Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

মিশু মিলন

৯ বছর আগে লিখেছেন

গর্ভকানড়

আমি যখন দুঃসংবাদটা শুনলাম, আমার পায়ের নিচে তখন ভূ-কম্পন! বারোয়ারি মেলার ছেঁড়া-ফোঁড়া তাঁবুর মতো দুলছে আকাশটা! সবে ধানমন্ডির ছোট বোনের বাসা থেকে স্টাফ কোয়ার্টারে ফিরেছি। বাসায় ঢোকার আগে কিছু দরকারী জিনিস কেনার জন্য মাঠের ভেতর দিয়ে কোয়ার্টারের দোকানের দিকে যাচ্ছি। তখনই ফোন।  ‘হ্যালো...ফোন আমার ব্যাগে ছিল বুঝতে পরিনি। কী হয়েছে বল।’  শুনে আমি স্তব্ধ! আমি দাঁড়িয়ে  পড়লাম। আমার পায়ের নিচে বর্ষায় গজানো মায়ার মতো নতুন সবুজ ঘাস, আর মাথার ভেতরে উপকূলের ধূসর সুনামি! ‘আমি আসছি...’ বলার পর ওপাশ থেকে ফোনের লাইনটা কেটে দিল। আমি দাঁড়িয়েই রইলাম। সামনে থেকে আসা শীতল বাতাসে যেন আগুনের আঁচ আর ভাঙা সর্ষে দানার মতো বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন আগুনের ফুলকি! সহ্য হচ্ছে না! অথচ অন্য সময় হলে বাতাস আর বৃষ্টির ফোঁটায় নিজেকে সঁপে দিতাম। অবোধ বালিকার মতো উপর দিকে হা করে দু-চার ফোঁটা পুড়ে নিতাম মুখেও।  আমি দাঁড়িয়েই আছি মাঠের মধ্যে। আমার ডান হাতের মুঠোয় মোবাইল। বাম হাতটা নিজের অজান্তেই শাড়ির ফোঁকর দিয়ে স্পর্শ করলো আমার পেট। আত্মস্পর্শে আমি কেঁপে উঠলাম যেন। নিমীলীত চোখে ওপরের দিকে তাকালাম। আগুনের ফুলকিগুলো এখন আস্ত সর্ষে দানার রূপ নিয়েছে। শীতের বিকেল। বসে আছি গ্রামের বাড়ির বারান্দায়। আমি একাই। আচমকা তলটেটে ঢুঁস খেয়ে আমি আঁৎকে উঠলাম! ঢুঁসের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে এক অদ্ভত ভালোলাগায় বুঁদ হয়ে রইলাম গোটা বিকেল। সেদিনের পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই ঢুঁস খেয়েছি। বুঝলাম, এ বড় দুষ্টু! আমার হাড় জ্বালাবে!  এরপর থেকে তার সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। কতো রকমের গল্প করতাম, গান শোনাতাম, ছড়া শোনাতাম, রূপকথার গল্প শোনাতাম! আর মাঝে মাঝেই সে ভেতর থেকে হাত-পা ছুঁড়ে, মাথা দিয়ে মৃদু ঢুঁস দিয়ে আমার কথায় সায় দিতো। পরপর দু’বার ঢুঁস দিলে বুঝতাম, সে বুঝতে পারেনি। গল্পের ঐ জায়গাটা আবার সুন্দরভাবে সহজ ভাষায় বুঝিয়ে বলতাম। সে তখন মাড়ি কেলিয়ে হাসতো। আমি ওর হাসি টের পেতাম! অনাগত সন্তানকে নিয়ে আমার সে কী পাগলামি!  বাইশ বছর। অথচ এখনও অনুভূতিগুলো কতো জীবন্ত!  