Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

মিশু মিলন

৯ বছর আগে লিখেছেন

জীবন এমনই! (প্রতিযোগিতা-১৫)

আমি অহংকারী। অহংকারের সোনালী বীজটা আমার ভেতরে রোপিত হয়েছিল শৈশবেই। গায়ের রঙ ফর্সা আর দেখতে খুব সুন্দর ছিলাম বলে শৈশব থেকে যে-ই আমাকে দেখতো, সে-ই আমার গাল টিপে আদর করে বলতো, ‘মেয়েটা কী সুন্দর ফুটফুটে’ ‘মেয়েটা কী কিউট’ ইত্যাদি! আমি কোনকিছুতে সাফল্য পেলেও আমার সৌন্ধর্যের প্রশংসার আড়ালে ঢাকা পড়ে যেতো সাফল্যের প্রশংসা। তাই কোনকিছুতে সাফল্য অর্জন করার চেয়ে আমি সেজেগুজে থাকাটাই শ্রেয় মনে করতাম। বালিকা বয়সে যখন আমার বুকের আকার পরিবর্তন হতে শুরু করলো এবং এক নতুন ধরণের চঞ্চলতা চলকে উঠলো আমার মধ্যে, তখন আমি নিজেও যেন মানুষের কথার যথার্থতা খুঁজতে শুরু করলাম আরো গভীরভাবে। খুঁজে দেখলাম স্কুলে আমি-ই সবচেয়ে সুন্দরী। আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ির নানা অনুষ্ঠান আর পার্টিতেও তাই। রাস্তায় বের হলেও আমি আমার বয়সী মেয়েদের দেখলে তাকিয়ে থাকতাম, নিজের চেহারার সঙ্গে তাদের চেহারার তুলনা করতাম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমার-ই জয় হতো। কখনও সুন্দর কোন মেয়েকে দেখলে আমার ভীষণ মন খারাপ হতো, ঈর্ষা হতো। মনে হতো আমি বুঝি হেরে গেলাম! ক্লাসের পরীক্ষায়, স্কুলের খেলাধুলায়, সমস্ত জায়গায় হেরে গেলেও আমার কিছু আসতো যেতো না। কিন্তু শারীরিক সৌন্ধর্যের তুলনায় আমাকে ছাড়িয়ে যাওয়া দূরে থাক, আমার সমতুল্য কাউকে দেখলেই ঈর্ষায় আমার গা জ্বলে যেতো। অন্যরা তার প্রশংসা করলে ঘরের দরজা বন্ধ করে আমি কাঁদতাম। মনে হতো যেন আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি!      শৈশবে রোপিত অহংকারের সোনালী বীজটা বাল্যকালে অঙ্কুরিত হয়ে কৈশোরে মেলতে শুরু করলো ডালপালা। আমার মধ্যে জন্ম নিল এক দূর্বিনীত সত্ত্বা। সব সময় আমি অন্যদের চেয়ে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতাম। আশপাশের সবাইকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতাম। প্রভুত্বসুলভ আচরণ আমাকে গ্রাস করে ফেললো। বাহুল্য টাকা-পয়সা খরচ করে বন্ধুদেরকে আমার অনুগত করে রাখতাম। বাবা-মায়ের কাছেও যখন যা চেয়েছি, পেয়েছি। আমার চাওয়া বা আমার মতের বিরুদ্ধে না শব্দটি শুনলেই মাথায় দপ করে আগুন জ্বলে উঠতো। বাবা-মায়ের ধারণা ছিল, এই বয়সে ছেলে-মেয়েরা একটু জেদিই হয়। বড় হলে শুধরে যাবে। কিন্তু আমি শোধরাইনি।          আমি শহরের উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। যদিও আমার পূর্ব পুরুষের শিকড় প্রোথিত বাংলার গ্রাম্য প্রকৃতির কাদা-জলে। আমার দাদার বাবা ছিলেন পুরোদস্তুর কৃষক। দাদা ছোটখাটো সরকারী চাকরি করলেও গ্রামে থাকার সুবাদে কৃষিকাজ ধরে রেখেছিলেন। সকালে জমিতে লাঙল ঠেলে অফিসে যেতেন, ফিরে এসে যেতেন কোদাল নিয়ে। কিশোর বয়স অবধি আমার বাবাও লেখাপড়ার পাশাপাশি কৃষিকাজে যোগাল দিয়েছে। এরপর থেকে আর বাবার সাথে কৃষিকাজের তেমন সম্পর্ক নেই। বাবা এখন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর পদস্থ কর্মকর্তা। আমি তার একমাত্র মেয়ে। ভাই আমার ছোট।          