উৎসর্গ ঃ ঘাসফুল এবং বাবলা ভাই।
(‘খেয়া নৌকায় ইফতার’ নামক প্রথম আলো ব্লগে আমার গল্প পড়ে প্রিয় ঘাসফুল এবং বাবলা ভাই আমাকে গল্প লেখার জন্য যে উৎসাহ দিয়েছিলেন সেইটা আমি আজও ভুলি নাই এবং জীবনেও ভুলবো না। কারণ তাদের উৎসাহ পেয়েই আমি ঐদিন রাতেই এই গল্পটি রাত বারোটা থেকে রাত ৪টা পর্যন্ত একটানা লিখে শেষ করেছিলাম। কাজেই গল্পটি তাদের নামে উৎসর্গ করলাম।)
(প্রথম পর্ব)
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
বিকেল ৪টার দিকে ঢাকার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়ে পাকা চার মাইল মেঠোপথ পায়ে হেঁটে সন্ধার আগে আগে ভরতখালী রেল স্টেশনে এসে পৌছলাম। ঢাকার ট্রেন আসতে তখনও এক ঘন্টা দেরি। স্টেশন ঘরের সামনে পেতে রাখা ব্রেঞ্চে বসে একঘণ্টা কাটিয়ে দিলাম। হঠাৎ রেলের কর্মচারী নয় ইঞ্চি পরিমান একটি লোহার দন্ড হাতে করে নিয়ে এসে, স্টেশনের বারান্দায় ঝুলানো বড় একটি লৌহ দন্ডের মাঝখানে জোরে জোরে দুটি বাড়ি দিয়ে ঢং -- ঢং -- শব্দ তুলে কান তাতিয়ে দিল। শুধু ঢং ঢং দুটি বাড়ি দিয়েই ক্ষান্ত হলো না বড় দন্ডটির নিচের দিকে দুটি ঠ্যাংগের মত আছে। যার মাঝখানে ফাঁকা। এই ফাঁকার ভিতর লৌহ দন্ডদিয়ে ঘন তালে ঠুন্ঠান ঠুন্ঠান ঠুন্ঠান ঠুনঠান শব্দ তুলে বাড়ি দিল। এরপর আবার লম্বা তালে জোরে জোরে ঢং ঢং -- শব্দে দুটি বাড়ি দিয়ে ট্রেন আসার খবর জানিয়ে দিল।
ঘন্টা পড়ার সাথে সাথে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা মানুষ জন স্টেশন ঘরের কাছে চলে এলো। আমিও তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে স্টেশন ঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে একটি টিকেট কেটে নিলাম। দশ পনেরো মিনিট পরেই দুরে গাড়ির হেড লাইটের ছোট একটি আলো দেখা গেল। আলো আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। আরেকটু পরে স্টেশনের কাছাকাছি এসে হু-- উ ঁ------- চিকন শব্দে গাড়ির হুইসেল হৃৎপিন্ড কাঁপিয়ে দিয়ে ঝকাঝক্ ঝকাঝক্ বিকট শব্দ করতে করতে দৈত্যের মত কয়লার ইঞ্জিলওয়ালা গাড়ি স্টেশনে এসে হাজির হলো। আমি স্টেশনে দাঁড়ানো ছিলাম। চটপট একটা বগিতে উঠে পড়লাম। কিন্তু উঠে কোন সীট খালি পেলাম না। অন্য যাত্রীদের সাথে দাঁড়িয়ে রইলাম। গাড়ি হুইসেল দিয়ে ছেড়ে দিল। গাড়ি ছাড়ার প্রথম ঝাকিতেই পরে যাওয়ার অবস্থা। তাল সামলে থাপা দিয়ে সামনের বাফার ধরে দাঁড়ালাম। লম্বালম্বি সীট। এপাশ ওপাশ জানলার ধারে দুটি সীট মাঝখানে একটি সীট। প্রতি সীটে ৬জন বসার কথা দেয়ালে লেখা আছে। কিন্তু একেক সীটে সাতজন আটজন করে যাত্রী বসা। বসার মত এতটুকু ফাঁক নেই। আমি দুই সীটের মাঝখান দিয়ে একটু ভিতরে গিয়ে হাতের ব্যাগটি বাফারে রাখতে ছিলাম। এমন সময় জানালার পাশের সীটে বসা সমবয়সী এক মহিলা মেজাজ গরম করে চোখ রাঙিয়ে বলে উঠল, এই যে ভাই, আমার ব্যাগের উপর ব্যাগ রাখবেন না। আমার সামনে থেকে সরে দাঁড়ান।