সোহাগ। আমার একমাত্র পুত্র। আমার কলিজার টুকরো। যার সুখের জন্য আমি নিজের স্বর্গের জায়গাটুকুও ছেড়ে দিতে রাজি, যার মঙ্গলের জন্য আমি নিজের সবটুকু অর্জন বিলিয়ে দিতে রাজি, যার জন্য আমি আমার নিজের ক্যারিয়ারটা একরকম বিসর্জন দিয়েছি। আমি ক্যারিয়ারের কথা বলছি বলে ভাববেন না আমি খুব শিক্ষিত একজন মা। উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষে থাকতেই আমার বিয়ে হয় একজন সরকারী কর্মকর্তার সঙ্গে। বিয়ের পরও আমি লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকি। একদিকে সংসার আরেকদিকে লেখাপড়া। সংসারের চাপ সামলাতে লেখাপড়ার অনেকটাই তি হয়। কিন্তু এই তি মেনে নেওয়া ছাড়া তখনকার মধ্যবিত্ত সমাজের একটা বিবাহিত মেয়ের কি-ই বা করার ছিল! সংসার সামলে ঐভাবেই আমি উচ্চ মাধ্যমিক পরীা দিই। ততদিনে আমি জেনে গেছির আমার সন্তানের আগমন বার্তা।  আমার স্বামী মোটা টাকা ঘুষ দিয়ে ঢাকায় এলো। স্টাফ কোয়ার্টার পেল। ওদিকে গ্রামে আমার কোল জুড়ে এলো ফুঁটফুঁটে পুত্র সন্তান। আমার সোহাগ। কয়েকমাস পরই আমার স্বামী আমাকে ঢাকায় নিয়ে এলো। ততদিনে আমার রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে, ভর্তি পরীার ফরম পূরণের সময়ও এসে পড়েছে। আমি দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেছি।  স্বামীকে অনার্সে ভর্তির কথা বলতেই সে বললো, ‘ভর্তি না হয় হলে, কিন্তু বাবুকে রেখে তুমি কাস করবে কিভাবে?’ আমি বললাম, ‘আগে ভর্তি তো হই। তারপর না হয় দেখা যাবে।’ আমার চোখে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল ক্যাম্পাস, কাসরুম, করিডর। বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি চান্স নাও পাই অন্ততপক্ষে ইডেনে, হোম ইকোনোমিক্সে ভর্তির আশায় দিনগুনি আমি।  কিন্তু উত্তর পেলাম, ‘দেখা যাবে বললেই তো হয় না। যা করার আগে থেকে ভেবে চিন্তে করতে হয়।’  আমি বুঝলাম আমার অনার্স পড়ার ব্যাপারে তার অনাগ্রহ। তবু বললাম, ‘তা বলে আমি আর পড়বো না?’ ‘তুমি পড়বে না, আমি তো সেকথা বলিনি। বাবু একটু বড় হোক। তারপর অনার্সে না হোক ডিগ্রিতে কোন কলেজে ভর্তি হোয়ো।’ অনার্স দূরে থাক আমার আর কোনদিন ডিগ্রিতেও ভর্তি হওয়া হয়নি। দু’বছর পরই আবার আমার পেটে এলো শুভ্রা। ততদিনে আমার স্বপ্নরা ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার স্বপ্ন তখন আমার সন্তানদের ঘিরে। আমার জীবনের যত স্বপ্ন, যত আশা-আকাক্সা সব সঁপে দিয়েছি আমার দুই সন্তানের জীবনে।  আমি মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়েই আছি। আকাশের গর্জনে আমার সম্বিত ফিরলো। শরীর তখন কাঁপছে। আমার কেবলই মনে হতে লাগলো, মাথার ওপরের আকাশ, ছন্দে আসা বাতাস, চতুর্দিকের গাছপালা, বৃষ্টিদানা, সমস্ত প্রকৃতি আমার জরায়ুর প্রতি ঘৃনা প্রদর্শন করছে! আমার নারী জনমের প্রতি ধিক্কার জানিয়ে তারা বিদ্রুপের হাসি হাসছে! আমার ভীষণ লজ্জা করছে। উহ্! আমি যদি কালা হয়ে যেতে পারতাম, অন্ধ হয়ে যেতে পারতাম!  