আমার মায়ের জন্ম অবশ্য ঢাকাতেই। বাবার পরিবার আর মায়ের পরিবারের ব্যবধান অনেক। মা শহুরে ধনী পরিবারের মেয়ে। মায়ের আত্মীয়-স্বজন সব ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর মানচিত্র জুড়ে। যারা ঢাকায় থাকে তারাও সামান্য পেট ব্যথা হলেই সিঙ্গাপুর ছোটে। গ্রামের সঙ্গে এদের কোন সম্পর্কই নেই। আর আমার বাবার পরিবার ঠিক উল্টো। ইন্ডিয়ার বাইরে কেউ কোথাও গিয়েছে বলে শুনিনি। বাবা-মায়ের লাভ ম্যারেজ। দুই মেরুতে অবস্থানের কারণেই বোধহয় দুই পরিবারের সুরটা মেলেনি। একটা র‌্যাপ সং, আরেকটা রাগ বাগেশ্রী!      আমি নিজেও গ্রামে খুব কম গিয়েছি। ছোটবেলায় একবার গ্রামে গিয়ে অন্ধকার দেখে ভয় পেয়ে খুব নাকি কেঁদেছিলাম আমি। আমার মা’ও গ্রামে যেতে চাইতো না। গ্রামের আত্মীয়-স্বজনও আমাদের বাড়িতে তেমন আসতো না। আগে যখন একটু একটু আসতো, তখন আমার মামা বাড়ির লোকজন বলতো, ‘তোদের নেংটিগেস্ট আবার কবে আসবে? দে আর ভেরি ইন্টারেস্টিং! লাইক মানকি!’    সেই অর্থে গ্রামের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তেমন ছিল না। একটু বড় হলে বাবাকে একবার গ্রামে যেতে দেখেছি কোন এক আত্মীয় মারা গেলে। আমরা যাইনি। আমি নিজেও গ্রাম সম্পর্কে, আমার শিকড় সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে কিছুই জানতাম না। শুধু জানতাম গ্রামে আমার একটা দাদাবাড়ি আছে।    আমার শিকড় গ্রামে প্রোথিত হলেও অন্তরে-বাহিরে আমি পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ধারক-বাহক। বাঙালী সংস্কৃতি আমাকে কখনও টানেনি। আমি সংস্কৃতির অর্থই বুঝতাম না। আমার কাছে জীবন মানে ছিল হৈ-চৈ, বিনোদন। আর বিনোদন মানেই পাশ্চাত্য। হলিউডের সিনেমা, ইংরেজি গান ছাড়া কি বিনোদন হয়! যদিবা কখনও আমার মন সমুদ্রের এপাড়ে বিনোদন খুঁজেছে তো সে ঐ বলিউডে।    আমার কাছে বাংলা গানের অর্থ প্যানপেনে গলায় মেয়েলি কান্না। বাংলা সিনেমা, বাংলা সংস্কৃতি এসব হলো ছোটলোক আর অশিতি মুর্খদের বিষয়। শিতি, রুচিবান, আধুনিক মানুষ সেই-যে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি বোঝে, লালন করে। পাশ্চাত্যের ফ্যাশন সচেতন।    আমি দু’তিনবার করে সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক ঘুরেছি। কানাডায় মামার কাছে গিয়েছি একবার। সত্যি বলতে কি আমার এই দেশে থাকতেও ভাল লাগে না। বাবা-মাকে কত করে বোঝালাম আমি কানাডায় গিয়ে লেখাপড়া করি। এই দেশে থেকে কী হবে, যেখানে জীবনের কোন নিশ্চয়তা নেই! বাবা-মা আমার সব জেদ মেনে নিলেও এটা মেনে নিলেন না। আমাকে ছেড়ে নাকি তারা থাকতে পারবেন না। যত্তসব বাঙালি অকেজো সেন্টিমেন্ট! অগত্যা আমাকে এখানেই একটা নামী বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হলো।  এতোদিন আমি আমার মনের মতো একজন পুরুষ খুঁজেছি। সত্যিকারের পৌরুষ আছে যার মধ্যে। কিন্তু পাইনি। চারিদিকে তাকালে কেবল দেখি ম্যাদামারা ছেলে। টিপিক্যাল ভেতো বাঙালি, ভোঁতাও। লুতুপুতু শরীর। জিম না করলে পুরুষ মানুষ আবার পুরুষ হয় নাকি! হাত-পা হয় মেয়েদের মতো তুলতুলে। স্বভাবও তাই। সেই সেকেলে চুলের স্টাইল, কথা বলার ঢং। ফ্যাশন বোঝে না। কেমন বুনো টাইপের। আধুনিকতার লেশমাত্র নেই।    বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই আমি আমার পছন্দের পুরুষের দেখা পেলাম। আয়ান। আমি যেমনটা স্বপ্ন দেখেছি, আয়ান তেমনই। উচ্চতা পাঁচ ফুট দশ। জিম করা পেশিবহুল সুঠাম শরীর। ফর্সা আর ভীষণ ফ্যাশন সচেতন। হেয়ার কাট্, দাড়ির স্টাইল ঘনঘন বদলায়। রঙও বদলায়। কখনো কালো কখনো বাদামী। আমার অবশ্য বাদামী চুলই পচন্দ। চেহারায় মাঝে মাঝেই বৈচিত্র্য আনাটা আমার খুব ভাল লাগে। একঘেয়ে লাগে না।    আয়ান বি,বি,এ থার্ড ইয়ারে আর আমি ফাস্ট ইয়ার। আমি রোজ ভার্সিটিতে আয়ানকে দেখি, আমার ঘোর লেগে যায়। আমার কেবলই মনে হয় ও শুধু আমার। কিছুদিনের মধ্যেই এক বন্ধুর মাধ্যমে আমাদের সম্পর্ক হয়ে যায়। ও এতো রোমান্টিক যে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই ওর সংস্পর্শে এসে।    ওর অবশ্য আগে একটা মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। মেয়েটা ব্যাকডেটেড। ওকে বুঝতে পারতো না। ব্রেক আপ হয়ে গেছে। ঐ মেয়েটার কথা আয়ানই বলেছে আমাকে। ভাগ্যিস বালাই চুকেছে, নইলে আয়ানকে কি আমি পেতাম!    আমার যে কারো সাথে কোন সম্পর্ক হয়নি এটা শুনে আয়ান অবাক! বলে, ‘এখনকার মেয়েদের মধ্যে তো এটা ভাবাই যায় না!’ আমি অবশ্য ফেসবুকে কয়েক ডজন অফার পেয়েছি। একটাও পছন্দ হয়নি আমার। সবাই ইনিয়ে বিনিয়ে ভালবাসার কথা বলে। পুতু পুতু করে। ফ্যাশন বোঝে না। স্মার্টনেস নেই। ব্যতিক্রম কেবল একটা ছেলে। ছেলেটার নাম সবুজ। প্রোফাইলে কোন ছবি নেই। অদ্ভুত অদ্ভুত সব ম্যাসেজ পাঠায়।    ‘আজ নীল জামা পড়েছো। যেই না তোমাকে দেখেছি, অমনি আমার মনটাও নীল আকাশে উড়তে শুরু করলো......’ ‘আমি তোমাকে রোজই দেখি। ইচ্ছে করে তোমার কাছে যাই। তোমার সাথে কথা বলি। কিন্তু আমার সাহসে কুলোয় না। আমি বোধ হয়  সারা জীবন তোমাকে এভাবে দূর থেকে দেখেই যাব। কাছে আসা হবে না....’ ‘তোমার সাথে বড্ড কথা বলতে ইচ্ছে করছে.....।’ ‘আচ্ছা, আমি যদি কখনও তোমার কাছে আসি তুমি কি আমায় বকবে? অবশ্য তোমাকে দেখলে তেমন রাগী মনে হয় না। একটু অহংকারী মনে হয়। কিন্তু তোমার মাকে দেখলে ভীষণ অহংকারী আর রাগী মনে হয়।’  ‘বাইরে এসে দ্যাখো, আজ আকাশে কোজাগরি পূর্ণিমার কী সুন্দর চাঁদ! বড্ড শূন্যতা অনুভব করছি....’ ‘তুমি আজ গোলাপী শাড়ি পরে কোথায় গিয়েছিলে? এই প্রথম তোমাকে শাড়ি পরতে দেখলাম। তোমাকে দেখার পর আজ সারাদিন আমার কিচ্ছু হয়নি। একটা আশঙ্কার কাঠঠোকরা নিরন্তর মনের ভেতরে কেবলই ঠুকরেছে। মনে হয়েছে আজ তুমি কোন পুরুষের সাথে ঘুরতে বেরুচ্ছো না তো........’ ‘একদিন আমি তোমার মুখোমুখি হবোই। হয়তো অচিরেই.........’                     এমন আরো অনেক মেসেজ পাঠায় আমাকে। আমি পাত্তা দিইনা। কথা বার্তা কেমন আঁতেল আঁতেল। হবে হয়তো কোন ম্যাদামারা ভম্বল! আমার মজাই লাগে! মেসেজগুলো পড়ে আমি আর আয়ান হাসাহাসি করি। এক শীতের সন্ধ্যায় আয়ান আর ওর পরিবারের সবাই এসে আমাকে আংটি পরিয়ে যায়। আমাদের সম্পর্কটা দুই পরিবারই মেনে নিয়েছে। আয়ানের পরিবার ভাল। আমার বাড়ি থেকে কোন আপত্তি করেনি। একই কারণে আয়ানের পরিবারও কোন প্রশ্ন তোলেনি।       আয়ানের বি, বি, এ শেষ। এম, বি, এ পড়তে লন্ডন যাবে। এম, বি, এ শেষ করে ও দেশে ফিরলে আমাদের বিয়ে। ততদিনে আমারও গ্রাজুয়েশন শেষ হয়ে যাবে। দুই পরিবারের মধ্যে এমনটাই পাকা কথা হয়।  