Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

কবি ও দার্শনিক

১০ বছর আগে লিখেছেন

♥ ♥ ♥ পরাবাস্তব রচনা; আম্রকথন ।। ♥ ♥ ♥

 

জোড়াসাঁকোর বাগানবাড়িতে কবিগুরু মনের সুখে পায়চারি করছেন । বাগানজুড়ে বিশাল-বিশাল আমগাছের ছড়াছড়ি । তবে এই সিজনে কবিগুরুর বাগানবাড়িতে আমের আধিক্য খুব একটা নেই বললেই চলে । তাই গুরুর মন খানিকটা বিচলিত । তবে সিজনের শুরুতেই গাছে মুকুল এসেছিলো বিস্তর । তাই দেখে প্রাণ ফ্রুটো’র একদল লোক গুরুজির বাগান লাখ টাকায় বায়না করতে এসেছিলো । কবি তাদের দুর-দুর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন । এখন তিনি মনে-মনে আফসোস করছেন । আহারে ! খালি-খালি কতোগুলো টাকা গচ্চা গেলো ।

ওদিকে দুদিন বাদেই তার কাছে পারস্যের কবি ওমর খৈয়াম আসবেন বলে মেইল করেছেন । তিনি ইবনে বতুতার কাছে খুর্মা-খেজুর খেতে-খেতে এ অঞ্চলে জন্মানো আমের ভূয়সী প্রশংসা শুনেছেন । তাই একটু সাক্ষাত দিতে আসা আর কি । কবিগুরু সানন্দে তাকে আসতে বলেছেন । কবির সাথে তার স্কাইপিতে কথাও হয়েছে ।

সেদিন কার কাছ থেকে যেন উড়ো খবর পেয়েছিলেন যে, এবার চাঁপাইনবাবগঞ্জে নাকি আমের বাম্পার ফলন হয়েছে । সেই খবরের সত্যতা যাচাই করার দায়িত্ব পড়লো আমার ওপর । গুরুজি বললেন , আমের কি আসুবিসু ঝটপট জানা আমায় । আমি কইলাম, একটু সবুর করেন গুরুজি । তোঁতামিয়ারে ফোন লাগাইতেছি । তোঁতামিয়া ফারুকির কি একটা নাটকের শ্যুটিংয়ে ব্যাস্ত । মামুর ব্যাটাকে অনেকবার ফোন দেবার পর রিসিভ করলো । ঘটনা শোনার পর সে অভয় দিলো , কোন ছমছ্যা নাই! টেনছন লিচ্ছো ক্যানে ! কালই আমি দুইমণ ল্যাংড়া-ফজলী-গোপালভোগ আম মিক্সিং করে ট্রাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি । ছেই আমের মদ্ধি এমন রছ – এমন রছ পাবেকো মামুর ব্যাটারা , আঁটি চুইছে-চুইছে একেবারে কনুই পর্যন্ত রছ চাইটবাকো !

তোঁতামিয়ার ফাঁপরবাজিমার্কা আলাপ বেশিক্ষণ ভালো লাগলো না । তাই বললাম, ভাইরে তুই আগে আম পাঠানোর বন্দোবস্ত কর । অনেক গণ্যমান্য লোক আসছেন । তাকে বাংলাদেশের আম না খাইয়ে ফেরত পাঠালে মান-ইজ্জৎ থাকবে না । তোঁতামিয়ার একই ডায়লগ দিলো- ভয় ক্যানে বে ! আমি তো আছি বিছয়টা ট্যাকেল দিতে, নাকি?

