প্রিয় বাবা,
কেমন আছ বা আমি কেমন আছি, সেসব বৃথা আলাপচারীতায় সময় নষ্ট করব না। বুঝে গেছি, যে অবস্থায় প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটে বেড়ানোই হল জীবনের মানে - তখন এসমস্ত কুশলাদি কেবলই করুন হাস্যরসের জন্ম দেবে।
তুমি, আমি, মা, বোন, দাদা-দাদি, আমাদের পরিবার ছিল এই ছয়জনের। আজ আর পরিবার বলতে কিছু নেই, পরিবারের লোকসংখ্যাও কমে অর্ধেকে দাঁড়িয়েছে।
দেখলে তো, কি সহজভাবেই না প্রিয়জন হারানোর কথাটা বলতে পারলাম! কিন্তু আর কিই বা করার আছে? চরম সত্য যে মেনে নিতে হবেই। কিন্তু পরিণতিটা যে কত ভয়ঙ্করভাবে ঘটেছে, লিখে তোমায় প্রকাশ করতে পারব না। তবে এই চিঠি হাতে নিয়ে যখন কাগজের এখানে-ওখানে চলটা ওঠানো দেখবে, বুঝবে তা আমার চোখের জলের, হৃদয়ভাঙা আবেগের সাক্ষী।
তুমি তো দেশমাতৃকাকে রক্ষার অমোঘ জেদ ধরে আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেলে সেই মে মাসে। পরের দুমাস কোন খোঁজ পাইনি তোমার। কিন্তু সেই তোমার সূত্র ধরেই আমাদের পরিবারে নেমে এসেছে এতবড় ধস। যেই গনিমোল্লাকে তুমি পরমবন্ধু ভাবতে, সেই লোকটাই আজ শান্তিবাহিনীত যোগ দিয়েছে। আর তার নব্য প্রভুদের খুশি করতে মুক্তিবাহিনীর পরিবার হিসেবে বলে দিয়েছে আমাদের পরিবারের নাম। উফ বাবা, তুমি কি বোকা! যুদ্ধে যাবার আগে গ্রামের সকলকে বড় মুখ করে বলে এসেছিলে তোমার লড়াইয়ে নামার কথা। এর ফল যে অশুভ হতে পারে, তা কি তোমার মানসচক্ষে একবারও ফুটে ওঠেনি?
যাইহোক, গতপরশু রাতে আমাদের বাড়িতে হানা দিয়েছিল হানাদারেরা। প্রথমেই ধরেছিল বৃদ্ধ দাদাজানকে। সেই দাদাজান, গত পনের বছর ধরে যিনি অথর্ব হয়ে একরকম পরিবারের বোঝা হয়ে রয়েছেন। তোমার যখন মনমেজাজ খারাপ থাকত, তখন তো সব ঝাল তুমি ওই মানুষটার ওপরই ঝাড়তে। উঠতে বসতে তার মৃত্যুকামনা করতে। সে কিন্তু তোমার এসব কাজের যোগ্য প্রতিদানই দিয়েছেন। হানাদারদের একজন যখন তার টুঁটি চেপে ধরে বারংবার জিজ্ঞেস করছিল তোমার কথা, তুমি সত্যিই যুদ্ধে গেছ কিনা, গেলে বর্তমানে কোথায় আছ --- তিনি কিন্তু নিজের জান বাঁচাতে তাদেরকে কোন মিছে কথা বলেননি। অথর্ব, শয্যাশায়ী লোকটার কণ্ঠেও যেন সেদিন বজ্রপাত হচ্ছিল। তিনি বারবার বলছিলেন, 'আমার ছাওয়াল যুদ্ধে গ্যাসে, বেশ করসে... তোদের মতন সব শকুন দেশ থেইকা তাড়ায় ছাড়বে!' স্বভাবতই এসব বলে পার পাননি তিনি। হানাদারদের কাছে যে ছেলেবুড়ো কোন ব্যাপার না! দাদাজানের প্রতি ক্রোধান্বিত হয়ে গলায় আঁকড়ে থাকা আঙ্গুলেরচাপ বাড়িয়ে দিয়েছে পশুটা। দমবন্ধ হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা গেছেন দাদাজান।
দাদাজানের যখন মৃত্যু ঘটছিল, সেই মুহুর্তে মা'কে ধরে ছিল আরও দুই নরখাদক। তাদের টানাহেঁচড়ায় আমার সাতমাসের অন্তঃসত্ত্বা মা একবার পড়েও যায়। পড়ে যাওয়ার পরমুহুর্তে তার গগনবিদারী চিৎকার থেকেই বুঝেছি, পেটের বাচ্চাটা তখনই মাতৃগর্ভে মারা গেছে। আমার ছোট একটা ভাই বা বোন, সে কিনা পৃথিবীতে আসার আগেই নিঃশেষ হয়ে গেল! এতে কিন্তু মন গলেনি ওই পিশাচদের। মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থায়ই টেনেহিঁচড়ে মা'কে তাদের গাড়িতে তুলেছে।
আজ সকালে খবর পেয়েছি, মা-ও আর নেই।
বোনের কথাটা তোমাকে কিভাবে বলব, বুঝতে পারছি না। কোনদিন কি কেউ ভেবেছে, এভাবে একজন অসহায় ভাই তার বাবার কাছে নিজের বোনের ইজ্জতহানির খবর দেবে? কিন্তু আজ সব অসম্ভব সম্ভব হয়েছে। দশ বছর বয়সী আমার ছোট বোনটার কোমল দেহটা লুটেপুটে খাওয়ার জন্য সংযম ধরে রাখতে পারেনি ওই দানবেরা। বোনের মৃত্যুও তাই আমাদের বাড়িরই উঠোনে হয়েছে।
তুমি ভাবছ আমি আর দাদিজান কিভাবে বেঁচে গেলাম?