আজ সকালে যখন পত্রিকায় খবরটা পড়লাম, তখন মনে মনে বলেছিলাম, কোন মায়ের সন্তান এরা! কিন্তু এখন? আমার সকালে ছোঁড়া থুথু যে বিকেলে আমার-ই গায়ে পড়বে, তা কী দুঃস্বপ্নেও কখনও ভেবেছি আমি!  আমি বাসায় ফিরলাম। শুভ্রা দরজা খুলে দিল। ওর চোখে মুখে উৎকন্ঠা। ও-ই আমাকে ফোন করে জানিয়েছে সব। সাত নম্বর বিল্ডিংয়ের নাজমা ভাবী এসেছিল আমার কাছে। খুব কান্নাকাটি করেছে। নাজমা ভাবী সোহাগের বন্ধু জাহিদের মা। জাহিদকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। আমাদের বাসায়ও পুলিশ এসেছিল। ফিরে গেছে। সোহাগ সকাল থেকেই বাসায় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার কথা বলে সকালে বেরিয়েছে। এখন প্রায় সন্ধ্যে। আমি দরজা লাগিয়ে সোফায় এসে বসলাম। পিছন পিছন শুভ্রাও এসে বসলো আমার পাশে।   ‘মা, ভাইয়াকে একটা ফোন করবে?’ উৎকন্ঠিত শুভ্রা বললো। আমি শুভ্রার দিকে তাকালাম। ওর উৎকন্ঠা আমাকে ভাবালো। এই উৎকন্ঠা ওর ভাইয়ার জন্য নিশ্চিত। ওর ভাইয়া এখন কোথায় আছে, পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায় কিনা, ধরা পড়লে কী ধরণের শাস্তি হবে, ভাইয়ার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে কিনা, এসব ভেবে উৎকন্ঠিত ছোটবোন। আমি শতভাগ নিশ্চিত ও একবারও ভাবছে না, যে মেয়েটার সর্বনাশ হয়েছে, সে এখন কোথায় আছে, কেমন আছে, তার মানসিক অবস্থা কী, মেয়েটা এবং তার পরিবার কী যন্ত্রণাময় সময় অতিবাহিত করছে। মানুষ কী এমনই! নিজে আর নিজের পরিবারের নিরাপত্তার কথাই আগে চিন্তা করে। ভুলে যায় ন্যায়-অন্যায়ের প্রভেদ। কিন্তু কী আশ্চর্য! আমি এমন ভয়ানক শান্ত কেন? শুরুর উত্তেজনা কোথায় উবে গেছে। আমি এখন পাথর। অথচ আমার একমাত্র ছেলের ভবিষ্যৎ নিক্তিতে ঝুলছে!  ‘কী দেখছো অমন করে? ভাইয়াকে একটা ফোন দাও। আমি ফোন দিয়েছি, ধরছে না।’ শুভ্রা আমাকে তাড়া দিল। ছেলেকে ফোন করতে আমার রুচিতে বাঁধলো। আমি ওকে ফোন করে কী বলবো? বলার মতো কোন কথা খুঁজে পেলাম না। এ যেন শব্দরাশির নীবর প্রতিবাদ! আমি আমার স্বামীকে ফোন করে সব জানালাম। শুভ্রার মতো সে-ও উৎকন্ঠিত হয়ে বললো, ‘সোহাগ কোথায়?’ ‘জানিনা।’ ‘তুমি ওকে ফোন করেছিলে?’ ‘না।’ ‘আশ্চর্য মা তুমি! ঠিক আছে আমি দেখছি। আর সোহাগ বাসায় এলে ওকে বাসায় রেখো না। বাইরে কোথাও থাকতে বোলো। আমি আসছি।’ ‘কী করবে ভাবছো?’ ‘ফোনে এতো কথা বলা যাবে না। রাখছি।’ ফোনের লাইন কেটে গেল। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। শুভ্রার কাছে পানি চাইলাম। ও পানি দিল, পানিতে বিষের স্বাদ!   