Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

জান্নাতুল নাঈম পিয়াল

১০ বছর আগে লিখেছেন

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গল্পঃ প্রতীক্ষা

প্রিয় বাবা,

কেমন আছ বা আমি কেমন আছি, সেসব বৃথা আলাপচারীতায় সময় নষ্ট করব নাবুঝে গেছি, যে অবস্থায় প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটে বেড়ানোই হল জীবনের মানে - তখন এসমস্ত কুশলাদি কেবলই করুন হাস্যরসের জন্ম দেবে

তুমি, আমি, মা, বোন, দাদা-দাদি, আমাদের পরিবার ছিল এই ছয়জনেরআজ আর পরিবার বলতে কিছু নেই, পরিবারের লোকসংখ্যাও কমে অর্ধেকে দাঁড়িয়েছে

দেখলে তো, কি সহজভাবেই না প্রিয়জন হারানোর কথাটা বলতে পারলাম! কিন্তু আর কিই বা করার আছে? চরম সত্য যে মেনে নিতে হবেইকিন্তু পরিণতিটা যে কত ভয়ঙ্করভাবে ঘটেছে, লিখে তোমায় প্রকাশ করতে পারব নাতবে এই চিঠি হাতে নিয়ে যখন কাগজের এখানে-ওখানে চলটা ওঠানো দেখবে, বুঝবে তা আমার চোখের জলের, হৃদয়ভাঙা আবেগের সাক্ষী

তুমি তো দেশমাতৃকাকে রক্ষার অমোঘ জেদ ধরে আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেলে সেই মে মাসেপরের দুমাস কোন খোঁজ পাইনি তোমারকিন্তু সেই তোমার সূত্র ধরেই আমাদের পরিবারে নেমে এসেছে এতবড় ধসযেই গনিমোল্লাকে তুমি পরমবন্ধু ভাবতে, সেই লোকটাই আজ শান্তিবাহিনীত যোগ দিয়েছেআর তার নব্য প্রভুদের খুশি করতে মুক্তিবাহিনীর পরিবার হিসেবে বলে দিয়েছে আমাদের পরিবারের নামউফ বাবা, তুমি কি বোকা! যুদ্ধে যাবার আগে গ্রামের সকলকে বড় মুখ করে বলে এসেছিলে তোমার লড়াইয়ে নামার কথাএর ফল যে অশুভ হতে পারে, তা কি তোমার মানসচক্ষে একবারও ফুটে ওঠেনি?

যাইহোক, গতপরশু রাতে আমাদের বাড়িতে হানা দিয়েছিল হানাদারেরাপ্রথমেই ধরেছিল বৃদ্ধ দাদাজানকেসেই দাদাজান, গত পনের বছর ধরে যিনি অথর্ব হয়ে একরকম পরিবারের বোঝা হয়ে রয়েছেনতোমার যখন মনমেজাজ খারাপ থাকত, তখন তো সব ঝাল তুমি ওই মানুষটার ওপরই ঝাড়তেউঠতে বসতে তার মৃত্যুকামনা করতেসে কিন্তু তোমার এসব কাজের যোগ্য প্রতিদানই দিয়েছেনহানাদারদের একজন যখন তার টুঁটি চেপে ধরে বারংবার জিজ্ঞেস করছিল তোমার কথা, তুমি সত্যিই যুদ্ধে গেছ কিনা, গেলে বর্তমানে কোথায় আছ --- তিনি কিন্তু নিজের জান বাঁচাতে তাদেরকে কোন মিছে কথা বলেননিঅথর্ব, শয্যাশায়ী লোকটার কণ্ঠেও যেন সেদিন বজ্রপাত হচ্ছিলতিনি বারবার বলছিলেন, 'আমার ছাওয়াল যুদ্ধে গ্যাসে, বেশ করসে... তোদের মতন সব শকুন দেশ থেইকা তাড়ায় ছাড়বে!' স্বভাবতই এসব বলে পার পাননি তিনিহানাদারদের কাছে যে ছেলেবুড়ো কোন ব্যাপার না! দাদাজানের প্রতি ক্রোধান্বিত হয়ে গলায় আঁকড়ে থাকা আঙ্গুলেরচাপ বাড়িয়ে দিয়েছে পশুটাদমবন্ধ হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা গেছেন দাদাজান

দাদাজানের যখন মৃত্যু ঘটছিল, সেই মুহুর্তে মা'কে ধরে ছিল আরও দুই নরখাদকতাদের টানাহেঁচড়ায় আমার সাতমাসের অন্তঃসত্ত্বা মা একবার পড়েও যায়পড়ে যাওয়ার পরমুহুর্তে তার গগনবিদারী চিৎকার থেকেই বুঝেছি, পেটের বাচ্চাটা তখনই মাতৃগর্ভে মারা গেছেআমার ছোট একটা ভাই বা বোন, সে কিনা পৃথিবীতে আসার আগেই নিঃশেষ হয়ে গেল! এতে কিন্তু মন গলেনি ওই পিশাচদেরমাটিতে পড়ে থাকা অবস্থায়ই টেনেহিঁচড়ে মা'কে তাদের গাড়িতে তুলেছে

