Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

শাহিন মোহাম্মাদ ফয়সাল

৯ বছর আগে লিখেছেন

মহেশ

১  
***

বাড়ি ফিরেছে লতিফ। পড়নের শার্টটায় শত ময়লা, ময়লা লুঙ্গির খুটের মধ্যে অনেকগুলো টাকা, হাতে বাজারের ব্যাগ। বাড়ি ফিরেই সে হাক ছাড়লো, "আমিনের মা, কই গেলা?" 
ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো আমিনের মা, স্বামীকে দেখেই হাসিমুখে ছুটে এসে হাতের বাজারের ব্যাগটা নিলো যাতে স্বামীর কষ্ট করতে না হয়, লতিফ জিজ্ঞেস করলো, "আমিন-মরিয়ম কই?"
"মরিয়ম পাশের বাড়ি গেছে, আর আমিন ঘরে বইসা আছে।"
"আমিনের মন কি এহনো খারাপ?"
"হো!"
"ব্যাগের মধ্যে ওর জন্য একটা জামা আছে, গিয়ে দাও ওরে। মরিয়মের জন্যও আছে, ওরেও দিও বাড়ি আইলে।"
"আচ্ছা" বলেই ঘরের মধ্যে গেলো আমিনের মা, আর লতিফ শার্ট খুলে চলে গেলো পুকুরে গোসল করতে।  

ঘরের এক কোনায় খাটে বসে আছে আমিন, তার মা এসে নতুন জামাটা দিলো আমিনকে, "তোর বাপ আনছে তোর জন্য, পরে দেখ।"
জামাটা হাতে নিয়ে হাত বুলালো আমিন, মা'কে জিজ্ঞেস করলো, "আমার গরুটা কি বাবায় বেইচা দিসে?"
"হো!"
জামাটা হাত থেকে নামিয়ে খাটে রেখে দিলো আমিন, তার মা কাছে এসে বসে আমিনকে বুঝালো, "তুই আমগো বড়ো পোলা না? বড়ো হইসস না? তোর বাপের কতো দেনা। ওইগুলা শোধ করতে হইবো না? তুই না বুঝলে আর কে বুঝবো? মন খারাপ করিস না, আয় খাইতে আয়, আর তোর বাপেরে জামাটা পইড়া দেখাইস, তোর বাপ খুশি হইবো।"
চুপ করে রইলো আমিন। তার মা উঠে চলে গেলো পাকঘরে।  

ঘরের দরোজাটা দিয়ে বাইরে উঠানের দিকে তাকিয়ে আছে আমিন, তার গরুটার জন্য তার খারাপ লাগছে, বাবা তো কখনোই গরুটার দিকে খেয়ালও করে নি। আমিনই গরুটাকে ঘাস খাইয়েছে, মাঠে নিয়ে গিয়েছে, সন্ধ্যাবেলায় মাঠ থেকে ঘরে নিয়ে এসেছে। ক্লাসের বাংলা বইয়ে একটা গল্প পড়ে সবার অগোচরে গরুটাকে সে মহেশ নামে ডেকেছে, সাথে কেউ থাকলে হাসাহাসি করবে, তাই মানুষের সামনে ডাকেনি। অন্যসবার মতো তো গোয়ালভরা গরু না তাদের, একটা মাত্র মহেশ তার, কয়টা টাকার জন্য সেই মহেশকেই বাবা বিক্রি করে দিলো! চোখ ঝাপসা হয়ে আসে আমিনের, দরোজা থেকে চোখ ফিরিয়ে হাত দিয়ে চোখ মুছে নিলো সে তাড়াতাড়ি।  


***

বাড়ির সামনে গাছের সাথে বাধা মহেশ। সামনে অনেকগুলো মানুষ। মহেশ কিছুই বুঝতে পারছে না।