আমি কী করবো? আমার কী করা উচিৎ? মগজের অলি-গলিতে ভাবনার উৎপাত। রাত পোহালেই খবরটা জানাজানি হয়ে যাবে। আত্মীয়-স্বজনরা ফোন করবে। সহমর্মিতার আড়ালে মুখ টিপে হাসবে। কোয়ার্টারের মানুষ এমনিতেই মুখিয়ে থাকে মুখরোচক গল্পের জন্য। কার ছেলে কার মেয়ের সাথে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে, কার স্বামী কার সাথে শোয়াশুয়ি করছে, কার ঘরের সামনে কার পায়ের জুতো দেখেছে, কার মেয়ে অ্যাবরশন করিয়েছে, কার ছেলে ক’টা মেয়ের মন ভেঙেছে, এসব গল্পের দারুণ কাটতি কোয়ার্টারে। কোন বাসায় এ ধরণের ঘটনা ঘটলে সামনে দেখা হলে দুঃখী দুঃখী ভাব দেখায়, দরদী গলায় দুটো উপদেশ দেয়। তারপর তখনই আরেক বাসায় গিয়ে কুটিল জাবড় কাটে। সেই শুরু থেকে দেখে আসছি, এটাই কোয়ার্টারের রীতি। এজন্য কোয়ার্টারে কারো কাছে দুঃখের কথা পাড়তে নেই। এখানে দুঃখগুলো সংগোপনে নিজের কাছেই যত্ন করে রাখতে হয়।  জাহিদকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, আমাদের বাসায়ও পুলিশ এসেছিল, কে জানে, হয়তো এরই মধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে। যখন কোয়ার্টারের সবাই খবরটা জানবে, আমি মুখ দেখাবো কেমন করে! বাইরে বের হলে লোকজন অন্য কারণে হাসলেও আমার মনে হবে, সবাই আমাকে দেখেই হাসছে। এই মানসিক যন্ত্রণা আমি সইবো কেমন করে! একবার ভাবলাম আমি আত্মহত্যা করবো। এ মুখ আর আমি কাউকে দেখাবো না। তারপর ভাবলাম, না, আত্মহত্যা করবো না। এটা কোন সমাধান নয়। লোকলজ্জার ভয়ে আমি স্বার্থপরের মতো আত্মহত্যা করতে পারি না। গর্ভে পাপ ধরেছি আমি। এ পাপের কিছুটা প্রায়শ্চিত্য আমাকেই করতে হবে।  সারারাত্রিতে গভীর মিলন হয়নি দু’চোখের পাতার। গভীর রাতে অকারণে ধোয়া বাসন বারবার মেজেছি আর ধুয়েছি নির্ভার থাকতে। দীর্ঘণ গোসল করেছি। পানির সাথে সঙ্গমে মেতেছি!  সকালে একটা প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নাদিয়াকে আমি দেখতে এলাম। নাদিয়া মেয়েটির ছদ্মনাম। পত্রিকার নিউজে এই ছদ্মনাম ব্যবহার করেছে। কেবিনে ঢুকে দেখি ওর মাথার কাছে ভাতের থালা হাতে বসে আছেন একজন মহিলা। ওকে খাওয়াতে চাইছেন। কিন্তু খেতে চাইছে না ও। বালিশে ঠেস দিয়ে পাথুরে মুখে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে। কেবিনে তৃতীয় একজনের অস্তিত্ব টের পেয়ে একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার মুখ ফিরিয়ে নিল। দৃষ্টিতে প্রচ্ছন্ন ঔদাসীন্যতা। নাদিয়া যথার্থ সুন্দরী। গায়ের রঙ টকটকে ফর্সা। কিন্তু ওর সকল সৌন্ধর্য যেন এই দু’দিনেই হরণ হয়ে গেছে। দু’চোখের নিচে যেন ধূ ধূ চরে পড়ে থাকা দুটো নৌকা।  ভাতের থালা হাতে মহিলার জিজ্ঞাসু চোখের কৌতুহল নিবারণ করতে নিজের পরিচয় দিলাম একজন মানবাধিকারকর্মী বলে। জানতে পারলাম তিনি নাদিয়ার মা।  