Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

কবি ও দার্শনিক

১০ বছর আগে লিখেছেন

হিমুরা যেমন হয়



রাত ১২টা বাজার সাথে সাথে নতুন তারিখ এসে গেল, ১৩ নভেম্বর । সিগেরেট শেষ হয়ে গেছে, কিনতে যাবো যাবো করছি সে সময় মোবাইলে ফোন এলো । ফোন রিসিভ করে দেখি আমার বড় খালা । তিনি খুব তিরিক্ষ মেজাজে বললেন , তুই কই রে ? তোকে ফোনে পাই না কেন ? আমি বললাম, এইতো আছি আর কি । শুনে খালা আরও ক্ষেপে গেলো, বললো দেখ আমার সাথে কোন পিছলামি করবি না । বাসায় আশিককে নিয়ে (আমার খালত ভাই ) টুক-টাক ঝামেলা চলতেছে । তোর বড়খালু তোকে আসতে বলছে । কালপরশু একবার বাসায় আয় । আমি কাহিনি কি বুঝে ফেললাম । মনে-মনে ডিসিশন নিয়ে নিলাম ঐদিকে আর মাস ছয়েকের মধ্যেও যাওয়া যাবে না । জেনেশুনে আগুনে ঝাঁপ দেয় ঝাঁসির রানি লক্ষিবাঈ । আমি ঝাঁপ দেবো কোন দুঃখে ! খালা আরও বললো,সাবধানে থাকিস, দিনকাল খুব খারাপ । ইদানীং কি সব ছুপা গ্যাং নাম দিয়ে বাজে-বাজে মেয়েছেলে বের হইছে । তারা প্রথম-প্রথম সুন্দর কথায় হ্যাংলামি করে প্রেম করে । পরে ডেটিংয়ে যাওয়ার নাম করে সুযোগ মতো ঐ ছেলের নুনু-টুনুসহ সব রেখে দেয় । খবর্দার ঐসব মেয়ের পাল্লায় পড়িস না । আমিতো শুনে হতভম্ব ! খালা কি বলে এইসব !! এইসব মেয়েছেলেও বের হয়েছে নাকি?! কালে-কালে আরও কত কি দেখবো খোদাই মালুম ! আমি কোনমতে হ্যা-হু করে ফোন রেখে দিলাম ।

রুপার সাথে কথা বলা দরকার । ( রুপা এখানে ছদ্মনাম । তবে বাস্তব জগতে তারা যেই নামেই থাকুক না কেন হিমুদের কাছে তাদের একটাই নাম ; রুপা ) । অনেক ঝক্কি-ঝামেলা করে তাকে ফোন দিলাম । কেমন আছো রুপা ? রুপা বলল,এইতো ভালো । তবে মন-মেজাজ ভালো না । কারণ জানতে চাইলে সে বলল, সন্ধ্যা থেকে অনেক পড়া পড়েছি কিন্তু এখন কিছুই মনে নাই । কেমনটা লাগে বলোতো ? কালকে পরীক্ষার ক্লাসে কি লিখবো ? আমি বললাম, ধুর আজকের মতো বাদ দাও লেখাপড়া ! কাল সকালে ঠাণ্ডা মাথায় আবার পড়াগুলো দেখে নিও । যা আছে কপালে তা হবে সকালে ! রুপা হাসে । শীতল কণ্ঠে বলে, কিছু বলবা ? আমি বললাম, না কিছু বলবো না । রুপা বলল , তাহলে আমি রাখি, ভীষণ ঘুম পাচ্ছে । আমি বললাম, ঠিক আছে রাখো । ফোন রাখামাত্রই আসল কাজের কথা মনে পরে গেলো, রুপার কাছ থেকে গরুর গোশত ভুনা করার কৌশলটা সেখা দরকার ছিল । আমার খালাতো ভাই আশিককে বুদ্ধি দিয়েছি একটা টং দোকান দেবার জন্য । সেখানে সাদাভাত আর গরুর গোশ ভুনা থাকবে । আর সাথে পাতলা ডাল । প্রতিপ্লেট ভাতসহ গোশভুনা ৮০ টাকা । পার বর্ডারে ২০ টাকা লাভ হবার কথা । দুপুর-রাতে ২০০ জন লোক খেলে দৈনিক চার হাজার টাকা লাভ ,আর মাসে এক লাখ বিশ হাজার টাকা নীট ইনকাম ! চাকরি-বাকরি করে কোন শালায় রে ? মজা করেই বলেছিলাম, এখন দেখি সে ব্যাপারটা বেশ সিরিয়াসলিই নিয়ে ফেলেছে । তার এখন একটাই লক্ষ্য; গোশ-ভাতের টং-দোকান খোলা । তবে আসল সমস্যা হলো খালু । তার ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলে গোশ-ভাতের দোকান খুলবে জানলে তিনি আমাকে নির্ঘাত জবাই করে ফেলবেন !

