Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

বিপুল হাজং

৮ বছর আগে লিখেছেন

চা-শ্রমিকের বন্দিজীবন

কথা ছিলো,‍‍ “পাহাড় ঘেরা দেশে একটা চমৎকার বাগান, যেখানে গাছের পাতাটি খাঁটি সোনার। কেউ যদি ঝাঁকুনি দেয় অমনি ঝরে পড়ে সোনার পাতাগুলো।” বস্তুত, তখন থেকেই শুরু হয়েছিলো পৃথিবীর সব থেকে জনপ্রিয় পানীয় চা-শ্রমিকদের দাসত্বের জীবণ আর তাদের জীবন-বঞ্চনার করুন গাঁথা।

প্রায় পাঁচপুরুষ আগে পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি থেকে চলে আসা তাদের জীবন আবদ্ধ হয়ে আছে মধ্যযুগীয় ভূমিদাসদের মতই বাংলাদেশের লেবার লাইনের কুঁড়েঘরে। আদিবাসী ও নিম্ন বর্ণের হিন্দু তথা দলিত সম্প্রদায়ের লোকদের ব্রিটিশ কোম্পানীগুলো ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে নিয়ে এসেছিলো সিলেট এলাকার চা-বাগানগুলোতে এক বেদনাময় অভিভাসন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। জানা যায়, শুরুর কয়েক বছরে ক্লান্তিকর দীর্ঘ যাত্রা, কঠিনতর কর্ম এবং প্রতিকুল কর্মপরিবেশ এক-তৃতীয়াংশ শ্রমিকের করুণ মৃত্যু ডেকে আনে।

কোম্পানীগুলোর সাথে চার বছর মেয়াদী চুক্তির পর দেরশ বছর অতিক্রান্ত হলেও এখনো কোন পরিবর্তন ঘটেনি তাদের লেবার আইনে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ জীবনচক্রে। এদেশের নাগরিক এবং ভোটার হলেও জমির ওপর তাদের নেই কোন অধিকার। সংবিধানে উল্লেখিত নাগরিক সুবিধা পাবার বদলে যেন সকল রকম বঞ্চিনাই প্রতিনিয়ত তাদের নিত্যসঙ্গি। বর্তমানে তিন ক্যাটাগরিতে একজন শ্রমিকের দৈনিক মজরী সবোর্চ্চ ৬৭ টাকা। প্রখর রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে আর দাঁড়িয়ে কাজ করে এত কম মজুরীর ফলে স্বাভাবিকভাবেই তারা ভুগছে অপুষ্টিতে, নিরক্ষরতায়, সামাজিক মর্যাদায় ।

বর্তমানে সিলেট, মেৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার চা বাগানগুলোতে যে সকল আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী এবং দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ চা-শ্রমিক হিসেবে বসবাস করে আসছে সেগুলো হচ্ছে, বারাইক, বিহারি, পাহান, তেলেগু, বানাই, বাউরি, মুন্ডা, বীন, ভূজপুরি, ভূমিজ, বোনাজ চেৌহান, গন্ডো, গুর্খা, গারো, সান্তাল, ওরাও, খারিয়া, কন্দ, মাদ্রাজি, মুশহর, নায়েক, নুনিয়া, উড়িয়া, পানিকা, বাশফোর, কৈরি, বাকদি, কান্দিলি, রাউতিয়া, গোয়ালা, গর, রাজবর, মৃধা, মাহালী, পাত্র, শব্দকর, পাহাড়ী, তেলী, পাশি, দোশাদ, রবিদাস, তাঁতী ইত্যাদি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস হারিয়ে ফেলেছে। সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ে তারা কথা বলে বাংলা আর উড়িয়া ভাষার পরিবর্তিত মিশ্রিত রূপ “দেশওয়ালী” ভাষায় অথবা পরিবর্তিত হিন্দি ভাষায়।

