তুলতুল ক্লাস নাইনে পড়ে। সুন্দরী। পড়াশোনাতেও বেশ ভাল। জেএসসি'তে গোল্ডেন এ+ পেয়েছে। স্কুল ছাড়াও বিকালে দুইজন স্যারের ব্যাচে যায় সে। মূলত তিন চারজন বান্ধবী একসাথে যাওয়া আসা করে। তবে বাসা থেকে কিছুটা দূর অব্দি একাই যেতে হয়। দুটো রাস্তা পেরুবার পর প্রথম সঙ্গী মেলে। আবার সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পথে বাসা থেকে দুই রাস্তা আগে সঙ্গীহীন হয়ে পড়ে সে।
সন্ধেবেলা ঐ দুটো রাস্তা পার করাই তার কাছে অগ্নিপরীক্ষার সামিল। রাস্তার মোড়ের মাথার চায়ের দোকানে রিকশাওয়ালারা আড্ডা জমায়। কবরস্থানের পাঁচিলের ওপর সিগারেট ফুঁকবার মহতী কাজে লিপ্ত থাকে কয়েকজন বখাটে। মাগরিবের নামাজ শেষে বাড়ি ফিরতে থাকে মুসল্লিরা। কারো চোখের দৃষ্টিই ভালো না। অথবা ভালো হলেও, তুলতুলের 'সদ্য অনেককিছু বুঝতে শেখা মন' সেই দৃষ্টিকে নেতিবাচকভাবেই গ্রহণ করে। এ নিয়ে মনে মনে কষ্ট পায় তুলতুল।
বাসায় দুবছরের বড় বোন আছে তার। তার সাথে একদিন এই বিষয়ে কথা বলতে গেছিল তুলতুল। কিন্তু বড় বোন সে কথা কেবল হেসেই উড়িয়ে দেয়নি, আজকাল প্রায়ই তা নিয়ে ঠাট্টাও করে। মা বা বাবার সাথে এ নিয়ে কথা বলার সাহস নেই তুলতুলের। মধ্যবিত্ত পরিবার তাদের। তুলতুলের ভয় হয়, এই বিষয়ে বাবা-মা জানতে পারলে হয়ত তাকেই দোষ দেবে। বলবে, 'অনেক হয়েছে পড়ালেখা। আর না। যা দিনকাল পড়েছে, তাতে আর বাইরে বেরুবার দরকার নেই। ঘরে বসে থাকো তাও ঢের ভালো।' অথচ তুলতুল তা হতে দিতে চায় না। নিজের জীবন নিয়ে অনেক স্বপ্ন তার। আর তা পূরণ করতে গেলে পড়ালেখার যে কোন বিকল্প নেই, তাও তুলতুলের অজানা নয়।
স্কুলের বান্ধবীদের সাথেও এ নিয়ে কথা বলে না তুলতুল। এসব কথা তো তার ক্লাসের অনেক মেয়ের কাছে কিছুই না। একসাথে আড্ডার সময় তারা এর থেকেও অনেক ভয়ংকর কথাবার্তা বলে, যা শুনলে গা গুলায় তুলতুলের।
এইভাবেই দিন কাটছিল তুলতুলের। হঠাৎ একদিন দেখা গেল, রাত আটটা বেজে গেছে অথচ তুলতুলের বাসায় ফেরার নাম নেই। বাড়ির লোকেরা খোঁজাখুঁজি শুরু করল তার। কোথাও পাওয়া গেল না তাকে। পাড়ার লোকেরা নানা গুজবের জন্ম দিল। তুলতুলকে নাকি ইদানিং একটা ছেলের সাথে মিশতে দেখা যেত ইত্যাদি ইত্যাদি। মেয়ে রাতে বাড়ি না ফেরায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়া তুলতুলের বাবা-মাও লোকের কথা সহজেই বিশ্বাস করে ফেলল। তারা ঠিক করল মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ করে দেবে। আর বাড়ি থেকে বেরুতে দেবে না। যত দ্রুত সম্ভব মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেবে। অথচ যে মেয়ের জীবনে এমন ঘটনা ঘটে গেছে, তাকে ভাল জায়গায় বিয়ে দেয়া অনেক দুরূহ কাজই হবে।
তবে সেই দুরূহ কাজে আর অবতীর্ণ হতে হল না তুলতুলের বাবা-মাকে। সেদিন রাত কেটে গেল। পরের দিন ভোরবেলা পাড়ার লোকজন তুলতুলের লাশ আবিষ্কার করল কবরস্থানের ভেতর থেকে। তুলতুলের মুখ ছিল ওড়না দিয়ে বাধা। আর... থাক, সেই মর্মান্তিক বিবরণ নাই বা দিলাম।
এই ঘটনার পর অবশ্য দোষীদের কোন শাস্তি হল না। সবারই মোটামুটি ধারণা আছে ঘটনার পেছনে মূলত কাদের হাত ছিল। কিন্তু তারপরও এ নিয়ে কোন পুলিশ কেস হল না। পাড়ার মুরুব্বিরা বসল শালিসে। তারা তুলতুলের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলল। কিছু সুবিধেবাদী লোক নানা মুখরোচক কাহিনী বানিয়ে সেটিকে বিশ্বাসযোগ্যও করে তুলল।
ফলশ্রুতিতে একঘরে করা হল তুলতুলের পরিবারকে। তুলতুলের বাবা কিছুই বলল না। তার একটাই আশা, একদিন হয়ত অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হবে। বড় মেয়েটাকে যে কারো সাথে বিয়ে দিয়ে সে তার কন্যাদায় হতে মুক্তি পাবে। আর তাছাড়া সে এই ভয়ও পাচ্ছে যে, এই বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে হয়তবা বড় মেয়েটাকেও তুলতুলের মত ভাগ্য বরণ করে নিতে হবে।
ভীতির কাছে পদলুন্ঠিত হল ন্যায়বিচার। এভাবেই তুলতুলের অকাল মৃত্য ও তার হত্যার বিচার রূপান্তরিত হল এক প্রহসনে।
Comments (4)
আমার মা এরকম একটা গল্প বলত তার ছোটবেলার।
জেনে ভাল লাগল। ধন্যবাদ।
দারুন লাগলো লেখাটি পড়ে,শুভ কামনা
ধন্যবাদ সরোয়ার ভাই।