রাত দেড়টার দিকে সিগেরেট কিনতে বের হলাম । আশেপাশের কোন দোকানপাট খোলা নেই । মেডিকেল কলেজের সামনে কিছু দোকান সারারাত খোলা থাকে । প্রায় আধকিলো রাস্তা । হাটাছাড়া উপায় নেই । শুরুহল পদব্রজে ভ্রমণ । কিছুক্ষন হাটতেই পুলিশের এক পিকাপ এসে হাজির । এরা রাতে টহল দেয় । আমাকে এভাবে হাটতে দেখে সন্দেহ করে গাড়ি থামিয়েছে । আমি মনে মনে বললাম ,খাইছে আমারে ! আজকে বোধহয় হালুয়া টাইট হবে । সামনের সিট খুলে এক পুলিশ সার্জেন্ট নেমে এলো । পিকাপের খোলা দরজায় উকি দিয়ে দেখলাম তার সীটে একটা টেডিবিয়ার । পায়ের কাছে এক হালির মতো কচিডাব দেখা গেলো । শীতের রাতে কেউ কচিডাবও খায় নাকি !
সার্জেন্টের চোখে সানগ্লাস । গুরুগম্ভীর ভাবে তিনি প্রশ্ন করলেন , এই তুই কে রে ? এতো রাতে এখানে কি ? আমি হাসিমুখে শান্ত ভঙ্গিতে বললাম, স্যার সিগেরেট কিনতে বের হইছি । একটু মেডিকেলের দিকে যাবো । সার্জেন্ট বোধহয় সিগেরেট কিনতে মেডিকেলের দিকে যাওয়াটা পছন্দ করলো না । বলল , ঐ হালার পো , মেডিকেলে কি সিগেরেট বিক্রি হয় ? মানুষ ঔষধ কিনতে যায় আর তুই যাইতেছিস বিড়ি ফুকাইতে ! কি মতলবে বের হইছিস বল । নাইলে থানায় নিয়া সিদ্ধ ডিমের থেরাপি দিমু । আমার তো মাথা নষ্ট হয়-হয় অবস্থা । এরেস্ট কি হয়েই গেলাম নাকি ? সিদ্ধ ডিমের থেরাপি ! এটাতো মোটেই ভালো জিনিস নয় । যথাসম্ভব মাথা ঠাণ্ডা রেখে বললাম , স্যার যদি মাইন্ড না করেন একটা প্রশ্ন করতে পারি ? সার্জেন্ট বলল, তোর আবার কি প্রশ্ন ?! আচ্ছা, কর দেখি ।
আমি বললাম, এই যে আপনারা সিদ্ধ ডিমের থেরাপি দিচ্ছেন সেটা আসলে কিসের ডিম দিয়ে দিচ্ছেন স্যার ? সার্জেন্ট এই কথায় এক মিনিট স্তব্ধ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন । বললেন ,কেন...তোর কিসের ডিম হইলে সুবিধা হয় ? বললাম , না মানে ধরেন যে একেক ডিমের ফিলিংস তো একেক রকম হবার কথা । রাজহাঁসের ডিম দিলে একরকম, আবার দেশি মুরগির ডিমে আরেক রকম,আবার কোয়েলের ডিমে অন্যরকম । তবে স্যার ফার্মের মুরগির ডিম দিয়ে থেরাপি দিলে বেশি ভালো স্যার ।
তার মনে কিঞ্চিৎ আগ্রহ দেখা গেলো। তিনি বললেন , কেন বেশি ভালো ? বললাম , স্যার, সাধারন লেয়ার ফার্মের মুরগির ডিম ফুটে বাচ্চা হয় না স্যার । ঐ ডিম থেকে কোন নবজাতক বাচ্চা যেহেতু পাওয়া যাবে না তাই ঐ ডিম ইউস করাই ভালো না ?! তিনি বললেন , কেন কেন ? ঐ ডিম থেকে বাচ্চা হবে না কেন ?!! বললাম, কারণ ঐ ডিম পাড়ায় পুরুষ মোরগের কোন অবদান নেই স্যার । মোরগ ছাড়াই সেগুলো ডিম দেয় । তাই সেই ডিমে বাচ্চা হয় না স্যার । ঐগুলোকে টেবিল এগ বলে । সার্জেন্ট তো অবাক ! বললেন , বলেন কি আপনি ?! মোরগ ছাড়াই মুরগি ডিম দেয় ?! জানতাম না তো ?! আমি মনে মনে বলি, এই তো লাইনে আসা শুরু করেছিস চান্দু । তুই থেকে একদম আপনিতে চলে এসেছিস । খাড়া তোকে নিয়ে আরও একটু খেলি ।
বললাম , জ্বি স্যার । ডিম পাড়া তো মুরগির নরমাল ফিজিওলজি । ডিম তো তাকে পাড়াই লাগবে । তবে সেটা তা দিলে বাচ্চা হবে কি হবে না সেটা নির্ভর করবে ঐ মুরগি কোন মোরগের সংস্পর্শ পেয়েছে কি’না সেটার উপর। অনেকেই এটা জানে না স্যার । একথা শুনে সার্জেন্টের মনে চিন্তার বলিরেখা দেখা গেলো । মনেহচ্ছে সে কোন গুপ্তবিদ্যার সন্ধান পেয়ে গেছে । তাকে এবার মোক্ষম চাপা মারার সুযোগ এসেছে । আরও বললাম, স্যার আপনি হয়তো জেনে থাকবেন ডিমের যে প্রোটিন সেটা কিন্তু বাচ্চাদের পেটে সহজেই হজম হয় । লিভারের ফাংশনের ওপর তাই চাপ কমে, লিভার ঠাণ্ডা থাকে । বিশেষ করে জণ্ডিস আক্রান্ত বাচ্চাদের ক্ষেত্রে তো কথাই নেই । স্যার, আপনার মেয়ের অবস্থা এখন কেমন স্যার ??