তার কথায় ভরসা করে গুরুজিকে কনফার্ম করলাম যে আমের ব্যাবস্থা হয়ে গেছে । গুরুজি আবার মেহমান এলে একা-একা কিছু খেতে পারেন না । তার চাই বিশাল লাটবহর । যেহেতু আমের উৎসব তাই অনেকেই দাওয়াত দিতে হবে । তাই তিনি নির্দেশ দিলেন , যা তো চট করে বাংলার বাঘা-বাঘা কবিদের আমের দাওয়াত দিয়ে আয় । এদিকটা আমি দেখছি । আমি বললাম, তথাস্তু ।

গেলাম নির্মলেন্দু গুণ সাহেবের কাছে । আম উৎসবের কথা শুনে তিনি মহা খুশি ! তবে কি ভেবে যেন নুইয়ে পড়লেন । বললেন , বয়স হয়ে গেছে রে ! গোঁফের কারণে ঠোট ঢেকে গেছে । এখন সব খানা-খাদ্য গোঁফ উঁচিয়ে খেতে হয় । আমের বেলায় যে কি হবে বুঝতে পারছি না, কেউ জুসটুস করে বেশ সুরুৎ-সুরুৎ করে স্ট্র দিয়ে খেতে পারি । তবে আমি আসবো । কবিগুরুর নিমন্ত্রণ ! না করি কি প্রকারে ? কিন্তু আম খেতে পারবো কি’না জানিনা । এখনকার সব আমেই তো অযাচিত ফরমালিন ! খেতে ভয় হয় , আবার লাল রঙের টসটসা আম দেখে খওয়ার লোভও সামলাতে পারি না । আমি তাকে সভয়ে বললাম, আম খান আর না খান । আপনি এসেই দেখুন , ভালো লাগবে । আরও বললাম, আমি বলছি না যে আম আপনাকে খেতেই হবে । আমি চাই কেউ একজন বলুক , তোমার আম এতো লাল কেন ! গুণ সাহেব এই কথার কি মানে বুঝলেন কে জানে । জবাবে বললেন, তোমার আম এতো লাল কেন ?! কি অশ্লীল ! কি অশ্লীল ! আমি জিবে কামড় দিয়ে পালিয়ে এলাম ।

কবি সমুদ্র গুপ্তকে দেখলাম সমুদ্রস্নান করছেন । তার পাশে একদল তরুণী । তিনি তাদের সাথে জলকেলিতে মগ্ন । আমের দাওয়াত দেয়ায় তিনি খানিকটা হতাস । বললেন , ধুত্তোরি ! দু’দিন ধরে রক্ত আমাশয়ে ভুগছি । টয়লেটে গেলে এমনিতেই মলের সাথে আম পড়ে । আর তুই কিনা এই টাইমে এসেছিস আমের দাওয়াত দিতে ! যা ভাগ তো । আমি তার শরীরের কন্ডিশন শুনে আর কথা বাড়ালাম না ।

গেলাম রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লার কাছে । তিনি এখন মিঠেখালি মোংলায় অবস্থান করছেন । আমের কথা শুনে তার জিভ লকলক করতে শুরু করলো । তিনি এ ব্যাপারে বেশ উত্তেজিত ! আমাকে বললেন , আমি লোনা মাটির দেশের লোক রে ভাই । ভালো আম খাওয়ার সুযোগ পেলে হাতছাড়া করবো কেন ? তা কি কি জাতের আমের সমাবেশ হবে একটু বলতো চট করে ?

আমি বললাম, এই তো ধরেন ফজলি, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, মোহনভোগ, হাড়িভাঙ্গা, চোষা, গুঁটি, আম্রপলি ইত্যাদি ইত্যাদি । তার চোখ চকচক করে উঠলো । বললেন , আহ ! অভিলাষী মন ফজলি না পাক ল্যাংড়ায় পাক সামান্য ঠাই । কিছুটাতো চাই, কিছুটাতো চাই ।

আমি তাকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে বললাম, কিছুটা কেনো ! পুরোটাই পাবেন । তবে আসতে হবে সঠিক সময়ে । বোঝেনই তো, বাংলাদেশের আম বলে কথা । পাকলে কাড়াকাড়ি পরে যায় । দেরি করে আসলেই বিপদ । তিনি বললেন, ঠিক আছে ঠিক আছে ।