আয়ান লন্ডন চলে গেল। আমি এয়ারপোর্টে গেলাম ওকে বিদায় জানাতে। মনে হলো আমার হৃদয়ের একটা অংশ ছিঁড়ে চলে যাচ্ছে। খুব ভেঙে পড়েছিলাম। বাসায় এসে ভীষণ কেঁদেছিলাম।    ও লন্ডন পৌঁছেই আমাকে ফোন দিল। আমি ওর গলা শুনে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। ও আমাকে সান্ত্বনা দিল যাতে আমি ভেঙে না পড়ি। ফোনেই আমাকে ভীষণ আদর করলো!     এরপর থেকে আমরা নিয়মিত স্কাইপে একে অন্যকে দেখেছি, কথা বলেছি। তখন মনে হতো ও আমার কাছেই আছে। আমি রোজ গভীর রাতের অপেক্ষায় করতাম। কারণ, ও তখন ফ্রি হতো। আমাদের হাজার হাজার মাইলের দূরত্ব ঘুচে যেতো। আবেগ, অনুভূতি, ভালবাসার আদান-প্রদান হতো। কল্পনায় কখনও আমি ওর পাশে পাশে হাঁটছি টেমসের পাড়ে। আবার কখনও ও এসে হাজির হচ্ছে এই শহরে। হ্যাঁ, হাজার হাজার মাইলের দূরত্বে দুটো কম্পিউটারের সামনে সম্পূর্ণ নগ্ন শরীরে আমরা দূরাগত মিলনের আনন্দও উপভোগ করেছি রাতের পর রাত। ওর অদৃশ্য হাত-ঠোঁট কোমল পরশ বুলিয়েছে আমার শরীরের গোপন গহীন ভাঁজে। আমার রক্তের কণায় কণায় তুলেছে আগুনের ঝড়! সেই ঝড়ে মহাশূন্যে উৎক্ষিপ্ত হয়ে ভেসেছি আমি হাজারো নক্ষত্র ছোঁয়ার সীমাহীন আনন্দে!    আয়ান লন্ডনে যাবার মাস দুয়েক পর আমি একদিন মাথা ঘুরে পড়ে যাই। জ্ঞান ফিরলে দেখি আমি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। আমার কাছে বসে আছে মা আর নানী। আমি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করি, ‘আমার কী হয়েছে?’ ‘তুই সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলি। টেস্টের রিপোর্ট এখনও আসেনি।’ মা আমাকে জানায়।   আমার মনে পড়ে, বিকেলে ভার্সিটি থেকে ফিরে ফ্রেস হয়ে ডাইনিংয়ের দিকে যাচ্ছিলাম। প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছিল। হঠা-ই আমার মাথার মধ্যে কেমন যেন লাগে। আমার পৃথিবীটা যেন দুলে ওঠে। আমি কিছু একটা ধরবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পারিনি...। তারপর আমার আর কিছুই মনে নেই।   আমি আবার চোখ বুঝলাম। এখন আমার খুব ভয় করছে। বাবা-মাকে আমি কী জবাব দেব? আয়ানের বাড়ির মানুষই বা কী ভাববে আমাকে! কারণ আমি অনেকটাই নিশ্চিত আমার এই অসুস্থতার ব্যাপারে। আমার মনে হচ্ছে এই সময় আয়ানকে আমার পাশে দরকার। আমি যদি এখনই ছুটে বাসায় গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে ওর সাথে কথা বলতে পারতাম!  আয়ান ইংল্যান্ডে যাবার সপ্তাহ দুয়েক আগে ভার্সিটি থেকে আমরা বন্ধুবান্ধবরা মিলে ঘুরতে গিয়েছিলাম কুয়াকাটা। আয়ান শুনে বায়না ধরলো সেও যাবে। দুটো রাত আমরা একসঙ্গে কাটিয়েছি। দুটা রাত আমরা বাকি পৃথিবী ভুলে ছিলাম। আমাদের মাঝে কেউ ছিল না। কোন ভয় কিংবা শঙ্কাও না। যদিও আমি তেমন আভাস পাইনি, তবু আমার মনে হচ্ছে আমাদের ঐ দুটো রাতের সঙ্গে সম্পর্কিত আমার এই অসুস্থতা!  চোখ খুলে তাকাতে ইচ্ছে করছে না আমার। আমার চোখ এখন অন্ধকার খুঁজছে। আমি কী জবাব দেব!    আমাকে হাসপাতাল থেকে বাসায় আনা হলো। কিন্তু কী আশ্চর্য কেউ কিছু বলছে না কেন আমাকে! রিপোর্ট পেয়ে যাবার কথা। এতণ তো আমার ওপর একচোট ঝড় বইয়ে দেবার কথা আমার মায়ের! অথচ মা আমাকে বেশ সেবাযত্ন করছে। আমাকে রেস্ট নিতে বলছে। যদিও মুখটা কেমন গম্ভীর। আমার কাছে কেমন গোলমেলে লাগে ব্যাপারটা।    