এখানেও তাঁর ব্যতিক্রম হয়নি। প্রেমিক-প্রেমিকারা গোপনে এই ধর্ম যাজকের কাছে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতেন স্থানীয় গীর্জায়। এভাবে যুব সমাজের একটা বিরাট অংশ সন্ত ভ্যালেন্টাইনের অনুগামী হয়ে পড়ে তরুন বয়স্ক ধর্মযাজক ভ্যালেন্টাইনের অনুগামীদের দেখে ক্লডিয়াস রাগে জ্বলে ওঠেন। অন্তরে ভয়ও দেখা দেয়। তাই তাকে প্রেপ্তারের ফতোয়াজারি করা হয়। আচমকাই একদিন এক যুবক-যুবতীকে বিবাহ দেবার সময় ধরা পড়ে যান সন্ত ভ্যালেন্টাইন। তাঁর বন্দীতে যুব সমাজের মধ্যে চাপা অসন্তোষ দেখা দেয়। সেই অসন্তোষ যাতে না ছড়ায় সেজন্য সন্ত ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদন্ড জারি করা হয়। মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামীকে এক নির্জন কুঠুরিতে কড়া প্রহরায় রাখা হয় যাতে তার সাথে কেউ দেখা না করতে পারে। এখানেই ঘটে এক আশ্চর্য ঘটনা। ভ্যালেন্টাইনকে যিনি পাহারা দিতেন সেই পাহারাদারের মেয়ে প্লাতিনা ছিল জন্মান্ধ। তাছাড়াও মাঝে মধ্যে তীব্র মাথা যন্ত্রনায় কষ্ট পেতেন। এমনই প্রহরাকালে প্রহরীর বাড়ি থেকে খবর আসে মৃত্যুসম যন্ত্রনায় কষ্ট পাচ্ছে প্লাতিনা। প্রহরী একবার তাকায় সন্ত ভ্যালেন্টাইনের দিকে। তিনি নাকি অলৌকিক ক্ষমতায় অধিকারী। প্রহরীও একজন পিতা। ভুলে যায় রাজ নির্দেশ। গোপনে যন্ত্রণা-গ্রস্ত মেয়েকে নিয়ে আসে সন্ত ভ্যালেন্টাইনের কাছে। সন্ত ভ্যালেন্টাইন প্লাতিনার কপালে হাত রাখতেই মাথা যন্ত্রণা নিমেষে উধাও হয়ে যায়। কী হয়েছে প্রহরী জানতে পারে ন্ াপ্লাতিনা যখন ফিরে আসে তার মুখে তখন এক দিব্য হাসি।
এরপর প্লাতিনাকে প্রায় প্রতিদিন সন্ত ভ্যালেন্টাইনের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। নিভূতে কী কথা হয়, কেউ জানতে পারে না। মাথা যন্ত্রণাও চিরতরে ঠিক হয়ে যায়। এদিকে স¤্রাট ক্লডিয়াস ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যু দিন ধার্য করে ফেলেছেন। সেই লিউপার কেলিয়া উৎসবের দিনটি অর্থাৎ ১৪ই ফেব্রুয়ারী সন্ত ভ্যালেন্টাইন একটা ছোট্র চিঠি প্রহরীর হাতে দিয়ে বলেন তাঁর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার পর সেটি প্লাতিনার হাতে দিতে।
১৪ই ফেব্রুয়ারী ভ্যালেন্টাইনকে বধ্যভূমিতে আনা হয়। বড়ই মর্মান্তিক মৃত্যুদন্ড। দিনের আলোয় জনসমক্ষে প্রথমে মুগুর দিয়ে মাথা থেঁতলে তারপর শিরোচ্ছেদ করা হয়। এই ভাবেই এই মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হল। মৃত্যুদন্ডের পর প্লাতিনাকে দেওয়া হল সেই চিঠি। অবাক বিস্ময়ে প্রহরী দেখলেন তার মেয়ে দৃষ্টিশক্তি পেয়েছে। চিঠিতে লেখা ‘উইথ লাভ ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন’। চিঠিটি খুলতেই ঝরে পড়ল একটি হলুদ ফুল। সবাই বুঝতে পারল সন্ত ভ্যালেন্টাইনের সাথে প্লাতিনার এক মধুর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠেছিল।