 

আজ সকালে খবর পেয়েছি, মা-ও আর নেই

বোনের কথাটা তোমাকে কিভাবে বলব, বুঝতে পারছি নাকোনদিন কি কেউ ভেবেছে, এভাবে একজন অসহায় ভাই তার বাবার কাছে নিজের বোনের ইজ্জতহানির খবর দেবে? কিন্তু আজ সব অসম্ভব সম্ভব হয়েছেদশ বছর বয়সী আমার ছোট বোনটার কোমল দেহটা লুটেপুটে খাওয়ার জন্য সংযম ধরে রাখতে পারেনি ওই দানবেরাবোনের মৃত্যুও তাই আমাদের বাড়িরই উঠোনে হয়েছে

তুমি ভাবছ আমি আর দাদিজান কিভাবে বেঁচে গেলাম?

দাদিজান সেদিন বাড়ি ছিল নাপাশের গ্রামে বোনের বাড়ি গিয়েছিলেনআর এতসব ঘটনা আমার চোখের সামনেই হয়েছেবাড়ির পেছনের ঝোপে লুকিয়ে ছিলাম আমিকিন্তু হানাদারদের রাইফেলের ভয়ে অসহায় মা-বোনকে বাচাতে এগিয়ে আসতে পারিনিজানিনা তুমি আমাকে কাপুরুষ ভাবছ কিনাভাবলে ক্ষতি নেইআমিও আজ নিজেকে নিজেই কাপুরুষ বলে মনে করছিচোখের সামনে মা-বোনের সম্মানহানি দেখার চেয়ে মৃত্যু কি ভাল ছিল না?

শেষমুহুর্তে অবশ্য আমিও মরতে মরতে বেঁচে গেছিফিরে যাওয়ার সময় ওরা আমার উপস্থিতি টের পেয়ে যায়ভয়ে আমি উল্টোদিকে ছুটতে থাকিকিন্তু ওদের একটা গুলি আমার পায়ে এসে লাগেএখন আমার অবস্থা অনেকটা ল্যাংড়া কুকুরের মত!

দাদিজানকে কিন্তু আমি এসব ঘটনার কিছুই বলিনিবুড়ো মানুষ হয়ত এ শোক সহ্য করতে পারবেন নাতাকে বলেছি, গ্রামে মিলিটারি আসায় দাদাজান, মা আর বোন পালিয়ে অন্য গ্রামে চলে গেছেঅবশ্য তিনি অশিক্ষিত-মুর্খ বলেই তার কাছে এই চিঠি রেখে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছিমূল ঘটনা কি, তা আপাতত তিনি জানতে পারবেন নাঅন্তত কিছুদিন তো তাকে কোন দুঃখ স্পর্শ করবে না!

তুমি ভাবছ, আমি আবার কোথায় যাচ্ছি? ওমা! যেই দেশের জন্য আজ আমি সবকিছু হারালাম, তার সাথে আমার ব্যক্তিগত একটা বোঝাপড়া আছে না! তোমাকে চিঠি লিখতে লিখতে এই কলম ছুঁয়েই শপথ করছি, এই দেশটাকে স্বাধীন না করে, দেশ থেকে শকুনের পাল না তাড়িয়ে, আমার মা-বোন-দাদাজানের মৃত্যুর প্রতিশোধ না নিয়ে বাড়ি ফিরব না

মাত্র ১৩ বছরের একটা ছেলেকে মুক্তিবাহিনী হয়ত দলে না-ও নিতে পারেক্ষতি নেইআমি তখন একাই লড়াই করবদরকার হলে জান দিয়ে দেবদেশটা তো আমারও, তাই না? ওরা আমায় দলে না নিলেই যে আমি মুখ চুন করে ঘরে বসে থাকব, তা তো না!

 

ইতি

তোমার কাপুরুষ পুত্র

 

.............................................

 

 

চিঠির লেখক ওই বালকটি তার বাবাকে উদ্দেশ করে লেখা চিঠিটা তার দাদির কাছে রেখে অদৃশ্য হয়ে যায়দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত চেনাজানা কেউ তার কোন হদিস দিতে পারে নিতার বৃদ্ধা দাদি তাকে খুঁজতে এ গ্রাম ও গ্রাম চষে বেড়িয়েছেনকারণ বালকটি তার যুদ্ধে যাওয়ার মনস্কামনা কেবল বাবার কাছে লেখা চিঠিটাতেই ব্যক্ত করেছেযুদ্ধে যাওয়ার আগে এমনকি দাদীর কাছ থেকে বিদায়ও নেয়নি

 

একসময় যুদ্ধ শেষ হয়চারদিকের অবস্থা শান্ত হলে নিজ গ্রামে ফিরে বৃদ্ধা তার স্বামী, পুত্রবধূ আর নাতনির মৃত্যুর কথা জানতে পারেনতার নাতি, অর্থাৎ উপরোক্ত চিঠির বালকটি আর ফিরে আসে নাবালকের বাবা ফিরে আসে কিছুদিন পর, কিন্তু তখন সে অন্ধ, যুদ্ধে চোখ হারিয়েছেন