ক’দিনের মধ্যে আমার, মা’র আর বাবার পাসপোর্টে সিঙ্গাপুরের ভিসা লাগানো হলো। আমরা নাকি বেড়াতে যাব। আমি যা বোঝার বুঝে গেলাম। আমি নিশ্চিত আয়ানের পরিবার খারাপ ভাববে তাই সিঙ্গাপুর নিয়ে আমার কলঙ্কমোচন করা হবে।    সিঙ্গাপুর যাবার পর আবার আমার চেক-আপ করানো হলো। বাবা-মাকে প্রশ্ন করেও আমি জানতে পারিনি, কেন আমাকে চেক-আপ করানো হলো। চিকিৎসা শুরু হবার আগের দিন আমি জানতে পারলাম, আমার ব্লাড ক্যান্সার! আমি যেন মহাশূন্য থেকে নিক্ষিপ্ত হলাম পৃথিবীর রুক্ষ মালভূমিতে!    আমার কেমোথেরাপি শুরু হলো। বাবা-মা এবং ডাক্তাররা আমাকে বোঝালো, ভয়ের কিছু নেই। ক্যান্সার প্রাইমারি স্টেজে। সেরে ওটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমাকে আর মাকে সিঙ্গাপুরে একটা ভাড়া ফ্যাটে রেখে বাবা দেশে ফিরলো। আর ক’দিন পরই দেশ থেকে এলো নানী।   আমি ভয় পাচ্ছি না। ক্যান্সারকে আদর করতে ইচ্ছে করছে। যত্নে লালন করতে ইচ্ছে করছে রক্ত কণিকায়। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে আয়ানের মেসেজ পেয়ে।    ‘স্যরি বেবি, আমার পরিবার চাইছে না আমি তোমার সাথে রিলেশন কন্টিনিউ করি। সো আমি তোমার সাথে আর কম্যুনিকেশন করতে পারছি না। আমাকে ভুলে যাও। আশাকরি সুস্থ হয়ে সুন্দর জীবনে ফিরতে পারবে তুমি। জীবন এমনই। বাই।’     আমি আয়ানকে সব জানিয়েছিলাম। স্কাইপে দেখলাম আয়ানের গম্ভীর মুখ। ভীষণ মন খারাপ আমার জন্য। তারপর আমাকে সান্ত্বনা দিল। ব্যাস ঐ পর্যন্তই। এরপর দশ দিন পেরিয়ে গেলেও আয়ান আর আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। হঠাৎ একদিন স্কাইপে ওই মেসেজ পেলাম। মনে হলো আমার সভ্যতা, আমার আধুনিকতা আমাকে সপাটে একটা থাপ্পড় মারলো। আমি পাগলের মতো হয়ে গেলাম। শরীরে ক্যান্সারের যন্ত্রণা সহ্য করা যায়, কিন্তু মনের ক্যান্সারের যাতনা সইবো কেমন করে!    আমার চিকিৎসা চলছে, জীবনটা চলছে দড়ির ওপর দিয়ে। যেকোন সময় পড়ে যেতে পারি অতলান্ত গভীর খাদে। পড়ে গেলে আর কেউ কোনদিন খুঁজে পাবে না আমাকে। কে আমি? কোথায় যাব? এইসব প্রশ্ন আমাকে ভাবাচ্ছে ভীষণ!     দিনরাত্রি আমায় বাসায়ই কাটে। ভুলেও ফেসবুক কিংবা স্কাইপে ঢুকি না। যেন পৃথিবীর সাথে আমার সমস্ত যোগাযোগ, সকল সম্পর্ক চুকে-বুকে গেছে। বাকি আছে কেবল শ্বাস-প্রশ্বাসের যোগাযোগটুকু। বিছানায় শুয়ে থাকি, মাঝে মাঝে বারান্দায় গিয়ে বসি। রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলা সাদা চামড়া-বাদামীচুলো মানুষ দেখি। একদিন আমিও চামড়া সাদা আর চুল লাল করার কি নির্বোধ চেষ্টা করেছি! এখন আমার ন্যাড়া মাথা। এখন আমার মনে হয় সব জৌলুস মিথ্যে, অর্থহীন। আমি আয়নার সামনেই যাই না। একবার সাহস করে আয়নায় দেখেছি নিজেকে। মুখটা এতোটুকু হয়ে গেছে। দেখতে কেমন শিশুর মতো লাগে! অচেনা লাগে ভীষণ!    মাস তিনেক পর দেশে ফিরলাম। বাবা গিয়ে আমাদের নিয়ে এলো। এখন বাংলাদেশেই থাকবো। কেমো নিতে শুধু সিঙ্গাপুর যাবো। আমাদের গলির রাস্তাটা মেরামতের জন্য কাটা হয়েছে। গলির মাথায় নেমে মা, বাবা, আর নানীর সাথে হেঁটে আসছি বাসার দিকে। বাসায় ঢোকার সময় দেখি একটা ছেলে কেমন বোকার মতো তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ন্যাড়া মাথায় ওড়না দিলেও সামনের দিকটা দেখা যাচ্ছে। ছেলেটির চোখ আমার মাথার দিকেই। ছেলেটিকে অনেকবার দেখেছি আমি। এ গলিতেই কোথাও বাসা। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। গেটে ঢোকার মুহূর্তে আবার তাকিয়ে দেখলাম, ছেলেটি অদ্ভত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েই আছে।    দেশে এসে শুরু হলো আরেক যন্ত্রণা! আত্মীয়-স্বজনরা দলে দলে আমাকে দেখতে আসে। ভিড় লেগেই থাকে। বড় বিরক্ত লাগে। একটু একা হতে পারি না। কেউ কেউ এমন হা হুতাস করে, যেন আমি মরে গেলে পৃথিবীর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে! লোক দেখানো এইসব ন্যাকামো অসহ্য লাগে আমার!    একদিন স্কাইপে ঢুকলাম। ভেতরে কৌতুহল, যদি আয়ানের কোন মেসেজ থাকে। আমি তো ওকে কিছুতেই ভুলতে পারি না! না, স্কাইপে আয়ানের কোন মেসেজ নেই। ফেসবুকেও নেই। তবে ফেসবুকে অনেকগুলো মেসেজ জমা হয়ে আছে। সবগুলোই সবুজ নামের ঐ ছেলেটির। নেই কাজ তো খই ভাঁজ! আমি সবগুলো মেসেজ পড়তে থাকি। ও আমাকে অনেকদিন দেখে না। আমি কোথায় আছি কেমন আছি। আরো অনেক মেসেজ। আমি শেষ মেজেটায় চোখ বুলাই- ‘আজ আমার হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে। কিছু বলার মতো ভাষা নেই। ভেবেছিলাম তোমার হয়তো বিয়ে হয়ে গেছে। কোনদিন হয়তো দেখবো স্বামীর হাত ধরে গলি দিয়ে হেঁটে আসছো। কিন্তু এভাবে তোমাকে দেখতে.......। আজ আমার পরিচয় তোমাকে দিতেই হবে। তুমি বাসায় ঢোকার সময়, যে ছেলেটি ছলছল চোখে তোমার দিকে তাকিয়ে ছিল, আমিই সে। তোমাকে দেখার পর থেকে কিচ্ছু ভাল লাগছে না। তোমাকে দেখার জন্য ভেতরটা ছটফট করছে। বন্ধু হিসেবে অন্তত একবার তোমার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ চাই....’   রোজ ফেসবুক খুললেই আমি সবুজের মেসেজ পাই। সব মেসেজেই দেখা করার আবদার। আমি কী করবো বুঝে উঠতে পারি না। আমার শরীর, হৃদয়, সমস্ত সত্ত্বাজুড়ে যে ছিল, সে আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে আমার অসুখের জন্য। আর আরেকজন আমার অসুখের কথা জেনেও বন্ধু হিসেবে দেখা করার অনুরোধ করছে। ছেলেটি এতো করে যখন অনুরোধ করছে, তাই ভাবলাম একবার দেখা করি। ওকে বাসায় আসতে বললাম।  সবুজ এলো। একটা গোটা বিকেল আমরা গল্প করে কাটালাম। যাবার সময় দেখি ওর চোখ ছলছল করছে। তারপর আরেকদিন এলো....তারপর আবার....।    মা-বাবা অফিসে থাকে। সারাদিন আমি বাসায় থাকি। দুজন কাজের লোক থাকে আমাকে দেখার জন্য। সবুজ এলে ভাল লাগে। একঘেয়েমি কেটে যায়। চ্যাটিংও হয় আমাদের মধ্যে। আমাদের মধ্যে ভাল বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেছে। ও ভীষণ মজা করে। জোকস আর মজার মজার গল্প বলে। আমাকে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করে।     এর মাঝে আরো কয়েকবার আমি সিঙ্গাপুর গিয়েছি। ক্রমশ আমার শারীরিক উন্নতি ঘটছে। আর দেশে ফিরে আমি সুবজের চোখে নতুন করে বাংলাদেশ চিনছি। বাংলাদেশকে জানছি। আমি এতোদিন যেভাবে বাংলাদেশকে দেখেছি, যেভাবে বাংলাদেশের মানুষকে জেনেছি, তার ভেতরে মারাত্মক ভুল ছিল। সেই ভুল আমি শোধরানোর পাঠ নিচ্ছি সবুজের কাছে। বাসায় সারাণ বসে ভাল লাগে না। সবুজকে নিয়ে বাইরে বের হই। এই শহরের সাংস্কৃতিক পরিবেশের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয় ও। আমরা মঞ্চে নাটক দেখি, চিত্রশালায় যাই, গানের জলসায় যাই। এতোবছর এই শহরে থেকেও এসবের সংস্পর্শ আমি কোনদিন পাইনি। এর রস আস্বাদন করতে শিখিনি। শিকরে ফেরার আনন্দে, শিকড়ের রস আস্বাদনে আমি উৎফুল্ল হয়ে উঠি। যে ক’টা দিনে বাঁচি আমি এসবের ভেতর দিয়েই বাঁচতে চাই। অনেক সময় শরীর না চাইলেও মনের জোরেই যাই। আমি সবুজের মতো করে বাংলাদেশকে আরো চিনতে চাই।    