অনাকাংখিতভাবে মহিলার ধমকে থতমত খেয়ে সীটের অপর প্রান্তে দেয়ালের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওখানে কেউ কিছু বলল না। দাঁড়ানো অবস্থায় প্রায় এক ঘন্টা। গাড়ি পাখিমারা স্টেশন ছেড়ে দিঘলকান্দি স্টীমার ঘাটের দিকে যাচ্ছে। ঘাটের কাছাকাছি গিয়ে গাড়ির গতি কমে গেল একপর্যায়ে গাড়ির চাকায় ক্যা- ক্যু-- চিঁ-- চ্যুঁ-- গ-স্-স-- শব্ধ করে একটা ঝাকি দিয়ে গাড়ি থেমে গেল। রাত্রী হওয়ায় ভিতর থেকে বাইরের কিছুই বুঝা যাচ্ছিল না। কিছুক্ষণ পর লাল সার্ট পরিহিত কিছু কুলি হইহই রইরই করে এসে কামরায় উঠে লাগেজ মালসামানা খুঁজতে লাগল। কুলির মোট বহন করার মত ভারি কোন ব্যাগ বা মাল সামানা না থাকাতে কেউ তাদেরকে মোট বহন করতে দিল না। কুলিরা মাল না পেয়ে নেমে গেল। নামার সময় বলে গেলÑÑ সামনে মাল ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে, গাড়ি আর যাবে না। আপনাদের এখান থেকে হেঁটে যেতে হবে।
একথা শুনে একজন যাত্রী কুলিকে জিজ্ঞেস করল, ঘাট কতদুর?
কুলি জবাব দিল, প্রায় পৌনে এক মাইল।
পৌনে এক মাইলের কথা শুনে যাত্রীরা অনেকেই মাথায় হাত দিয়ে বসল। ব্যাগ নিয়ে এতো রাস্তা কেমন করে হেঁটে যাবে?
হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নাই। কারণ রেল লাইনের উপর দিয়ে বা পাশ দিয়ে অন্য কোন যানবাহন চলাচল করে না। কাজেই হেঁটেই যেতে হবে। বাধ্য হয়ে সবাই নেমে গেল। আমিও নামার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। ধমক দেয়া মহিলাটি তখনও নামে নাই। আমার সামনে দাঁড়ানো অবস্থায় কোমর হেলে জানালা দিয়ে বাইরে মাথা বের করে, এই কুলি, এই কুলি বলে চিৎকার করছে। কিন্তু কোন কুলিই তার ডাকে সারা দিচ্ছে না। মহিলাটি এমনভাবে দুই সিটের জায়গা আটকিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, মহিলাকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারছিলাম না। মহিলা আমাকে উঠার পরে যেভাবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে ধমক দিয়েছে, সেই রাগে, দুঃখে, ঘৃণায় তার সাথে কথা বলতেও মন চাচ্ছিল না। কিন্তু মহিলা পথ রোধ করে জানালার বাইরে মুখ দিয়ে যেভাবে কুলি কুলি করছে, এদিকে আমি যে তার কারণে বের হতে পারছি না, সেদিকে তার এতটুকুও খেয়াল নেই। এমতোবস্থায় অনিচ্ছা সত্বেও তাকে ডাক দিতে বাধ্য হলাম। ‘এই যে আপা, আপনি একটু সরে দাঁড়ান, আমি নামবো’। দুই তিনবার ডাকার পরও শুনছে না, তখন জোরে রাগত স্বরে কথা বলতে বাধ্য হলাম। ‘এই যে আপা, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন? একটু সরে দাঁড়ান। আমি নামবো’।
এবার মহিলা জানালা থেকে মুখ সরিয়ে এনে কোমর সোজা করে আমার মুখোমুখি দাঁড়ালো। আমি বললাম, আপনি সরে দাঁড়ান, আমি নামবো।
মাহিলা আমার দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে বলল, আপনি নামবেন?
আমি মাথা ঝাকিয়ে রাগত সুরে বললাম, হ্যাঁ, আপনি সরেন, আমি নামবো।
মহিলা কাতর কণ্ঠে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ভাই আপনি তো যাবেন আমাকে একটা কুলি যোগাড় করে দিতে পারবেন?