"গরু তো চমৎকার হয়েছে শফিক সাহেব!" রহমান সাহেব হেসে বললো।
শফিক সাহেব চোখের চশমাটা খুলে পাঞ্জাবীর কোণা দিয়ে মুছতে মুছতে বললেন, "এবার কপালটা ভালো, বুঝেছেন রহমান ভাই। হাটে যাবো বলে বের হয়েছি, বাসা থেকে বেড়িয়ে কিছুদূর আগাতেই দেখি এক লোক তার গরুকে হাটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে বিক্রি করার জন্য, একটামাত্র গরু নিয়েই এসেছে। বেশ কিনে ফেললাম।"
"বাহ্‌! ঘরে পালা গরু! তাহলে তো এবার জিতেছেন ভাই! গরু তো দেখি বেশ শান্ত।"
গর্বের হাসি দিলেন শফিক সাহেব। এবার তাদের কোয়ার্টারের সবার চেয়ে তার গরুটাই সুন্দর, সবাই এক বাক্যে তা মেনে নিয়েছে, শফিক সাহেবের ভাবতেই আনন্দ লাগছে।

শফিক সাহেবের পাশে এসে ততক্ষণে দাঁড়িয়েছে তার ছোট ছেলে আজাদ, বাবাকে জিজ্ঞেস করলো, "আমাদের গরু কোনটা বাবা?"
"এই যে বাবা, গরুটা পছন্দ হয়েছে?"
"হুম বাবা! গরুটার মাংস খাবো কখন বাবা?"
"কাল বাবা, কাল সকালে আমার সাথে নামাজ পড়ে এসেই কুরবানী হবে। তারপর মাংস খেতে পারবে।"
"ও" বলে খুশিমনে ছুটে ঘরে চলে গেলো আজাদ।   


অপেক্ষা করছে আমিনের মহেশ, এখানে কাউকেই সে চিনতে পারছে না। কিছুক্ষণের মাঝেই তার চারপাশ থেকে সবাই চলে গেলো, মহেশ চুপচাপ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কিছুক্ষণ সামনে রাখা খড় খেলো, পানি খেলো। চারপাশ ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে আসছে, কেউ তখনও তাকে নিতে আসলো না! এবার অস্থির হয়ে পড়লো মহেশ, কেউ আসছে না কেনো? রাতটা কি এই গাছের সামনেই কাটাতে হবে? এমন তো কখনো হয় না! অন্ধকার হতে নিলেই তাকে ঘরে নিয়ে যায় পরিচিত একটা মুখ!  

অন্ধকার হওয়ার অনেকক্ষণ পর টর্চ হাতে গরুটাকে দেখতে এলেন শফিক সাহেব, তার সাথে ছোটছোট পায়ে এলো আজাদ, মহেশ ততক্ষণে শান্ত হয়ে গিয়েছে, খড়গুলোর উপর বসে অপেক্ষা করছে বাড়ি যাবার!
শফিক সাহেব গরুটার সামনে খড়ের উপর আলো ফেললেন, হাক ছেড়ে করে ডেকে উঠলেন, "এই আলি, গরুটাকে আরও কিছু খড় আর পানি দিয়ে যাও।"  বলে তিনি গরুটার উপর আলো ফেললেন, আজাদ হঠাৎ বলে উঠলো, "বাবা দেখো, গরুটা কাঁদছে!"  

৩  
***

ঈদের দিন সকাল, নামাজ পড়ে শফিক সাহেবসহ তার কোয়ার্টারের সবাই দাঁড়িয়ে আছে গরুগুলোর সামনে। হুজুর আস্তে দেরী হচ্ছে দেখে সবাই বেশ বিরক্ত। রহমান সাহেব বলেই ফেলল, "এতো দেরী করলে গরু কাটবে কখন? সন্ধ্যা তো হয়ে যাবে গরু কাটা শেষ হতেই!"
পাশ থেকে আলি বলল, "হুজুর পাশের কোয়ার্টারে আছে, ওইখানে কুরবানী দেয়া শেষ হলেই চলে আসবে এখানে।"
শুনে কেউ শান্ত হলো না, হুজুরের দেরী কেউ মেনে নিতে পারছে না। 

কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এলো হুজুর, সব কসাইরা মিলে প্রথমেই ধরলো মহেশকে, মহেশ কিছু বুঝে উঠবার আগেই হঠাৎ শুইয়ে ফেলল কসাইরা মিলে। অসহায়ের মতো মহেশ দেখলো, হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে সবাই, শফিক সাহেবকে রহমান সাহবে আবার বললেন, "এবার কিন্তু ভাই আপনার গরুটা আসলেই সবার চেয়ে ভালো হয়েছে।" হাসিমুখে শফিক সাহেব বললেন, "সবই আল্লাহ্‌র ইচ্ছা, হুজুর শুরু করেন, সবাই আল্লাহু আকবর বলি!"
সমস্বরে সবাই হাসিমুখে বলে উঠলো, "আল্লাহু আকবর!"
মহেশের শরীর হঠাৎ ব্যথায় ভরে উঠলো, সমস্ত শক্তি দিয়ে সে ঝটকা দিয়ে উঠলো, তারপাশে রক্তে ভরে গিয়েছে, মাথা তুলে সে দেখতে নিলো তার এতো ব্যথা হচ্ছে কেনো? পারলো না, ঝপাৎ করে পড়ে গেলো মাটিতে। কয়েকফোটা রক্ত ছিটকে গিয়ে পড়লো শফিক সাহেবের পাঞ্জাবিতে, গর্জে উঠলেন উনি, "কি মিয়া, একটা গরু ধরতে পারো না? কসাই হইসো কিজন্য?" বলে রাগে কিযেনো বিড়বিড় করতে করতে এগিয়ে গেলেন পাশে রাখা বালতির পানির দিকে। 
মহেশ তখনো ছটফট করছে ব্যথায়, আস্তে আস্তে তার সব বোধ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কানের কাছে মনে হলো হাজারো মানুষের চিৎকার-চেচামেচি। সে চোখ উল্টে দেখার চেষ্টা করছে কারা তাকে ব্যথা দিচ্ছে! চোখ ফিরাতেই সে দেখলো একটা ছোট্ট ছেলে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে শফিক সাহেবের দিকে।

আজাদ এসে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করলো,"বাবা মাংস রান্না হবে কখন?" 
চোখ বুজলো মহেশ!   

৪  
***

সকালে নামাজ পড়ে এসে চুপচাপ গতকাল বাবার আনা শার্টটা, রোজার ঈদে কিনে দেয়া প্যান্টটা পড়লো আমিন। বাবা ভোরে বের হয়ে শহরে চলে গিয়েছে মাংস কাটার কাজ করতে। তার মা সেমাই খাইয়ে দিলো তাকে আর মরিয়মকে। মরিয়মের ঈদ নিয়ে খুব উৎসাহ, নতুন জামা পড়ে বন্ধুদের সাথে আজ সারাদিন খেলবে সে!
আমিন এবার খুব একটা উৎসাহ পেলো না, তার মন অতোটা ভালো নেই, সে বন্ধুদের সাথে চুপচাপ অনেকক্ষণ ঘুড়াঘুরি করে দুপুরের দিকে ফিরে এলো মরিয়মকে নিয়ে। ঘরে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে সকালের কিছু সেমাই খেয়ে নিলো, খাওয়া শেষে তার মা এলো হাতে পলিথিন নিয়ে। দু ভাইবোনের হাতে পলিথিন ধরিয়ে দিলো, কুরবানীর ঈদের এই অংশটা তাদের দু ভাই-বোনেরই খুব পছন্দ, সব বন্ধুরা মিলে বাড়ি বাড়ি ঘুরে মাংস জোগাড় করা। 

পলিথিন হাতে ঘুরতে ঘুরতে আমিন ভুলে গেলো মহেশের কথা, তার হাতে পলিথিনভর্তি মাংস, আজ রাতে তার মা ঝাল করে সে মাংস রাধবে, পেট ভরে মাংস দিয়ে ভাত খাবে সবাই। ভাবতেই জিভে জল চলে আসছে আমিনের। কতোদিন মাংস খাওয়া হয়না! এসব ভাবতে ভাবতে অনেকদূর চলে গেলো সে বন্ধুদের সাথে, সেই সাথে পলিথিনটা ভরে গেলো মাংসে।

সন্ধ্যা হতেই সে ফিরে এলো বাড়িতে, তাদের দুভাইবোনের হাতের দুটো পলিথিনেই মাংসপূর্ণ, বাড়ি ফিরে দেখলো বাবাও চলে এসেছে, মা খুব দ্রুত চুলোয় কড়াই চাপালো। আর তর সইছে না আমিন আর মরিয়মের, কখন মাংস রান্না হবে!   