একদিন বাবা-মাকে বললাম, ‘আমি গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যাব।’ বাবা-মা যেন আকাশ থেকে পড়লো। কারণ আমি কোনদিন গ্রামে যেতে চাইনি। গ্রামের আত্মীয়দের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কও ভাল নয়। বাবা-মা আপত্তি করতেই আমি বললাম, ‘আমি যদি মরে যাই, তাহলে গ্রামে যেতে না পারার আফসোস থেকে যাবে আমার। আর এর জন্য দায়ী হবে তোমরা।’ বাবা নিশ্চুপ হয়ে গেল। মাও আর কোন কথা বললো না। আমি বললাম, ‘সবুজে নিয়ে যাব আমার সঙ্গে।’    মা’র আপত্তি থাকলেও বাবা চুপ রইলো। আসলে মা সবুজের সাথে আমার মেলামেশা ভাল চোখে দেখছে না। আবার কিছু বলতেও পারছে না। কারণ আয়ানের সাথে সম্পর্ক চুকে যাবার পর সবুজের বন্ধুত্বই আমাকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখছে। আমার দেহ মনের উত্তরণ ঘটছে। মা’র ধারণা সবুজের সাথে মিশে আমি নীচু তলায় নেমে গেছি।     বাবা আমাকে আর সবুজকে নিয়ে গ্রামে গেল। পরদিনই ফিরে এলো বাবা। বহুদিন পর এলেও গ্রামের আত্মীয়রা আমাদেরকে আপনভাবে কাছে টেনে নিল। যেন এতোদিন কোন দূরত্বই ছিল না! আমার ক্যান্সারের কথা শুনে দাদী একটু কাঁদলো। দাদা, চাচা-চাচীদেরও মন খারাপ হলো। কিন্তু এই মন খারাপের মধ্যে কোন ন্যাকামি নেই, যা ছিল আমার শহুরে আত্মীয়দের মধ্যে। আমার একটা ছোট্ট চাচাতো ভাই আমাকে দেখে হাততালি দিয়ে বলে উঠলো, ‘আপু টাক্কু বেল...আপু বড় মানুষ টাক্কু বেল..আমিও টাক্কু বেল...আপুও টাক্কুবেল...কী মজা!’   আমার চাচা ওকে ধমকালো। আমি চাচাকে বাধা দিলাম। ও বাচ্চা মানুষ, ও কি বড়দের মতো করে বোঝে! ওর বলার ঢং দেখে আমিও হেসে ফেললাম। আবার চোখ দিয়ে টপ টপ করে জলও পড়লো। কী যে আনন্দে কাটতে লাগলো গ্রামের প্রতিটি মুহূর্ত। আমি আর সবুজ গ্রামের মাঠ-ঘাট, নদীর পাড় ঘুরি। বড়শি দিয়ে মাছ মারি। আমাদের সাথে থাকে চাচাতো, পাড়াতো ভাই-বোনের একদল বিচ্ছু। মাঝে মাঝে আমি আর সবুজ নিজেদের মতো আলাপ করার জন্য ওদেরকে বলি, ‘দেখি ঐ বটগাছটা কে আগে ছুঁয়ে আসতে পারে!’    ওরা এক কিলোমিটার দূরের বটগাছ ছোঁয়ার জন্য ছুট লাগায়। আমি আর সবুজ দিগন্ত জোড়া শর্ষেক্ষেতের আলপথ দিয়ে হাঁটি। মৌমাছি গুণগুণ করে হলুদ শর্ষেফুলে। আমি আহাদিত হয়ে পড়ি। সবুজ হাসে আমার ছেলেমানুষি দেখে। ও তো গ্রামের ছেলে, ওর কাছে এসব নতুন নয়। কিন্তু আমি তো এই প্রথম মৌমাছি দেখলাম!  উচ্ছ্বাসের ভেতরেই আমি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি। আমার মনে হয় এই দেশের, এই পৃথিবীর এখনও কতো কি দেখার বাকি আছে আমার। অথচ আমার জীবন অনিশ্চয়তায় দুলছে। আমার চোখ থেকে জল ঝরতে দেখে সবুজ বলে, ‘কী হলো?’ আমি সবুজের চোখে চোখ রেখে বলি, ‘এই পৃথিবীটাকে আমার আরো দেখতে ইচ্ছে করে সবুজ। আমি আরো থাকতে চাই, আরো দেখতে চাই পৃথিবীটাকে। আমি থাকলে পৃথিবীর কি এমন তি হবে!’   ‘তুমি থাকবে। তোমাকে থাকতেই হবে। তুমি আরো অনেকদিন এই পৃথিবীকে দেখবে। পৃথিবীকে তুমি নতুন চোখে দেখছো, পৃথিবী তোমাকে এতো তাড়াতাড়ি ছাড়বে না। সামনে পড়ে আছে তোমার সোনালী দিন। আমার কি মনে হয় জানো?’ আমি উত্তরের অপেক্ষায় ওর মুখের দিকে তাকাই। ‘তুমি সুস্থ হলে আয়ান ওর ভুল বুঝতে পেরে তোমার কাছে ফিরে আসবে।’  আস্তে আস্তে চোখের পাতা ভাঙছে সূর্য। শেষ আলোটুকু লেগে আছে রাশি রাশি শর্ষেফুলের পাপড়িতে। বটগাছ ছুঁয়ে বিচ্ছুর দল ফিরতে শুরু করেছে। এখনও অনেক দূরে। আমাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে দুটো পাখি নীড়ে ফিরে গেল। মৌমাছির গুনগুন শব্দও পাচ্ছি না। বুঝিবা ওরাও ফিরেছে চাকে। আমি সবুজের চোখের দিকে তাকাই। আমি মৌমাছি হয়ে উড়ে গিয়ে বসি ওর চঞ্চুচাকে!    অবশেষে চিকিৎসাবিদ্যার তাড়া খেয়ে ক্যান্সার আমাকে ছেড়ে পালালো। আমি সত্যিকার অর্থেই এক নতুন জীবন পেলাম। এক অর্থে ক্যান্সার আমাকে বাঁচিয়েও দিয়ে গেল! নইলে আয়ানের মতো একটা কীটের সঙ্গে আমাকে ঘর করতে হতো। আমি ভাবি, যদি আমার ক্যান্সার ওর সঙ্গে বিয়ের পর ধরা পড়তো, তখন কী হতো! ও হয়তো আমাকে ডিভোর্স দিতো। সেই অর্থে ক্যান্সারের কাছে আমি কৃতজ্ঞই।    আসছে শীতে আমি আর সবুজ বিয়ে করতে যাচ্ছি। ঐ যে আমি আবেগপ্রবণ হয়ে শর্ষেক্ষেতে আল্ এ দাঁড়িয়ে সবুজকে চুমু খেয়েছিলাম। তখন তো সবুজ আমার আর আয়ানের ব্যাপারে অনেক কথাই জানতো না। পরে আমি ওকে সব বলেছি। এমনকি আমার আর আয়ানের যে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে তাও। সব শুনে সবুজ বলেছে, ‘আমি তোমাকে ভালবাসি, তোমার ভুলগুলোকে নয়!’    এরপর আর একটাই বলার থাকে আমার, তারাশংকরবাবুর কবি’র নিতাইয়ের মতো বলতে ইচ্ছে করে, ‘জীবন এতো ছোট কেনে!’   সবুজ সুনামগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে গেল ওর বাবা-মাকে আনতে। ওঁরা আমাকে আংটি পরিয়ে বিয়ের দিন ঠিক করে যাবেন। আবার সেই আংটি পরানো। আয়ানের পরানো আংটিটা আমি একদিন সবুজকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে ওর বাবা-ময়ের মুখের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এসেছি।    সবুজ আমাকে সঙ্গে নিয়ে আমার জন্য আংটি কিনেছে। আংটিটা রেখেও গেছে আমার কাছে। ভোরেই ওর আসার কথা। আমি যেতে চেয়েছিলাম কমলাপুর। ও নিষেধ করলো যেতে। গাড়ি অবশ্য পাঠিয়ে দিয়েছি। রাতে ভালো মতো ঘুমুতে পারিনি আমি। অদ্ভুত এক উত্তেজনা কাজ করেছে আমার মধ্যে। একটু পর পর সবুজকে ফোন করেছি। ঘুমিয়েছি গভীর রাতের পরে। ঘুম ভেঙেও গেছে খুব সকালে। ঘুম থেকে উঠেই সবুজকে অনর্গল ফোন দিচ্ছি। ফোন বন্ধ! একের পর এক ফোন দিচ্ছি, কোন লাভ হচ্ছে না। ওর এই এক উদাসীনতা। প্রায়ই ফোনে চার্জ থাকে না। আমি উঠে ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে বাবার পাশে বসলাম। বাবা ওদের খবর জিজ্ঞেস করলো। আর তখনই টিভিতে সংবাদ পাঠকের কন্ঠ,‘সুনামগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী টেনে আগুন দিয়েছে দূর্বৃত্তরা......’ টিভির পর্দায় দাউ দাউ করে জ্বলছে ট্রেনের দুটি বগি....!’       জানুয়ারি, ২০১৫।                                                                                              
Likes Comments
০ Share