মহিলা যত কাতর কণ্ঠে অসহায়ভাবে বলুক না কেন আমার ভিতর তখনও মহিলার প্রতি ক্ষোভ জমা হয়ে আছে। তাই মুখ ঝামটা দিয়ে রাগ রাগ মুখে বললাম, আপনার কুলি আপনি যোগাড় করে নেন, আমি কেন কুলি যোগাড় করতে যাবো?
মহিলা নরম হয়ে বলল, আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন?
আমি বললাম, আমি কেন আপনার উপর রাগ করতে যাবো। আপনি আমার কে?
-- আমি আপনার কেউ না, তাই বলে আপনি আমাকে এই অবস্থায় ফেলে যাবেন?
-- আপনার যাওয়া আপনি যাবেন, আমার যাওয়া আমি যাবো। আপনাকে আমি ফেলে যাবো মানে? আপনাকে কি আমি সাথে করে নিয়ে এসেছি নাকি? আপনি সরেন।
-- ভাই রাগ করবেন না, দয়া করে আপনি আমায় সাথে নিয়ে যান।
-- আপনাকে আমি সাথে নিব কেন? আপনার মত আপনি যান, আমার মতো আমাকে যেতে দেন।
-- প্লিজ ভাই প্লিজ, আমাকে সাথে না নিয়ে আপনি যাবেন না। প্লিজ ভাই প্লি--জ--।
আমি মুখটা ঝামটা দিয়ে বললাম, রাখেন আপনার প্লিজ প্লিজ। সরেন আমাকে নামতে দেন।
এবার মহিলা দুই হাত জোড় করে বলল, আপনাকে আমি বিশেষভাবে অনুরোধ করছি ভাই, আমাকে সাথে নিয়ে যান।
আমি রাগত মুখে বললাম, রাখেন আপনার অনুরোধ, গাড়িতে উঠার পরে আপনি আমার সাথে কি ব্যবহার করেছেন সেটা মনে নেই?
-- সরি ভাই, সেজন্য আমি দুঃখিত! আমি আপনার কাছে হাত জোর করে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
-- রাখেন আপনার ক্ষমা টমা। এরকম মহিলাকে আমি ক্ষমাটমা করি না।
একথা বলার সাথে সাথে মহিলা নিচু হয়ে খপ করে আমার পা ধরে বসল। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পা সরানোর চেষ্টা করে বললাম, এই ্কি করেন, আপনি আমার পা ধরলেন কেন?
-- আপনার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য।
-- আমি ক্ষমা করবো না, আপনি আমার পা ছাড়েন।
-- আপনি আমায় ক্ষমা না করলে আমি পা ছাড়বো না।
-- আপনি এতো বড় মহিলা হয়ে আমার পা ধরলেন কেন? ছাড়েন পা।
-- আপনি আমার বড় ভাই, আমি আপনার ছোট বোন, আপনি ক্ষমা না করলে আমি পা ছাড়বো না।
মহিলা এমন ভাবে পা দু’টো ধরেছে, আমি ঝটকা টান মেরে পা ছুটিয়ে মাঝখানের সীট টপকে লাফ দিয়ে যে পার হয়ে যাবো, সে ক্ষমতাও নেই। পা শক্তভাবে চিপে ধরেছে। কামরায় আমি আর মহিলা ছাড়া আর কেউ নাই। আরো দু’একবার পা ছাড়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। উপায়ন্তর না দেখে বাধ্য হয়ে বললাম। ঠিক আছে মাফ করে দিলাম। আপনি আমার পা ছাড়েন।
-- খালি মাফ করলে তো হবে না ভাই, আপনি আমাকে সাথে নিবেন কিনা সেটা আগে বলেন।
মাহিলার একথা শুনে আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল। এই অপরিচিত মহিলাকে সাথে নিয়ে আমি কোথায় যাবো? তাছাড়া আমি অবিবাহিত। এই মহিলাকে সাথে দেখলে মানুষে কি বলবে? পরিচিত কারো সামনে পরলে তো আমার মান সম্মান থাকবে না। বাবার কানে গেলে তো ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিবে। মহিলার কথায় আমার গলাসহ মুখ শুকিয়ে গেল।
একটু শক্ত হয়ে বললাম, এই মহিলা, আপনাকে আমি চিনি না জানিনা, আপনাকে আমি কই নিয়ে যাবো? আমার পক্ষে আপনাকে সাথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আপনি পা ছাড়েন। অন্য কারো পা ধরেন।
-- এখানে তো আর কেউ নাই ভাই, আপনিই বলেন আমি কার পা ধরবো?