রাতে প্লেটভর্তি ভাত আর মাংস নিয়ে বসেছে আমিন-মরিয়ম আর তাদের বাবা। আমিনের পেটপুরে মাংস খাচ্ছে ভাত দিয়ে, মাঝে মাঝে পেয়াজের টুকরোটায় একটা কামড় বসাচ্ছে। তার মা বসে বসে সবার খাওয়া দেখছে। আমিনের পাতে তিনি আরও তিনটে টুকরা মাংস তুলে দিলেন, হাসিমুখে মায়ের দিকে তাকালো আমিন। মুখে মাংসের ঝোলে মাখামাখি তার, ঝালে একটু পরপর নাক টানছে সে। দেখে কি ভালোই না লাগছে তাদের মায়ের।    


সেদিন রাতে পেটপুরে খেলো আমিন-মরিয়ম, তাদের বাবা-মা, রহমান এবং শফিক সাহবের পরিবারের সবাই, ছোট্ট আজাদও খেলো তার ছোট্ট প্লেটে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় সবার মুখের ছিলো তৃপ্তির হাসি, আমিনও ভুলে গিয়েছে তার মহেশের কথা। হাতভর্তি মাংসে মাখা ভাত মুখে দেয়ার সময় সে একবারও ভেবে দেখেনি, তার খাওয়া মাংসগুলোর কয়েকটি টুকরা হয়তো তার মহেশেরও ছিল!
Likes Comments
০ Share

Comments (2)

  • - রুদ্র আমিন

    যদি হারিয়ে যাই

    পথ ভূলে অচেনা অজানা কোন এক গায়

    তখন কি ভুলগুলো আমার শুধরে নেবে না কেউ

    এ আত্মা মায়া ভালবাসার কি নেই কোন দাম

    আমি আসব, আবার ফিরে আসব

    দেখবো কে কতটা স্মরণ করেছে আমায়

    কতটা ভালবাসা পেরেছি উজাড় করে দিতে

    কতটা পারিনি শোধরাতে

    আপন ভুল, আপনার মাঝে;

    তবুও রেখো মনে, স্মৃতিছাড়া আমার যে

    আর কিছুই নাই;

    যতই ভুল করি না কেন

    মায়ার বাঁধনে একটি দিন না হয় কিছুটা সময়

    আপন করে নিয়েছি আমি তুমি তোমরা

    থাক না স্মৃতি হয়ে

    ভালবাসার এ বন্ধন।

     

    এই লেখাটি শুধুই নিচের কিছু কথার কারনে লেখা।

    [প্রতিযোগিতায় যারা বিজয়ী হয়েছেন তারা অবশ্যই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন অথবা প্রতিনিধি পাঠাবেন। পুরস্কার অনুষ্ঠানের পর কোনভাবেই প্রদান করা হবে না এবং সম্মননা বাতিল করা হবে।]

    • - সুলতানা সাদিয়া

      আমি কয়েকমাস ধরে অসুস্থ থাকায় সব ধরনের কাজ থেকে দূরে ছিলাম, এই যে প্রাায় ৫ মাস পর ব্লগে ফিরলাম। সরি যোগাযোগ করে আগের পুরস্কার নিতে পারিনি। আপনাদের আন্তরিকতার জন্য ধন্যবাদ।

    • Load more relies...
    - ব্লগ সঞ্চালক

    বিগত দিনের কিছু পুরস্কার ও সম্মাননা নক্ষত্র অফিসে পড়ে আছে যা এখন পর্যন্ত গ্রহণ করতে আসেননি কিংবা কে কবে কিভাবে পুরস্কারটি গ্রহণ করবেন তাও জানান নি। যার ফলে আমরা এরকম সিন্ধান্ত নিয়েছি।

    কাউকে সম্মাননা থেকে বঞ্চিত করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। অসুবিধা থাকতেই পারে। এই জন্য যোগাযোগ করে কথা বলে নিলেই হবে। ধন্যবাদ আপনাকে। 

    - মোহাম্মদ জমির হায়দার বাবলা

    ব্লগ কর্তৃপক্ষ সহ আয়োজনের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ।

     

    Load more comments...