আমি বেডে বসে নাদিয়ার হাতে হাত রাখলাম। ও মুখ ঘুরিয়েই রইলো কয়েক মুহূর্ত। তারপর হঠাৎ-ই যেন আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ফুঁসে উঠলো, ‘কেন এসেছেন আপনি? আপনি পারবেন আমার সম্মান ফিরিয়ে দিতে? আপনারা শুধু মুখেই বড় বড় কথা বলেন। সভা-সেমিনার করেন আর মিডিয়ায় কাভারেজ পেতে হ্যাংলাপানা করেন। কারো সর্বনাশ হওয়ার পর যান করুণা দেখাতে।’ বলতে বলতে হাঁটুর কাছে মুখ গুঁজে কান্নায় ভেঙে পড়লো নাদিয়া। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে, ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। ওর বুকের হাহাকার জাগানিয়া বাতাস আছড়ে পড়লো আমার বুকেও। আমার বুকের মধ্যে ও অবিরত কেঁদেই চলেছে। কাঁদুক, যতখুশি কাঁদুক, কেঁদে হালকা হোক।  আমি ওর মাকে বললাম, ‘আমি ওর সাথে একটু একা কথা বলতে চাই। ওর মা টেবিলে ভাতের থালা রেখে বাইরে চলে গেলেন।  আমার বুক থেকে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসলো নাদিয়া। আমি ওর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে, হাত ধুয়ে টেবিল থেকে ভাতের থালাটা নিয়ে ভাত মেখে ওর মুখের সামনে তুলে ধরলাম এক লোকমা। কয়েক মুহূর্ত আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর ভাত মুখে নিল ও। আমি অপরিচিত, কিন্তু ও আমার হাতে খেতে দ্বিধা করলো না। অনেকদিন পর আমি নিজের হাতে কাউকে খাইয়ে দিচ্ছি। সোহাগ-শুভ্রা আট-নয় বছর বয়সেই আমার হাতে খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। তখন খাইয়ে দিতে গেলে ওরা বলতো, ‘আমরা এখন বড় হয়েছিনা’!  সত্যিই ওরা বড় হয়ে গেল। একটু একটু করে ওদের নিজস্ব একটা জগত তৈরি হয়ে গেল। সে জগতের দেয়ালের প্রাচীর এমন উঁচু আমার আর উঁকি দিয়ে দেখবারও উপায় রইলো না। কেমন দূরের মানুষ হয়ে গেল ওরা। শুভ্রাকে যদিওবা একটু চেনা যায়, সোহাগ একবারেই ঝাপসা। অথচ আমি কতো চেষ্টা করেছি ছেলে-মেয়ের সাথে বন্ধুর মতো মিশতে।  এজন্য দায়ী ওদের বাবা আর কোয়ার্টারের বর্তমান পরিবেশ। ছোট থেকে ওরা দেখেছে ওদের বাবা পরিবারের স্বৈরশাসক। যে কোন কিছুতে তার কথাই শেষ কথা, হোক সেটা ভুল কিংবা সঠিক। কোন ভুলের জন্য অনুতাপ নেই, নেই কোন স্যরি ফিলিংস্। জীবনভর শুধু টাকার নেশা। ব্যাগভর্তি কাড়ি কাড়ি টাকা এনে আলু-পটলের মতো রেখেছে খাটের নিচে। তারপর আস্তে আস্তে ব্যাংকে গছিয়েছে। সোহাগ-শুভ্রা এসব দেখে দেখেই বড় হয়েছে। ছোট থেকেই ওরা জেনেছে ওদের বাবা অসৎ উপার্জন করে। ওদের টাকার কোন অভাব নেই। তাই ওরা বাহুল্য খরচ শিখেছে আর ওদের ভেতরে তৈরি হয়েছে বেপরোয়া মানসিকতা। দুর্বিনীত আচরণ, কাউকে কেয়ার করে না। ওদের বাবাকে ওরা শ্রদ্ধা করে না, ভয় পায়। আর আমাকে ভয় পাওয়ার বালাইটুকুও নেই।  