আমার প্রশ্ন শুনে সার্জেন্ট তার চশমা নামিয়ে ফেললেন । চাহারায় তার বিষণ্ণতা দেখা গেলো । তাকে জায়গামতো হিট করা হয়েছে । একটু বিনয়ের সুরে বললেন, এখন একটু ভালোর দিকে । তাও টেনশনে আছি রে ভাই । একটাই মেয়ে তো , অনেক আদরের । সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখলে খুব মনটা খারাপ হয় । আমি একটু ভাব নিয়ে বললাম, হুম । বুঝতে পারছি । তবে টেনশন করবেন না স্যার , একটু সময় তো লাগবেই । ভালো ট্রিটমেন্ট হলে সব ঠিক হয়ে যাবে । আর স্যার , ডাবের পানিটা কিন্তু এসময় বেশ কাজে দেয় । ঐটা একটু কন্টিনিউ করান । সার্জেন্টের চোখে-মুখে হাসির ঝিলিক দেখা গেলো । বললো, হ্যা , হ্যা ... ডাবের পানি , ডাবের পানি ! আমি খাওয়াচ্ছি রেগুলার ! তাহলে স্যার নো চিন্তা , আপনি আল্লাহ ভরসা করে বাড়ি যেতে পারেন স্যার । সার্জেন্টের সাথে আর কথা বাড়ল না , তিনি আমাকে এরেস্ট না করেই চলে গেলেন । যাবার আগে বলে গেলেন, রাতে এভাবে হুটহাট করে বের হবেন না রে ভাই ! বোঝেনই তো দেশের কি অবস্থা । আমি শুধু বললাম, জ্বি স্যার,জ্বি স্যার ।

