Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

মোঃ মুতাসিম উদ্দিন

১০ বছর আগে লিখেছেন

প্রত্যয়

আজ সকাল থেকেই বীথির মন খারাপ। মন খারাপ হওয়ার মত কিছু ঘটনা গত কয়েকদিনে ঘটেছে। কিন্তু ঠিক কী কারণে মন খারাপ সেটা বীথি বের করার চেষ্টা করছে, পারছে না। আজ মার্চ মাসের ২৫ তারিখ। দুই-তিনদিন হল অস্বস্তিকর রকমের গরম পড়েছে। এই সময় এই রকম গরম হলো ঝড়ের পূর্বাভাস। গত কয়েকদিন ধরে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও কেমন যেন গুমোট হয়ে আছে। শুধু বারবার মনে হচ্ছে, সামনে খুব খারাপ সময়, ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করছে।

বীথি নবম শ্রেণীতে পড়ে। তবে দেশের এই অস্থিতিশীল অবস্থার কারণে তার স্কুল এখন বন্ধ। স্কুল বন্ধ থাকলে বীথির একদম ভালো লাগে না। বন্ধুদের সাথে দেখা হচ্ছে না কত দিন হয়ে গেলো। বাসায় বসে শুধু গল্পের বই পড়ে বিষণ্ণ সময় কাটাতে হচ্ছে। একটু যে বন্ধুদের বাসায় যাবে সে উপায়ও নেই। শহরে শুধু কারফিউ আর কারফিউ। কখন কারফিউ থাকবে আর কখন থাকবে না তার কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ সারছে, কিন্তু ঘোরাঘুরি একেবারেই বন্ধ।

বীথির আগে রাজনীতি নিয়ে তেমন কোন উৎসাহ ছিল না। এখনও যে খুব একটা উৎসাহ তৈরি হয়েছে তা না। তবে ভাইয়ার মুখে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের অত্যাচার আর শোষণের গল্প, ষড়যন্ত্রের নীলনকশার কথা শুনতে শুনতে তাদের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা জন্মেছে। বীথির ভাই ইমতিয়াজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। খুবই রাজনীতি সচেতন ছেলে। গত কয়েকদিনে ভাইয়ার অস্থিরতা দেখেই বীথির মনে খচখচানি তৈরি হয়েছে। সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে এই দুর্ভাগা বাঙালি জাতির ভাগ্যাকাশে কোন এক কালবৈশাখী ঝড় প্রচণ্ড বেগে আঘাত হানতে এগিয়ে আসছে।

ভাইয়ার কাছে এই কয়েকদিনে বীথি যেই মানুষটার গল্প সবচেয়ে বেশি শুনেছে, তিনি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। শুনতে শুনতেই শেখ সাহেবের প্রতি একটা ভালোলাগা তৈরি হয়েছে। কী সাহসী মানুষ তিনি, কী দূরদর্শী নেতা! তারপর ৭ তারিখ বীথি ভাইয়ার হাত ধরে রেসকোর্স ময়দানে গিয়েছিলো শেখ সাহেবের ভাষণ শুনতে। সেদিন এই চিরচেনা ঢাকা শহরে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তা বর্ণনা করা কঠিন। বীথি এর আগে কোনদিন এত মানুষ একসাথে দেখে নি। সমুদ্রের ঢেউয়ের মত মানুষের স্রোত। যতদূর চোখ যায় শুধু মানুষ আর মানুষ। সমব্যথী মানুষ, একতাবদ্ধ মানুষ, ক্ষুব্ধ মানুষ।

বীথিদের দোতলা বাড়িটি ঢাকার প্রায় উত্তর প্রান্তে, রাজারবাগ পুলিশলাইনের পাশে মালিবাগে। মালিবাগ থেকে সেদিন বীথি আর তার ভাই লক্ষ মানুষের ভিড় ঠেলে হাঁটতে হাঁটতে রেসকোর্স ময়দানে গিয়েছিলো। তারপর যখন বীথি শেখ সাহেবের তেজদীপ্ত ভাষণ শুনলো তখন তার শরীরের সব লোম দাঁড়িয়ে গেলো, চোখে পানি চলে আসলো। সে মনে মনে একটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে ফেললো। তার কয়েকদিন পরে এক দুপুরে ভাইয়া কোথায় থেকে যেন একটা পতাকা হাতে নিয়ে অস্থিরভাবে ছুটতে ছুটতে বাসায় আসলো। ভাইয়া বাবা-মা সবাইকে ডেকে পতাকাটি দেখালো। গাঢ় সবুজের মাঝে টকটকে লাল একটা বৃত্ত। যেন সবুজের পটভূমিতে অস্তগামী জ্বলন্ত সূর্য। আর সেই লাল বৃত্তের মাঝখানে সোনার বাংলাদেশের সোনালী মানচিত্র। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা এটা। পতাকাটি দেখে বীথির চোখ ভিজে উঠেছিল। বীথি নিজের হাতে বাসার ছাদে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা টাঙিয়ে দিয়েছিলো।

এসব ভাবতে ভাবতে বীথি বিছানায় পাশ ফিরলো। রাত অনেক হয়ে গেছে, তাও আজ কিছুতেই ঘুম আসছে না। বাবা-মা অনেক আগেই শুয়ে পড়েছেন। তাদের ঘরের বাতি নেভানো। বাবা ইদানীং খুব মনমরা হয়ে গেছেন। খুব একটা কথা বলেন না। সারাদিন কী যেন ভাবেন। ভাইয়া মনে হয় পড়াশোনা করছে। তার ঘরে বাতি জ্বলছে। ভাইয়ার রাত জেগে পড়াশোনা করার অভ্যাস আছে।

হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে বীথি সচকিত হয়ে উঠলো। তারপর একটু বিরতি দিয়ে আবারও কয়েকটা একইরকম শব্দ। বীথি ছুটে বাবা-মায়ের ঘরে চলে গেলো। বাবা-মা দুজনই বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসে আছেন।  বাবার মুখ দেখে তাকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। মা হতভম্ব হয়ে বসে আছেন। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। এর মধ্যে ভাইয়া ‘যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে’, বলতে বলতে ছুটে এলো। ততক্ষণে সারা শহর জুড়ে ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা শুরু হয়ে গেছে।

‘ছাদে এখনও পতাকা লাগানো আছে, ওটা খুলতে হবে’, ভাইয়া খুব ব্যস্ত হয়ে বললো। ভাইয়ার কথা শেষ হবার আগেই বীথি ছাদের সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো। ‘কই যাস?’, মা আর্তনাদ করে উঠলেন। বীথি আর পিছনে ফিরে তাকালো না। এখন তার পিছনে ফিরে তাকানোর সময় নেই। যেভাবেই হোক পতাকাটা ছাদ থেকে খুলে আনতেই হবে। কাল সকালে হায়েনারা বাসার ছাদে বাংলাদেশের পতাকা দেখলে বাড়িসুদ্ধ সব মানুষকে খুন করবে। বীথি মরিয়া হয়ে ছাদের দিকে ছুটে যাচ্ছে আর তখন সারা ঢাকা বিস্ফোরণের শব্দে বার বার কেঁপে উঠছে।

ছাদে উঠে বীথি স্তম্ভিত হয়ে গেলো। যতদূর চোখ যায় শুধু আগুনের লেলিহান শিখার প্রলংকরী তাণ্ডব নৃত্য। ২৫ মার্চ রাতের শান্ত, ঘুমন্ত ঢাকা শহর হঠাৎ করে যেন একটা জ্বলন্ত উনুন হয়ে গেছে। সবচেয়ে প্রথমে বীথির চোখ আটকে গেলো রাজারবাগ পুলিশলাইনের কোয়ার্টারগুলোর দিকে। আহ! কী বীভৎস দৃশ্য! এক পলক দেখলেই বোঝা যায় শত শত মূর্তিমান মৃত্যু আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। বীথি আর সহ্য করতে পারলো না। কাঁপা কাঁপা হাতে পতাকা খুলে বুকের মধ্যে আগলে ধরে এক দৌড়ে নিচে চলে আসলো।

মায়ের কাছে এসে বীথি থেমে গেলো। দুই হাতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা আঁকড়ে ধরে আশ্চর্য শীতল অথচ দৃঢ় আত্মবিশ্বাসী গলায় বললো, ‘মা, তোমাকে আমি কথা দিচ্ছি এই পতাকা আমি আবার উড়াবো। স্বাধীন বাংলাদেশের নীল আকাশে উড়াবো।’ বলেই মাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে লাগলো।

২৫ মার্চ, ১৯৭১ সালের রাতের ঢাকায় আগুন আর ধ্বংসের, রক্ত আর মৃত্যুর পৈশাচিক খেলায় মত্ত পাকিস্তানী বর্বরগুলো তখনো জানে না; ঠিক সেই মুহূর্তে বাংলার শত-সহস্র ঘরের কোণে, সংগোপনে এমন এক অপরাজেয় শক্তির উত্থান ঘটেছে যাকে অবদমিত করার ক্ষমতা কারও নেই।



Likes Comments
০ Share