বয়সের কারনে কিংবা সময়ের কারনেই হোক রাহেলা বেগমের চোখের নীচে কালিটা অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ছে। ঠিক কতোগুলো দিন তিনি দু চোখ ভরে ঘুমান নি তা একমাত্র তিনিই বলতে পারেন। প্রাইমারী স্কুলে পড়ুয়া ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চা দের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তার কাছ অনেক সহজ হলেও কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে চতুর উকিলের জেরা জীবনে এই প্রথম।
-আপনি জানেন,এই ছেলেটিই আপনার মেয়েকে রেপ করেছিলো তাও আপনি এর সাথে মেয়েকে বিয়ে দিলেন?
আচমকা এমন প্রশ্নের জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না রাহেলা বেগম,কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে উকিলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন আর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো বিন্দু বিন্দু জল।
-মেয়েটা রেপ হবার পর সমস্ত আলামত ,মেডিকেল সার্টিফিকেট তো আপনার হাতেই ছিলো, তাহলে মামলা না করে বিয়ে দিলেন কেন? আপনিতো েকজন প্রাইমারী স্কুল শিক্ষিকা।
এবার রাহেলা বেগমের মাথার উপোর যেন ভোঁ ভোঁ করে কিছু একটা ঘুড়তে লাগলো । চারপাশটা কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে,দূর থেকে ভেসে আসতে লাগলো মিনির বাবার চিৎকার—ঐ হারামী মাগী,গতর খাকী। মাইয়া রেইপ হইসে তাও তুই ওরে কলেজে পাঠাস। মাইয়া দিয়া বিজিনেস করবি নাকি?
বলেই রাহেলা বেগবের পিঠের উপর পড়লো দুই চারটা বেল্টের বাড়ি ।
রাহেলা বহু কষ্টে উঠে বসে বললো-এতে আমার মেয়ের কি দোষ,ও তো কিছু করে নাই।
কথা শেষ না হতেই আবার চুলের মুঠী ধরে দিলো টান।
-এত্তো বড় কথা। তোর মাইয়া শরীল দুলায় হাটবো,আর পুলারা নজর দিলেই দুষ।
এলাকায় আর কি কোন মাইয়া ছিলো না,আমার মাইয়ারে ধরলো ক্যান? নিশ্চয় অর কুনো মতলব ছিল। আইজ থেইকা ওর কলেজ যাওয়া বন্ধ।
স্বামীর মুখের উপর কিছু বলবে এই শিক্ষা নিয়ে রাহেলা সংসার করছেন না,তাই মার খেয়ে দমে রইলেন। সে রাতটা কোন রকম মা মেয়ে না খেয়ে কাটিয়ে দিলেন।
পরদিন বিশাল শালিস বসলো রাহেলা বেগমের বাড়ীতে । এলাকার অনেক নামী দামী লোক এলেন। সবার একটাই মত – যে ছেলে এমন সর্বনাশ করলো মেয়েটার তাকে পুলিশে দেওয়া উচিৎ।
নড়েচড়ে দাঁড়ালেন মিনির বাবা। পিতা হবার লজ্জায় যেন তার মাথা কাটা যাচ্ছে।
-হেরে পুলিশে দিয়া কি হইবো? পুলিশ কি আমার মাইয়ার ইজ্জত রক্ষা করবো নাকি?
এমন প্রশ্ন শুনে সবাই হতভম্ব হয়ে গেলো। একজন মুরুব্বী প্রশ্ন করলেন-তাহলে তুমি তোমার মেয়েকে কি করতে চাও?
-কি করতাম,পুলারে কন মাইয়ারে বিয়া করুক,একটা বড় অংকের দেন মোহর ধরলেই চলবো।
সবাই একে অন্যের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন,আবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন মিনির বাবাকে-ওখানে যদি তোমার মেয়ের আরো অত্যাচার হয় তখন কি করবা?