মহিলার কথা শুনে কেঁপে উঠলাম। কি অঘটন যে এই মহিলা ঘটাবে বুঝতে পারছি না। ভয়ে ভয়ে কান্না ভেজা কণ্ঠে বললাম, কেউ নাই দেখে কি আপনি আমার পা ধরবেন? আপনাকে কোন ভাবেই আমার সাথে নেওয়া সম্ভব নয়। আমি অবিবাহিত, আমার বাবা-মা দেখলে আমার পিঠের চামড়া তুলে নিবে। আপনি আমার পা ছেড়ে দেন।
-- আপনার বাবা মা আপনার পিঠের চামড়া তুলে নিবে কেন? আমি তো আপনার বাড়ি যাবো না।
-- তা হলে কোথায় যাবেন?
-- আপনার সাথে আমি ঘাট পর্যন্ত যাবো। স্টীমার পর্যন্ত যাবো।
-- তার পর?
-- তার পর আমাকে সাথে না নিলেও চলবে।
-- কার সাথে যাবেন?
-- আমার মতো আমি যাবো।
এ কথা শুনে মানের মধ্যে একটু স্বস্তি ফিরে এলো। কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বললাম, এ কথাটি আগে বলবেন না, আমি তো অন্য কিছু মনে করেছি।
-- আপনি কি মনে করেছেন?
-- আমি মনে করেছি আপনি আমার সাথে আমার বাড়িতে যেতে চাচ্ছেন।
-- আমি আপনার বাড়ি যাবো কেন?
-- সেই জন্য তো নার্ভাস ফিল করছি।
মহিলা উঠে এসে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি এতো নার্ভাস হয়েছেন কেন? মানুষ কি মানুষের উপকার করে না।
-- করে, তবে এরকম বিপদে আমি আর কখনো পড়ি নাই।
-- কিসের বিপদ? ভাই হিসাবে বোনকে সাথে নিয়ে ঘাটে পৌছে দিবেন, এতে আপনি বিপদ দেখলেন কোথায়?
-- আমি অন্য কিছু মনে করেছিলাম।
-- আমাকে অন্য কিছু মনে করছেন কেন? কেমন মানুষ আপনি? আপনি কি আমাকে বোনের মত গ্রহণ করতে পারছেন না?
-- আপনাকে আমি সহজেই গ্রহণ করতে পারছি না। কারণ আপনাকে আমি এর আগে কখনও দেখি নাই।
-- আগে দেখেন নাই এখন তো দেখতেছেন। সবাইকে যে আগে দেখতে হবে এর কোন যুক্তি আছে?
মহিলার প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে বললাম, আপনার যুক্তিটুক্তি রাখেন তো। আমার সাথে গেলে তাড়াতাড়ি চলেন। দেরি হয়ে গেলে স্টীমার পাওয়া যাবে না।
-- আমাকে সাথে নিবেন তো?
-- হ্যাঁ নিব, তবে স্টীমার পর্যন্ত। তার পরে আপনি একা যাবেন।
-- ঠিক আছে, এতটুকু উপকার করলেই আমার জন্য যথেষ্ট।
একথা বলে মহিলা বাফার থেকে ভারি ব্যাগ নামিয়ে এক হাতে নিয়ে অন্য হাতে ধরে রাখা ভ্যানিটি ব্যাগটি ঘাড়ে ঝুলিয়ে নিল।
মহিলা গাড়ির নিচে নামলে আমি তার পিছনে পিছনে নেমে এলাম। নিচে নেমে দেখি বেশিরভাগ যাত্রী চলে গেছে। অল্প দু’একজন যাত্রী আছে তারা যার যার মতো হেঁটে যাচ্ছে।
মহিলা আগে আগে আমি পিছনে পিছনে হাঁটছি। কিন্তু মহিলা ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে পারছে না। একটু গিয়েই ব্যাগ মাটিতে রাখছে।
-০ চলবে ০-
Comments (11)
চার লাইনের কবিতা অথচ কত গভীর আবেদন। অনেক কথা যেন এই চার লাইনে গেঁথে দেয়া হয়েছে। অনেক ভালো লাগলো সকাল দা।
ধন্যবাদ
ভাই
ভালো থাকুন
দারুণ !!!
শুভেচ্ছা সকাল!!
বেশ ভালো লাগল। দারুণ!
নীল দা
অনেক ধন্যবাদ দাদা।