 গেলাম মহাদেব সাহার কাছে । কবিগুরুর পক্ষ থেকে আমের দাওয়াত দিতেই তিনি কি যেন ভাবনায় ডুবে গেলেন । স্তব্ধ হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন পাক্কা আড়াই মিনিট । তারপর দেখালেন তার কাব্যিক প্রতিভা -

 

এককোটি বছর হয় আমকে দেখি না

একবার আম খেতে পাবো এই আশ্বাসটুকু পেলে

আমজনতার মতো ছুটে যাবো সান্তিনিকেতন ।

আমকে খেয়েছি কবে, সেই কবে-কোন বৃহস্পতিবার

আর এক কোটি বছর হয় আম খাই না !

বুঝলাম এই লাকের আমপ্রীতি তুঙ্গে । ওনাকে আর কিছু বলার নেই । অনেককেই দাওয়াত করা হয়েছে । এবার গুরুজির আশ্রমে ফেরা যেতে পারে ।

যথাসময়ে সান্তিনিকতনে আমের মেলা বসে গেলো । ওমর খৈয়াম তার কথা রেখেছেন । তিনি হরেক রকম বৃক্ষের সমাবেশ হেটে হেটে মুগ্ধ নয়নে দেখছেন । আমি তার কাছে গিয়ে বললাম , আপনি একা একা ঘুরছেন ! গুরুজির কি কাণ্ডটাই না দেখুন , আপনি একজন বিদেশের অতিথি । আর আপনাকেই কিনা একা রেখে তিনি কোথায় গিয়ে কি করছে আল্লাহই মালুম । ওমর সাহেব আমায় বাধা দিয়ে বললেন , আহা ওভাবে বোলো না । তিনি আমার জন্য খৈ-এর ব্যাবস্থা করতে গিয়েছেন । বোঝোই তো, আমি ওমর খৈয়াম ! খৈ ছাড়া আম খাই কি প্রকারে ? ওনার কথা শুনে আমার মাথা আউলা হয়ে গেলো । এই লোকের সামনে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না । অন্যদিকে যাই বলে কেটে পরলাম ।

 

বাগানের এক ছায়ায় চাদর বেছানো । তার ওপর বাটিতে করে থরে থরে আম কেটে রাখা । অসংখ বাটি । তোতামিয়াকে ধন্যবাদ দিতেই হয় । আমের গন্ধে চারদিক ম-ম করছে । গুন্ডা কাবিলা আর জাম্বুকে দেখলাম কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে পাঁজাকোলা করে ধরে নিয়ে আমের আসরে নিয়ে আসছেন । তিনি বোধহয় আম খেতে চাইছেন না , তাই গুরুর পক্ষ হতে এই শাস্তি । তাকে জোর করে আম খাইয়েই ছাড়বেন । শক্তি সাহেব তাদের সাথে শক্তিতে কুলাতে পারছেন না । তাই অনেকটা শিশুর মতো ভ্যা-ভ্যা করে বলছেন,- আমাকে তুই আনলি কেন ,ফিরিয়ে নে ।। তার কথা ওরা খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে বলে মনে হল না ।

 

গুরুজি চলে এসেছেন । তার কড়া নির্দেশ , সবাই আসুম করে বসুন । সবাইকে তাই আসুম করে বসতে হলো । গুণ সাহেবে , রুদ্র, মহাদেবজিসহ আরও কত নাম না জানা বাঙলার কবিরা উপস্থিত । গুরুজি এ আসরের মধ্যমণি । বিশেষ অতিথি খৈয়াম সাহেব । ওনার সামনে এক বাটি খৈ রাখা আছে । তিনি এখন খৈ চিবুচ্চেন । গুরুজি নিজে এক পিস ফজলি আম হাতে নিয়ে শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করলেন । আমের মিষ্টতায় তিনি অভিভূত ! আমের দিকে দৃষ্টি রেখে বললেন , আমারও পরাণ যাহা চায় – তুমি তাই তুমি তাই গো ।