তাই বালকটি তার নিজস্ব বর্ণনায় যে ঘটনাগুলোর কথা লিখেছিল, তা পৃথিবীর কাছে অজানাই থেকে যায়

আর নিঃস্ব ওই বৃদ্ধা মিথ্যে আশায় বুক বেধে, অপেক্ষমাণ দৃষ্টিতে পথের পানে চেয়ে বসে থাকে, তার নাতি হয়ত একদিন না একদিন ঘরে ফিরবে! অন্ধ বাবা দিন গুনতে থাকে, তার সন্তান ঘরে ফিরবে

কিন্তু সে ঘরে ফেরে না

 

কালের পরিক্রমায় এরপর একে একে বিয়াল্লিশটা বছর কেটে গেছেকে জানে, আজ হয়ত ওই বৃদ্ধাও মারা গেছেন, অন্ধ বাবাও মারা গেছেনতাদের সব অপেক্ষারও সমাপ্তি হয়েছেকিংবা কে জানে, একদিন হয়ত বালকটি আচমকা বৃদ্ধা দাদি ও অন্ধ বাবার সামনে উপস্থিত হয়ে তাদের সমস্ত প্রতিক্ষার অবসান ঘটাবে!

 

আবার হয়ত এমনও হতে পারে, বালকটির দৃষ্টিতে দেশ এখনো পুরোপুরি শকুনমুক্ত হয় নাইদেশ থেকে ঘাতক-দালাল-রাজাকার নির্মুলের প্রতীক্ষায় রয়েছে সেতার প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী যতদিন এরা দেশ ছাড়বেনা বা এদের বিচার সংগঠিত হবে না, বালকটি বাড়ি ফিরবে না

 

এভাবেই কারো প্রতীক্ষাই আর শেষ হয় নাএকদিন হয়ত হবে

 

  //
Likes ১২ Comments
০ Share

Comments (12)

  • - এই মেঘ এই রোদ্দুর

    ইয়া মাবুদ আপিকে কি জিগ্যেস করবো?

    ১। আচ্ছা আপি ব্লগিং করার জন্য এত সময় পাও কেমনে?

    ২। তোমাদের হোম ডিস্ট্রিক কোথায়?

    ৩। বর্তমানে কি তুমি গৃহিনী

    ৪। না কি কোথাও জব কর?

    ৫। ব্লগিং কবে থেকে শুরু করেছ

    ৬। জীবনে কয়বার প্রেমে পড়েছ

    ৭। লেখালেখি কবে থেকে শুরু

    ৮। অবসর সময়ে কি করতে ভালবাসা

    ৯। প্রিয় ব্যক্তিত্ব কে?

    ১০। আপনজনদের মধ্যে কাকে বেশী ভালবাস?

     

    এইটুক করে রাখলাম বাকিগুলো আরেক কমেন্টে করুম নে

    - জুলিয়ান সিদ্দিকী

    অভিনন্দন মাস্টার আপা।

    কেমন আছেন?

    আপনার অনুভূতি কি এমন জিজ্ঞাসা করবো না। আপনার তুলিগুলোর মাঝে কত নাম্বার তুলিটা বেশি পছন্দ করেন?

    এখন যদি ভ্যানগগ এসে বলেন তাকে নিয়ে সংসারী হতে হবে আপনার জবাব কী হবে?

    হঠাত একটা চিঠি পেলেন আপনার একটা ছবি ফ্রান্সের রঁদেভু তে ঠাঁই পাবে, আপনি কাঁদবেন না কি খুশিতে জ্ঞান হারাবেন?

    আপাতত আমার জিজ্ঞাসা শেষ?

    • - লুৎফুর রহমান পাশা

      মারিছে কি ভয়ানক প্রশ্ন করিছে জুলিয়ান ভাই

    - নূর মোহাম্মদ নূরু

    ঘাস ফুল ভাইয়ের প্রশ্নগুলির উত্তর পেলে
    মোটা মুটি ভাবে জাকিয়া জেসমিন যূথী
    সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা পাওয়া যাবে।

    সাথে আমার দুটি প্রশ্নঃ
    ১।বর্তমানে কোথায় অবস্থান করছেন এবং
    ২। রাজনৈতিক মতাদর্শ কী লিবারেল অথবা কট্টর?]

    ধন্যবাদ আপু

    • - ঘাস ফুল

      ঘাস ফুল ভাইয়ের প্রশ্নগুলির উত্তর পেলে
      মোটা মুটি ভাবে জাকিয়া জেসমিন যূথী
      সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা পাওয়া যাবে।............

      এইডা কী কইলেন নুরু ভাই? আমি তো অহনো প্রশ্নই করি নাই। আফনে মনে হয় এই মেঘ এই রোদ্দুররের কতা কইতে চাইছেন। হাছা না? 

    • Load more relies...
    Load more comments...