কোয়ার্টারের পরিবেশটাও সুস্থ মানসিকতা বিকাশের পরিপন্থী। মাদকের অবাধ বিচরণ এখানে। পানির পাম্পের পিছনের বাতাস কখনও বিশুদ্ধ হয় না। ছেলেদের শরীরের পৌরুষের গন্ধ প্রলীন হয়ে গেছে মাদকের গন্ধে! সোহাগও ভিড়েছে সেই দলে। কিছুতেই আমি আটকাতে পারিনি। মাঝে মাঝে বাপ ছেলের ওপর চড়াও হয়। তাতে সুফল মেলে না। সংসারের শান্তিকপোত উড়ে যায়। আমি কতো বলেছি, ‘চলো, আমরা কোয়ার্টার ছেড়ে ফ্যাটে উঠে যাই।’ ধানমন্ডিতে ফ্ল্যাট কেনা আছে। ভাড়া দেওয়া। কে শোনে কার কথা! আমার স্বামী কোয়ার্টারের ক্লাবের সহ-সভাপতি। ক্লাবের আগামী নির্বাচনে সভাপতি হবে নিশ্চিত। তার জনসংযোগ মতা অত্যন্ত  প্রখর। শুধু মাথায় হাত বুলিয়েই মানুষকে দাস বানিয়ে রাখতে পারে!  অর্থ আর ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ করে রাখে। আমার স্বামী এমনই অন্ধ যে নিজের ছেলের ভবিষ্যতটাও দেখতে পায় না। ছেলের শরীরে প্রায়ই উৎকট গন্ধ পাই। সে গন্ধে আমার মাতৃহৃদয় জ্বলে যায়।  অনেকদিন পর আমার থিতিয়ে আসা মাতৃত্ববোধটা যেন আবার চাগাড় দিয়ে উঠেছে। আমি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছি। আমার চোখে জোয়ার আসছে। বহু কষ্টে আমি বাঁধ দিয়ে রেখেছি। খাওয়ানো শেষ হলে আমি হাত ধুয়ে এসে আবার ওর পাশে বসলাম। ওর ডান হাতটি আমার মুঠোর মধ্যে নিয়ে বললাম, ‘আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই। কিন্তু আমাকে কথা দিতে হবে তুমি উত্তেজিত হতে পারবে না।’ ও আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো কয়েক মুহূর্ত। তারপর মাথা নেড়ে বললো, ‘ঠিক আছ, বলুন।’ আমি ওর মুখের দিকে মুখের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলতে পারলাম না। আমার হাতের মুঠোয় ধরা ওর কোমল হাতখানির দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘যে তিন পাষন্ড তোমার সর্বনাশ করেছে। তাদের একজনের মা আমি।’  ও নীরব। আমিও কয়েক মুহূর্ত পর ওর দিকে তাকালাম, ওর মুখের অভিব্যক্তি দেখার জন্য। ওর চোখে-মুখে বিষ্ময়! ও আমাকে কথা দিয়েছে তাই উত্তেজিত হলো না। কিন্তু আমার হাতের মুঠো থেকে ওর হাতটা সরিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, ‘কেন এসেছেন আপনি?’  ওর কন্ঠে উত্তেজনা নেই, আছে সংযত ঘৃণার মিশ্রণ। দৃষ্টিতেও ঘৃণার বিজবিজে শূককীট। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ও বললো, ‘নিজের ছেলেকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতে নাকি মামলা তুলে নেবার হুমকি দিতে এসেছেন আপনি?’  ‘যা হয়েছে তার কোন আপস হয় না মা। আর হুমকি দেবার কথা বলছো! হুমকি দেবার মতো মতাবান মানুষও আমি নই। আমি এসেছি এই দুঃসময়ে তোমার পাশে দাঁড়াতে। বিশ্বাস করো...’ ‘আপনি চলে যান।’ ‘আমার কথাগুলো একটু শোনো...’ ‘দোহাই আপনার, আপনি চলে যান। আপনার কোন কথা শুনতে চাই না। আমি আপনাকে সহ্য করতে পারছি না।’ ‘যে মায়ের গর্ভে সাপের জন্ম, যে মা গর্ভে পাপ ধারণ করেছে, তাকে কেউই সহ্য করতে পারে না। এটাই স্বাভাবিক। তুমি আমাকে যা খুশি তাই বলো, যতো খুশি অপমান করো। শুধু আমাকে একটু কথা বলার সুযোগ দাও। আমি তোমার কাছে মিনতি করছি মা।’ আমার কথায় ও একটু শান্ত হলো। বললো, ‘যা বলার তাড়াতারি বলুন।’ ‘মাগো, আমি আমার সন্তানকে ভালবাসি। ভীষণ ভালবাসি। ও আমাকে কষ্ট দেয়, অপমানও করে। তারপরও আমি ওকে আমার নিজের চাইতেও ভালবাসি। কিন্তু আজ আমি আমার সন্তানের জন্য তোমার কাছে করুণা ভিা চাইবো না। আমি চাই, আমার সন্তান শুদ্ধ হোক। অপরাধের শাস্তি ভোগ করে ও ফিরে আসুক আমার আঁচল তলে।’ নাদিয়া দু'হাতে মুখ ঢেকে পুনরায় কেঁদে উঠলো। আমি ওর র মাথায় হাত রেখে বললাম,‘সোহাগ মানে আমার ছেলে ওর বাবার সাথে কাল রাতে দিনাজপুর গেছে আমার ননদের বাড়িতে। কাল-পরশুর মধ্যেই ওকে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। মুর্শিদাবাদে আমার এক চাচা-শ্বশুর আছেন। তার ওখানেই পাঠানো হচ্ছে ওকে।’ নাদিয়া মুখ তুলে অশ্রুসিক্ত চোখে  আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আমি আমার পার্স থেকে ঠিকানা লেখা একখানা কাগজ বের করে ওর হাতে  দিলাম, ‘এখানে দিনাজপুরের আমার ননদের বাড়ির ঠিকানা লেখা আছে। উল্টোপিঠে আমার ফোন নম্বরটাও আছে। আমার যা করার আমি করলাম। এখন তোমার যা ইচ্ছা তুমি তাই কোরো। ভালো থেকো মা।’ আমি আর বসে থাকতে পারলাম না। কান্নায় আমার গলা বুজে আসছে। চোখের জল বাঁধ ভাঙছে। আমি দ্রুত ঘর থেকে বের হলাম উদ্ভ্রান্তের মতো। একবারও পিছে ফিরে তাকালাম না। আমার নাড়িছঁড়া ধনের করুণ নিকট ভবিষ্যৎ, নিজ হাতে লিখে এলাম আমি। আমি দেখতে পাচ্ছি জেলখানার গরাদের ভেতর আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সোহাগ। কী রোগা আর বিষন্ন!  হাসপাতালের গেট থেকে বের হতেই বৃৃষ্টি শুরু হলো। ধূমল বৃষ্টি। আমি ভিজতে ভিজতে হাঁটছি। আমার চোখের বৃষ্টির জলে মিশে যাচ্ছে। আমার এখন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। এতো বৃষ্টি তবু নিভছে না বুকের হোমাগ্নি!                ঢাকা।  জুলাই ২০১৪।                                 
Likes ১২ Comments
০ Share

Comments (12)

  • - পিয়ালী দত্ত

    valo laglo

    - টোকাই

    প্রকৃতির এ কেমন খেলা?
    বার বার নতুন রুপ; বিস্ময় অপার
    অথচ যাপিত জীবন!