ওনার ঘোষণা শেষ না হতেই সবাই আমের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো । সবাই আম পক পক করে খাচ্ছে । কি সুন্দর দৃশ্য । কিন্তু বেশিক্ষণ এই দৃশ্য স্থায়ি হলো না । বাইরে কীসের যেন চিল্লাচিল্লি । ভালোকরে কান পেতে শুনলাম । সর্বনাশ ! আম জনতা আমের লোভে বাইরে ভুখা আন্দোলনের ডাক দিয়েছে । তাদেরও আম চাই । হাজার হোক বাংলাদেশের আম । এক পিস খেতে না পারলে আশেপাশের লোকের জনম নাকি সার্থক হবে না । সেই সুদূর বাংলাদেশের আম , না খেয়ে তারা যাবেই না ।

এরকম একটা ভয়াবহ সঙ্কট অথচ কারো কোন মাথাব্যাথা নেই ! সবাই যে যার মতো আম খাচ্ছে । কেউ আঁটি চুষছে , কেউ কনুয়ের রস পর্যন্ত চেটে খাচ্ছে । খৈয়াম সাহেব তো আমে-খৈয়ে মাখামাখি । তার দাড়ি-জোব্বা আমের রসে একাকার । বাঙলার আমের এ কি মহিমা !

ঐদিকে আম জনতা পুলিশের বাঁধা স্বত্বেও গেট ভেঙে ফেলেছে । তাদের একটাই দাবি- আম চাই আম চাই, আম না পেলে রক্ষা নাই । আম যদি না মেলে তবে নাকি এখান থেকেই সরকার পতনের ডাক দেয়া হবে । এবার সামলাও ঠ্যালা । কীসব অলুক্ষুনে কথাবার্তারে বাবা ! জনতা ছুটে আসছে । বেড়ার ফাঁক দিয়ে দু-একটা গরুও ঢুকে পড়েছে , আমের সুমিষ্ট বাকল যদি পাওয়া যায় সেই আশায় । মানুষ-গরু-ভেড়া সকলের ধাক্কাধাক্কিতে শান্তিনিকেতনের শান্তি নির্ঘাত বিনষ্ট হতে চলেছে । ঐদিকে কোন কবিই আমের বাটি থেকে নড়ছে না । আম জনতাও তাদের আমের দাবি ছেড়ে দেবে বলে মনে হয় না । একেবারে ম্যাসাকার অবস্থা হয়ে যাবে বলে মনে হলো । এখানে বেশিক্ষণ থাকা আমার জন্য নিরাপদ নয় । যা আছে কপালে তা হবে কাল সকালে । আপাতত জান বাঁচাই ।

‘’বাঙলার আম- তোমাকে জানাই প্রণাম!’’- এই বলে আজকের মতো আমি সটকে পড়লুম ।

Likes Comments
০ Share

Comments (2)

  • - মোঃসরোয়ার জাহান

    অথবা আকাশের দিকে দৃষ্টি মেলে আর দুই হাত খুলে

    হৃদয় নিংড়ানো স্বরে আমার পৃথিবীকে বলতে পারি,

    মা গো, আমি জীবন থেকে জন্মান্তরে

    তোমাকে শুধু ভালোবেসেই যাবো।--------------very nice

    • - কেতন শেখ

      অসংখ্য ধন্যবাদ। জয় হোক।

    - আলমগীর সরকার লিটন

    কেতন দা

    কবিতার গভীরতা অনেক

    মায়ের প্রতি ফুলেল শ্রদ্ধা রইল

    ভাল থাকুন--------

    • - কেতন শেখ

      অনেক ধন্যবাদ লিটন ভাই। জয় হোক।

    - মাসুম বাদল

    চমৎকার... 

     

     

    শুভকামনা রইলো... 

    • - কেতন শেখ

      অনেক ধন্যবাদ মাসুম, জীবন হোক মঙ্গলময়।