সন্ত ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুতে বিদ্রোহ চরমে ওঠে। স¤্রাট দ্বিতীয় ক্লসিয়াসও মারা যায়। স¤্রাটের মৃত্যুর সাথে সাথে সেই রাষ্ট্রধর্মের পতন হয়। আবার পূর্বের মতো মেতে ওঠে সবাই লিউপার কেলিয়া উৎসব। সন্ত ভ্যালেন্টাইনের নামে ১৪ই ফেব্রুয়ারী দিনটিকে উৎসর্গ করা হয়। দিনটি প্রেম দিন হিসাবে সার্থকতা পায়।
বদলায় সময়, বদলায় দিন। বদলায় না ইতিহাস। সুতরাং, যারা ভাবছেন এই দিনটি যুব সমাজকে বেপথে নিয়ে যাচ্ছে তা কিন্তু চরম ভুল। জেনে রাখা দরকার, এই দিনটি শুধু একটি প্রেমিকার প্রেমিকের মৃত্যুদিন নয়, সেই প্রেম ছিল হৃদয়ের, সমগ্র একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে। ইতিহাস তো বড়ই মর্মান্তিক। আসলে আজকে বানিজ্যিক রূপ দেওয়া হয়েছে বলেই এই দিনটি খারাপ মনে হচ্ছে। বিজ্ঞাপনগুলো দেখলেই বোঝা যায় দিনটি হৃদয়ের মিলন নয়, শরীরী চাহিদা ও উপহারের জন্যই যেন নির্দিষ্ট। এখন হৃদয়ের মিলন বড়ই দুষ্প্রাপ্য। সকালের প্রেম বিকেলে ভেঙে যাচ্ছে। শুরুতেই শরীরী হাতছানি। যার পাঁকে জড়িয়ে খুন, ব্ল্যাকমেইল। ঘনিষ্ট মুহূর্তের ছবি নেটের দৌলতে ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে। এর জন্যই কি সন্ত ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগ? অনেকেই বলেন, প্রেমের পড়ার কোনো দিন হয় না-বাস্তবে সত্য কথাই। কিন্তু মনে রাখা দরকার ‘ডে’ ঘোষনা মানে সমাজের উন্নয়ন। ২১শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৬ই ডিসেম্বর দেশ রক্ষার শপথ নিই, ১৪ নভেম্বর শিশুদিবস, ৮ই মার্চ নারী দিবস ইত্যাদি ইত্যাদি ‘দিবস’ গুলি বিশেষ কর্মসূচির জন্য।
আজ ভেঙেছে সমাজ, ভাঙছে পরিবার, ভাঙছে দাম্পত্য। তাই ১৪ই ফেব্রুয়ারীর মহান দিনটির আত্মত্যাগ বুকে নিয়ে কোনো উপহার নয়, প্রেমিক-প্রেমিকারা দু’জনের হাত ধরে শপথ নিন সুখে-দুঃখে সবসময় একে-অপরের হয়ে থাকবেন, কোনোদিন কোনোমতেই সেই বন্ধন যেন শিথিল না হয়। সেই বন্ধন বুকে নিয়ে তবেই ডুব দিতে হবে প্রেমের গোপন সাগরে। দেখবেন সেই প্রেমের সুখই আলাদা। আর সেই প্রেম যারা সফল করতে পারবেন তাদের কাছেই সার্থক হবে দিনটির মর্যাদা।
লেখক ঃ ডা. উজ্জ্বল কুমার রায়
           চিকিৎসক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব