Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

মোঃ মুতাসিম উদ্দিন

৯ বছর আগে লিখেছেন

একই সমতলে

একটি বিশাল, বিস্তৃত শুভ্র প্রান্তরে আমি দীর্ঘক্ষণ ধরে শুয়ে আছি। এখানে মাটির রঙ সাদা, আকাশের রঙও সাদা। সারা শরীরে কেমন যেন একটা শীতল অনুভূতি হচ্ছে। এটা কোথায়, আমি এখানে কেন শুয়ে আছি, কতক্ষণ ধরে শুয়ে আছি; সে সবের কিছুই আমার জানা নেই। হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম, কেন একটা শীতল অনুভূতি আমার সমস্ত সত্তাকে ক্রমেই গ্রাস করছে। আমি আসলে বরফের চাঁইয়ের উপরে শুয়ে আছি, আদিগন্ত বিস্তৃত জমাট বাঁধা শুভ্র বরফ। কিন্তু এখানে আকাশের রঙ সাদা কেন? আমি আর ভাবতে পারছি না। আমার সমস্ত চেতনা, শরীর যেন ক্রমেই অবশ হয়ে আসছে। সারা শরীরে এক অসহ্য ব্যথা, হাত-পা নিথর হয়ে আছে। এক বীভৎস দৃশ্য দেখতে দেখতে ধীরে ধীরে অচেতন হয়ে গেলাম। শেষ মুহূর্তে দেখতে পেলাম, সাদা বরফের উপর দিয়ে অসংখ্য কালো কালো তেলাপোকা আমার দিকে ছুটে আসছে। কিলবিল করতে করতে পোকাগুলো সদর্পে আমার শরীরের উপর উঠে পড়ছে। আর আমার শরীরের নিচের বরফের উপর ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত পড়ছে। টকটকে লাল রক্ত সাদা বরফের উপর পড়ার সাথে সাথেই ছড়িয়ে যাচ্ছে। এক অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে আমি অচেতন হয়ে গেলাম, হয়তো বা মারা গেলাম।

‘আহ’, শব্দ করে শিউলি ঘুম থেকে জেগে উঠলো। আজকাল বাসায় তেলাপোকাদের উৎপাত খুব বেড়ে গেছে। আর তেলাপোকা সবচেয়ে বেশি ঘোরাঘুরি করে এই রান্নাঘরে। কখন যে একটা গায়ের উপরে উঠে পড়েছিলো, শিউলি ঘুমের মধ্যে টেরই পায় নি। হাত দিয়ে গলার কাছে থেকে নোংরা পোকাটাকে শিউলি ঠেলে সরিয়ে দিলো। লাইট জ্বালাবার জন্যে শিউলি উঠে বসবার চেষ্টা করতেই অনুভব করলো তার সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। আর তখনই আজকের সারাদিনের কথা মনে পড়ে গেল। মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে উঠলো।

আজ বিকেলে খালার অফিসের অনেক লোকজন বাসায় বেড়াতে এসেছিলো। তারা চলে যাবার পর তাদের নাশতার কাপ, পিরিচ, বাটি ধোয়ার সময় শিউলি হঠাৎ করেই একটা কাপ ভেঙে ফেলে। তার কখনো এমন হয় না। আজ হঠাৎ করে কেন জানি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলো। কাপ ভাঙ্গার শব্দে খালা সাথে সাথেই রান্নাঘরে ছুটে আসলেন। তারপর ভাঙা কাপের দিকে তাকিয়ে তার চোখ ধ্বক করে জ্বলে উঠলো। তিনি শিউলিকে মারার জন্যে যে লাঠিটি সব সময় ব্যবহার করেন তা বের করে আনলেন। এরপর শিউলিকে অমানুষিকভাবে পেটাতে শুরু করলেন। শিউলি তার মুখে হাত দিয়ে মুখ বাঁচানোর বৃথা চেষ্টা করলো। তা দেখে খালা যেন আরও ক্ষেপে উঠলেন। তার সমস্ত ক্রোধ শিউলির মুখের উপর আছড়ে পড়লো। তিনি শিউলির মুখে এলোপাথাড়ি লাঠির আঘাত করতে লাগলেন। শিউলির ঠোঁট কেটে রক্ত পড়া শুরু হল। ফোঁটায় ফোঁটায় পড়তে লাগলো রক্ত, জবাফুলের রেণুর মত টকটকে লাল। ওহ, ওই দৃশ্য শিউলি আর ভাবতে পারে না।

শিউলি কবে থেকে এ বাসায় কাজ করে তা সে মনে করতে পারে না। তার বাবা-মায়ের কথাও কিছু মনে নেই। সে বড় আপুর মুখে শুনেছে, খুব ছোটবেলায় এক মহিলা নাকি তাকে এ বাসায় রেখে যায়। তারপর থেকে সে এখানেই বড় হয়েছে। এই বিশাল পৃথিবীতে তার আর যাবার কোন যায়গা নেই। এই বাড়িতে একমাত্র বড় আপুই শিউলিকে কিছুটা ভালোবাসে। বড় আপু বাসায় থাকলে খালা শিউলিকে কিছু বলার সাহস পায় না। আজ যখন শিউলি মার খেয়েছে তখন বড় আপু বাসায় ছিল না, ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরেন নি। তবে ছোট আপুর স্বভাব বড় আপুর ঠিক উল্টো। সে সারাদিন শিউলির ভুল খুঁজতে থাকে। কিছু একটা ভুল ধরতে পারলেই, মায়ের কাছে গিয়ে নালিশ দেয়। আর খালু একেবারে গোবেচারা মানুষ। তিনি খালাকে রীতিমত ভয় পান। তাই কোন কিছুর সাতে-পাঁচে থাকেন না।

শিউলি লাইট জ্বালিয়ে এসে রান্নাঘরের মেঝেতে বসে থেকে এসব কথা ভাবছিলো। আর সামনে তাকিয়ে তেলাপোকাদের গতিবিধি লক্ষ্য করছিলো। আজকে তেলাপোকা মারার ঔষুধ ফিনিশ পাউডার দেয়া হয়েছে। সেই ছড়িয়ে থাকা পাউডারের সাদা পটভূমিতে কয়েকটা নোংরা কালো কীট উল্টো হয়ে পড়ে আছে আর বিস্রস্তভাবে পা নাড়ছে। শিউলি হঠাৎ করে পোকাগুলোর জন্যে কিছুটা দয়া অনুভব করলো। কী অসহায়, মূল্যহীন ওদের জীবন! ওদেরকে মেরে শেষ করে দেয়ার জন্যে কত আয়োজন। শিউলির মনে পড়লো সেও কয়েকবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু শেষ মুহূর্তে গিয়ে আর পারে নি। হয়তো বড় আপুর মুখটা মনে পড়ে যাওয়ায়। কিংবা হয়তো এতটা সাহস শিউলির নেই। আত্মহত্যা করতে অনেক সাহসের প্রয়োজন হয়। হঠাৎ ‘খুট’ করে শব্দ হওয়াতে শিউলি সম্বিত ফিরে পেল। এটা খালার ঘরের দরজা খোলার শব্দ। শিউলি তাড়াতাড়ি লাইট বন্ধ করে এসে শুয়ে পড়লো। কিন্তু ততক্ষণে সর্বনাশ যা হবার তা হয়ে গেছে। ‘হারামীর বাচ্চা, রাতদুপুরে লাইট জ্বালিয়ে বসে আছিস। কত বড় সাহস? কারেন্টের বিলের টাকা কই থেকে আসে শুনি?’, চিৎকার করতে করতে খালা রান্নাঘরের দিকে আসছেন।

শিউলি প্রচণ্ড ভয়ে শুয়ে থেকে কুঁকড়ে গেল। শারীরিক অবসাদ আর মানসিক আতঙ্ক দ্রুতই শিউলির চেতনাকে গ্রাস করে নিলো। সে হাত-পা ছুঁড়ে ছটফট করতে করতে চেতনা হারাতে লাগলো। অচেতন হয়ে যাবার আগে অস্পষ্ট ফড়ফড়ানির শব্দ শিউলির কানে এলো। শিউলির পাশেই রান্নাঘরের মেঝেতে তখনো কুৎসিত, কালো, অর্ধমৃত কীটগুলো অসহায়ভাবে আস্ফালন করছে।

Likes Comments
০ Share

Comments (3)

  • - লুৎফুর রহমান পাশা

    ঠিক ধরেছেন। ফ্রন্ট পেজে কবিতার বন্যা।

    - রোদেলা

    দারুনemoticons