মেডিকেল গেটের দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগেরেট আর পাউরুটি কিনে আবার বাসার দিকে হাটা শুরু করলাম । মাঝপথে এক নেড়ি কুকুর আমার পিছু-পিছু আসতে শুরু করলো । কুকুরটা বোধহয় খুব ক্ষুধার্ত । পাউরুটির আশায় আমার পিছু নিয়েছে । তাকে নিরাশ করা ঠিক হবে না । প্যাকেট খুলে রুটিগুলো তাকে খাওয়ালাম । এ জগতে সবাই নিরাপত্তা চায় । এই কুকুরটি এখন যেমন তার ক্ষুধা নিবারনের নিরাপত্তা চাইছে আমিও তেমনি একাকি এই রাতে আমার সুরক্ষার নিরাপত্তা চাইছি । এক প্যাকেট ব্রেডের বিনিময়ে এর চেয়ে ভালো প্রহরি আর কে’ই বা হতে পারে ! আমি বাসার দিকে হাঁটছি , কুকুরটিও আমার পিছু-পিছু হাঁটছে । বাসার কাছাকাছি এসে আমি আমার এক হাতের আঙ্গুল একত্র করে কুকুরের নাক বরারবর রাখলাম । সে গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করলো । আমি সেই হাত তার মাথার পেছনে রেখে আদর করে দিলাম । সে আদর পেয়ে কুঁইকুঁই করতে লাগলো । বললাম , আর আসা লাগবে না । চলে যা । সে তা বুঝলো কি’না জানি না । কুকুরটি রাস্তার এক ধারে বসে পড়লো । আমি হেটেই চললাম । সে এখন আমার সাথে আসতেও পারছে না, আবার ফিরে যেতেও পারছে না । সামান্য ব্রেডের বিনিময়ে আমার কাছে সে দায়বদ্ধ হয়ে ছিল। আমি তাকে দায়মুক্ত করলাম । দায়মুক্তির নিঃশ্বাস অনেক স্বস্থির নিঃশ্বাস ।

আজ বাসার দূরত্বটা কি বেড়ে গেলো না’কি ? হাটতে হাটতে পথই শেষ হচ্ছে না । আজকের জোছনাটাও কেমন যেন অচেনা লাগছে । রুপার কথা মনে পড়ছে । কি করছে এখন রুপা ? নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছে । আমি তার ঘুমন্ত মুখটা কল্পনাতে আনার চেষ্টায় ব্যাস্ত । দেখলাম ঘুমের ঘোরেও রুপার মুখে হালকা হাসির আভা দেখা যাচ্ছে । নিশ্চয়ই এখন সে আমাকে স্বপ্নে দেখছে । কোন ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে বসে সে বোধহয় আমাকে মজার-মজার গল্প শোনাচ্ছে, আমি হয়তো তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছি । তার মুখের হাসিটা আরও বিস্তৃত হচ্ছে । এই ঘুমনগরীর রাজকুমারিটা কি জানে তাকে এখন কতোটা সুন্দর লাগছে !

উৎসর্গ ; হুমায়ুন আহমেদ কে ।।
13 November 2013

Likes Comments
০ Share