দাদিজান সেদিন বাড়ি ছিল না। পাশের গ্রামে বোনের বাড়ি গিয়েছিলেন। আর এতসব ঘটনা আমার চোখের সামনেই হয়েছে। বাড়ির পেছনের ঝোপে লুকিয়ে ছিলাম আমি। কিন্তু হানাদারদের রাইফেলের ভয়ে অসহায় মা-বোনকে বাচাতে এগিয়ে আসতে পারিনি। জানিনা তুমি আমাকে কাপুরুষ ভাবছ কিনা। ভাবলে ক্ষতি নেই। আমিও আজ নিজেকে নিজেই কাপুরুষ বলে মনে করছি। চোখের সামনে মা-বোনের সম্মানহানি দেখার চেয়ে মৃত্যু কি ভাল ছিল না?
শেষমুহুর্তে অবশ্য আমিও মরতে মরতে বেঁচে গেছি। ফিরে যাওয়ার সময় ওরা আমার উপস্থিতি টের পেয়ে যায়। ভয়ে আমি উল্টোদিকে ছুটতে থাকি। কিন্তু ওদের একটা গুলি আমার পায়ে এসে লাগে। এখন আমার অবস্থা অনেকটা ল্যাংড়া কুকুরের মত!
দাদিজানকে কিন্তু আমি এসব ঘটনার কিছুই বলিনি। বুড়ো মানুষ হয়ত এ শোক সহ্য করতে পারবেন না। তাকে বলেছি, গ্রামে মিলিটারি আসায় দাদাজান, মা আর বোন পালিয়ে অন্য গ্রামে চলে গেছে। অবশ্য তিনি অশিক্ষিত-মুর্খ বলেই তার কাছে এই চিঠি রেখে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছি। মূল ঘটনা কি, তা আপাতত তিনি জানতে পারবেন না। অন্তত কিছুদিন তো তাকে কোন দুঃখ স্পর্শ করবে না!
তুমি ভাবছ, আমি আবার কোথায় যাচ্ছি? ওমা! যেই দেশের জন্য আজ আমি সবকিছু হারালাম, তার সাথে আমার ব্যক্তিগত একটা বোঝাপড়া আছে না! তোমাকে চিঠি লিখতে লিখতে এই কলম ছুঁয়েই শপথ করছি, এই দেশটাকে স্বাধীন না করে, দেশ থেকে শকুনের পাল না তাড়িয়ে, আমার মা-বোন-দাদাজানের মৃত্যুর প্রতিশোধ না নিয়ে বাড়ি ফিরব না।
মাত্র ১৩ বছরের একটা ছেলেকে মুক্তিবাহিনী হয়ত দলে না-ও নিতে পারে। ক্ষতি নেই। আমি তখন একাই লড়াই করব। দরকার হলে জান দিয়ে দেব। দেশটা তো আমারও, তাই না? ওরা আমায় দলে না নিলেই যে আমি মুখ চুন করে ঘরে বসে থাকব, তা তো না!
ইতি
তোমার কাপুরুষ পুত্র
.............................................