গত ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী মহাজোট সরকারের প্রধান আওয়ামী লীগের ইস্তেহার “দিন বদলের সনদ”-এর ১৮.১ অনুচ্ছেদে বলা হয়, “ধর্মীয় সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা, আদিবাসী ও চা বাগনে কর্মরত শ্রমজীবী জনগোষ্ঠির ওপর সন্ত্রাস, বৈষম্যমূলক আচরন এবং মানবাধিকার লংঘনের চির অবসান, তাদের জীবন, সম্পদ, সম্ভ্রম, মান মর্যাদার সুরক্ষা এবং রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকারের বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করা হবে। আদিবাসীদের জমি, জলাধার এবং বন এলাকায় সনাতনি অধিকার সংরক্ষনের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণসহ ভূমি কমিশন গঠন করা হবে। সংখ্যালঘু, আদিবাসী, ক্ষুদ্র নৃ-জাতিগোষ্ঠী এবং দলিতদের প্রতি বৈষম্যমূলক সকল প্রকার আইন ও অন্যান্য ব্যবস্থার অবসান করা হবে। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু এবং আদিবাসীদের জন্য চাকরী ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করা হবে। ” এছাড়া ওয়াকার্র্স পার্টি ও বি.এন.পির ইস্তেহারে চা শ্রমিকদের অধিকারের কথা বলা নেই।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইস্তেহার অনুযায়ী ২০০৯ সালে “নিম্নতম মজুরীবোর্ড” গঠন করে তিন ক্যাটাগরিতে ৪৮,৪৬ ও ৪৫ টাকা দৈনিক মজুরী নির্ধারন করা ছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছু পরিবর্তন হয়নি। চা শ্রমিকদের নিজেদের থাকার ভূমি না থাকায় শ্রম আইন-২০০৬ সংশোধন করে ৩২ নং ধারাটি পরিবর্তন করে যখন তখন উচ্ছেদ বন্ধ করা দরকার। এছাড়া ছুটি ও মাতৃত্বকালীন ছুটি বৈষম্য, লভ্যাংশের শতকরা পাঁচ ভাগ শ্রমিক কল্যান তহবিলে জমা সহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ইত্যাদি বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা জরুরী।

আদিবাসীদের মতই তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, প্রথা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি। আইএলও কনভেনশন ১০৭নং অনুসারে আদিবাসী হিসেবে পরিচিত হবার সকল বৈশিষ্ট্যও তাদের রয়েছে। সেইজন্য তারা নিজেদের এই দেশের আদিবাসী মনে করে এবং নিজেরা আদিবাসী হিসেবে পরিচিত হতে চায়। চা জাতিগোষ্ঠী আশায় জীবণ কাটায়, কেউ না কেউ তাদের এই বন্দিদশা থেকে মুক্ত করবে, বিকশিত হয়ে অন্য সবার মতই পৃথিবীর আলো দেখবে। তারা আশাহত হয় তবুও আশায় বুকবাঁধে । ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন-২০১০ এর তফসিলে যোগ হয়েছে আরও ২৩টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর নাম, কিন্তু এবারও অন্তর্ভূক্ত হলো না চা জাতিগোষ্ঠীর প্রায় ৯৩টি জাতিগোষ্ঠীর নাম।তারা জীরণ সংগ্রামে টিকে থাকতে চায়, তারা তাদের অধিকার চায়, তারা মানুষ হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে আত্মমর্যাদার স্বীকৃতি চায়। তাই তারা তাদের প্রিয় সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সরকারের নীতিনির্ধারক মহলে ন্যায্য অধিকারের কথা বলে যাচ্ছে।

সার্বিক বিবেচনায় চা জনগোষ্ঠী হচ্ছে দক্ষিন এশিয়া তথা বাংলাদেশের সবচেয়ে মেৌলিক অধিকার ও সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক মানুষগুলোর অন্যতম। আমাদের সংবিধানের ২৭ ধারা দেশের সকল নাগরিকের জন্য সমাধিকারের নিশ্চয়তা দিয়েছে এবং ২৮(১)ধারায় ধর্ম,বর্ণ, গোষ্ঠী, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারনে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদান করবে না বলা হয়েছে। সুতরাং এদেশের নাগরিক হিসেবে তারা যে বঞ্চনার স্বীকার তা কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। চা-শ্রমিক ও স্বল্প পরিচিত এই জাতিস্বত্ত্বার মানুষের বঞ্চনায় রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল ও সমাজ অচিরেই পাশে দাড়াবে এবং একটি বৈষম্যহীণ সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পাবে বলে আমরা আশা করি। 

Likes Comments
০ Share

Comments (3)

  • - মুহাম্মাদ আরিফুর রহমান

    এখনেই শেষ ! শেষ হল না মনে হল ...