-বিয়ার পর বাপ মার কোন দায়িত্ব নেওয়া লাগে না।
মিনির বাবার নিরুত্তাপ জবাব শুনে শালীস ভংগ করে মুরুব্বীরা প্রস্থান করলেন।
সেই থেকে মিনি বন্দী হলো বিয়ে নামক এক অচেনা জাদুর বাক্সে।
রাহেলা বেগম পুনরায় বর্তমানে ফিরে এলেন উকিলের আরো প্রশ্নের আক্রমনে।
-দেন মোহর কতো ধরা হয়েছিলো?
পাশ থেকে কেউ একজন বলে দিলো-দশ হাজার।
আবার প্রশ্ন-কতো উসুল হয়েছিলো?
রাহেলা এবার মাথা নীচু করে না সূচক মাথা নাড়লেন।
-আপনি যে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন এতে কি মেয়ের উপর অত্যাচার কমেছিলো? ছেলে কি টাকা পয়সার জন্যে কোন চাপ দেয় নি?
রাহেলা আবার ফিরে গেলেন অন্ধকার ঘরে যেখানে মিনির কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। অবিরত কেঁদেই চলেছে মেয়েটা,অত্যাচারের মাত্রা এতোটাই ছিলো যে যোনীপথ দিয়ে রক্ত ঝরছিলো। হাসপাতালে নিয়ে যাবার মতোন অবস্থা ছিলো না মিনির,যা চিকি্তসা তা ঘরে বসেই। আর মেয়ের এমন অবস্থায় বাবা টাকা দিবে তো দূরে থাক শ্বসুর বাড়ী থেকে মিনি চলে এসেছে এটা কিছুতেই মানতে পারছিলেন না। বার বার রাহেলাকে বলছিলেন-তুমারে যে আমি মাড়ি,তুমি কি সংসার থুইয়া বাপের বাড়ী চইলা গেসো নাকি? বুঝাও মাইয়ারে -জামাই যা চায় তাই করতে।
নির্বাক রাহেলা কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। একদিকে সন্তান ,অন্যদিকে স্বামী।
সেই কবে এই সংসারে ঢোকার আগেই তার মা শিখিয়ে দিয়েছিলেন –কখনো স্বামীর কথার বর খেলাপ হতে নাই। সেই স্বামীই এখন সন্তানের জীবনের জন্যে বিরাট জম।
এই ঘটনার কিছু দিনের পর এলাকার কিছু নারী কর্মী মিনিকে নিয়ে কাজি অফিসে গিয়ে তালাক করিয়ে নেয়। তারপর মহিলা আইনজীবীদের মাধ্যমে পাশন্ড টার বিরুদ্ধে মামালা করে দেয়।
এর পর থেকে এভাবেই চলছে। প্রতিমাসে পারিবারিক আদালত একটা করে তারিখ দিচ্ছে আর রাহেলা প্রতিবার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে। যার বিরুদ্ধে মামলা সে বেশ আয়াশ করে এসে উপস্থিত হয় প্রতিবার। তার বিরুদ্ধে অত্যাচারের কোন আলামত নেই,তাকে কোন ভাবেই ধরা যায় না। কাবিনের টাকার ব্যাপারে সে কিছুই জানে না এমন একটা ভাব করে,কারন কাবিনের কাগজটা সে সরিয়ে ফেলেছে অনেক আগেই।
প্রমান ছাড়া যে আদালতের সামনে কোন অপরাধ অপরাধ নয় তা রাহেলা বুঝতে পারছেন হাড়ে হাড়ে। কিন্তু ক্লান্ত চোখ অনেক কিছু বলতে চায়,তার চোখের এই অজানা ভাষা কেউ বুঝতে পারে না।তার আকুতি বিষন্ন পায়ড়া হয়ে থমকে থাকে আদালতের সুউঁচ্চু প্রাচীর চূড়ায়।
(অবিশ্বাস্য হলেও ঘটনাটা রাজধানী শহরের ব্যস্ত জনপদে ঘটে যাওয়া একটি সত্য ঘটনা।)
Comments (4)
নিয়মিত লিখে যান। গুরুত্ব পুর্ন যে কোন সাবলীল আলোচনা চলতে পারে
ধন্যবাদ ভাই।