চিঠির লেখক ওই বালকটি তার বাবাকে উদ্দেশ করে লেখা চিঠিটা তার দাদির কাছে রেখে অদৃশ্য হয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত চেনাজানা কেউ তার কোন হদিস দিতে পারে নি। তার বৃদ্ধা দাদি তাকে খুঁজতে এ গ্রাম ও গ্রাম চষে বেড়িয়েছেন। কারণ বালকটি তার যুদ্ধে যাওয়ার মনস্কামনা কেবল বাবার কাছে লেখা চিঠিটাতেই ব্যক্ত করেছে। যুদ্ধে যাওয়ার আগে এমনকি দাদীর কাছ থেকে বিদায়ও নেয়নি।
একসময় যুদ্ধ শেষ হয়। চারদিকের অবস্থা শান্ত হলে নিজ গ্রামে ফিরে বৃদ্ধা তার স্বামী, পুত্রবধূ আর নাতনির মৃত্যুর কথা জানতে পারেন। তার নাতি, অর্থাৎ উপরোক্ত চিঠির বালকটি আর ফিরে আসে না। বালকের বাবা ফিরে আসে কিছুদিন পর, কিন্তু তখন সে অন্ধ, যুদ্ধে চোখ হারিয়েছেন।
তাই বালকটি তার নিজস্ব বর্ণনায় যে ঘটনাগুলোর কথা লিখেছিল, তা পৃথিবীর কাছে অজানাই থেকে যায়।
আর নিঃস্ব ওই বৃদ্ধা মিথ্যে আশায় বুক বেধে, অপেক্ষমাণ দৃষ্টিতে পথের পানে চেয়ে বসে থাকে, তার নাতি হয়ত একদিন না একদিন ঘরে ফিরবে! অন্ধ বাবা দিন গুনতে থাকে, তার সন্তান ঘরে ফিরবে।
কিন্তু সে ঘরে ফেরে না।
কালের পরিক্রমায় এরপর একে একে বিয়াল্লিশটা বছর কেটে গেছে। কে জানে, আজ হয়ত ওই বৃদ্ধাও মারা গেছেন, অন্ধ বাবাও মারা গেছেন। তাদের সব অপেক্ষারও সমাপ্তি হয়েছে। কিংবা কে জানে, একদিন হয়ত বালকটি আচমকা বৃদ্ধা দাদি ও অন্ধ বাবার সামনে উপস্থিত হয়ে তাদের সমস্ত প্রতিক্ষার অবসান ঘটাবে!
আবার হয়ত এমনও হতে পারে, বালকটির দৃষ্টিতে দেশ এখনো পুরোপুরি শকুনমুক্ত হয় নাই। দেশ থেকে ঘাতক-দালাল-রাজাকার নির্মুলের প্রতীক্ষায় রয়েছে সে। তার প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী যতদিন এরা দেশ ছাড়বেনা বা এদের বিচার সংগঠিত হবে না, বালকটি বাড়ি ফিরবে না।
এভাবেই কারো প্রতীক্ষাই আর শেষ হয় না। একদিন হয়ত হবে।
//
Comments (12)
ইয়া মাবুদ আপিকে কি জিগ্যেস করবো?
১। আচ্ছা আপি ব্লগিং করার জন্য এত সময় পাও কেমনে?
২। তোমাদের হোম ডিস্ট্রিক কোথায়?
৩। বর্তমানে কি তুমি গৃহিনী
৪। না কি কোথাও জব কর?
৫। ব্লগিং কবে থেকে শুরু করেছ
৬। জীবনে কয়বার প্রেমে পড়েছ
৭। লেখালেখি কবে থেকে শুরু
৮। অবসর সময়ে কি করতে ভালবাসা
৯। প্রিয় ব্যক্তিত্ব কে?
১০। আপনজনদের মধ্যে কাকে বেশী ভালবাস?
এইটুক করে রাখলাম বাকিগুলো আরেক কমেন্টে করুম নে
অভিনন্দন মাস্টার আপা।
কেমন আছেন?
আপনার অনুভূতি কি এমন জিজ্ঞাসা করবো না। আপনার তুলিগুলোর মাঝে কত নাম্বার তুলিটা বেশি পছন্দ করেন?
এখন যদি ভ্যানগগ এসে বলেন তাকে নিয়ে সংসারী হতে হবে আপনার জবাব কী হবে?
হঠাত একটা চিঠি পেলেন আপনার একটা ছবি ফ্রান্সের রঁদেভু তে ঠাঁই পাবে, আপনি কাঁদবেন না কি খুশিতে জ্ঞান হারাবেন?
আপাতত আমার জিজ্ঞাসা শেষ?
মারিছে কি ভয়ানক প্রশ্ন করিছে জুলিয়ান ভাই
ঘাস ফুল ভাইয়ের প্রশ্নগুলির উত্তর পেলে
মোটা মুটি ভাবে জাকিয়া জেসমিন যূথী
সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা পাওয়া যাবে।
সাথে আমার দুটি প্রশ্নঃ
১।বর্তমানে কোথায় অবস্থান করছেন এবং
২। রাজনৈতিক মতাদর্শ কী লিবারেল অথবা কট্টর?]
ধন্যবাদ আপু
ঘাস ফুল ভাইয়ের প্রশ্নগুলির উত্তর পেলে
মোটা মুটি ভাবে জাকিয়া জেসমিন যূথী
সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা পাওয়া যাবে।............
এইডা কী কইলেন নুরু ভাই? আমি তো অহনো প্রশ্নই করি নাই। আফনে মনে হয় এই মেঘ এই রোদ্দুররের কতা কইতে চাইছেন। হাছা না?