Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

সি এম সাইয়েদুল আবরার

১০ বছর আগে লিখেছেন

আমাদের মাস্টারদা............

আমাদের মাস্টারদা...

তোমাদের অনেকেরই হয়তো মনে আছে আশুতোষ গয়ারিকর পরিচালিত হিন্দি ছবি “খেলে হাম জি জান সে”র কথা। ছবিটির শুরুতে আমরা দেখতে পাই মাঠে ফুটবল খেলতে বাঁধা দেওয়ায় একদল কিশোরের মনে ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি ক্ষোভ জন্মে নিজেদের প্রিয় মাঠ বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠে তারা। কিন্তু তাদের পক্ষে যে সম্ভব নয় ব্রিটিশদের সাথে লড়াই করার। তবে তারা জানত একজন আছেন যিনি ভারতকে স্বাধীন করতে নির্ভয়ে লড়াই করছেন। তিনি চট্টগ্রামের এক স্কুল শিক্ষক সূর্যসেন, যাকে সবাই ভালোবেসে ডাকত “মাস্টার’দা”। ছবিটিতে অভিষেক বচ্চন মাস্টারদা চরিত্রে অভিনয় করেন। সবচে’ মজার  ব্যাপারটা কি জানো  তোমরা? হিন্দি ছবিটি কিন্তু বানানো হয়েছে আমাদের চট্টগ্রামে সংগঠিত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের গল্প অবলম্বনে। যে বিদ্রোহের নেতৃত্বে দিয়েছিলেন মাস্টারদা সূর্যসেন। এবার সেই গল্পটাই বলব তোমাদের। যে গল্প দেশপ্রেম, আদর্শ, নৈতিকতা আর রোমাঞ্চে ভরপুর।

চট্টগ্রামের নোয়াপাড়ার নিম্ন মধ্যবিত্ত রাজমনি সেন আর শশীবালার ঘর আলো করে ১৮৯৪ সালের ২২ শে মার্চ জন্মগ্রহণ করেছিলেন সূর্যসেন। পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বিএ পাশ করে চট্টগ্রামে ফিরে আসেন তিনি। যোগ দেন স্কুল শিক্ষকতা পেশায়। অল্পসময়েই ছাত্রদের মনজয়ের পাশাপাশি অর্জন অভিভাবকদের আস্থা অর্জন করতে কষ্ট করতে হয়নি তাকে। তাই ছেলেবুড়ো সবাই ভালোবেসে তাকে ডাকত  “মাস্টারদা”। ছোটবেলা থেকেই ব্রিটিশদের  অত্যাচার দেখে বড় হয়েছিলেন তিনি। তাই দেশকে স্বাধীন করতে তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল তাঁর। কৃষ্ণনাথ কলেজে তাঁর প্রিয় শিক্ষক সতীশ্চন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন বিপ্লবীদল “যুগান্তর” এর সদস্য। তিনি তরুণ সূর্যসেনকে বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২০ সালে চট্টগ্রামের দেওয়াঞ্জি পুকুরপাড়ে তিনি বন্ধু অম্বিকা চক্রবর্তী, চারুবিকাশ দত্ত, তারকেশ্বর দস্তিদার, নগেন্দ্রসেন ও জুলুসেনকে নিয়ে গঠন করেন বিল্পবীদল “সামাশ্রম”। পরবর্তীতে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির বৈপ্লবিক অভিত্থ্যানে অনুপ্রাণিত হয়ে দলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় “ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখা”।

“বিপ্লবী” শুনলেই আমরা ভেবে বসি এ বুঝি সুঠাম দেহের বলবান শারীরিক গঠনের কেউ যিনি অস্ত্র হাতে প্রতিপক্ষকে নিমিষেই গুড়িয়ে দিবেন। অথচ অস্ত্র চালান দূরে থাক সূর্যসেন শারীরিক ভাবে ছিলেন খুবই দুর্বল। কিন্তু তার নৈতিক ও মানসিক বল ছিল অসীম। আর তাই লোকনাথ বল আর অনন্ত সিং এর মত বলবান বিল্পবীরাও তাঁর নেতৃত্বের কাছে মাথা নোয়াতেন। মাস্টারদা’র কিছু নৈতিক আদর্শ সকলকে আকৃষ্ট করত। অস্ত্র কেনার প্রয়োজনে বিপ্লবীদলগুলো ডাকাতি করে টাকা জোগাড় করত। ১৯২৩ সালে একবার তাঁর নির্দেশে এ.বি.রেলের ১৭,০০০টাকা ডাকাতি করা হলে তিনি অনুশোচনায় ভোগেন।এরপর তিনি ডাকাতি ছেড়ে দলের সভ্যদের চাঁদা দেওয়ার প্রথা চালু করেন। তার নির্দেশে অনুপ্রাণিত হয়ে বাবার সিন্দুক ভেঙে টাকা এনে দেয় অনন্ত সেন, জমিদারপুত্র শ্রীপতি চুরি করে আনে বাবার ব্যবসার টাকা। দরিদ্রতম বিপ্লবী ধীরেন দে মা’র রূপোর গহনা এনে দেয় দেশের কাজে। মাস্টারদার এ সিদ্ধান্তে সাধারণের মাঝে যেমন তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যায় তেমনি দলের মধ্যে সংহতিও বৃদ্ধি পায়।

মাস্টার’দা নৈতিকতা থেকে কখন বিচ্যুত হন নি। শিষ্যদের উদ্দেশ্যে তিনি একবার বলেছিলেন, “দেশের মুক্তির জন্যই আজ আমরা সন্ত্রাসী সেজেছি। আমাদের চেয়ে মানুষকে আর বেশি কে ভালোবাসে? নিজেদের বিবেককে সহস্রবার প্রশ্ন করবে কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায়”।

মাস্টার’দা বুঝতে পেরেছিলেন যে সুসজ্জিত ব্রিটিশসেনাদের বিপক্ষে জয়ী হতে অত্যাধুনিক অস্ত্র প্রয়োজন। তাঁর  নির্দেশে ১৯৩০ সালে  চট্টগ্রামের পাহাড়তলির অস্ত্রাগারে অতর্কিত হামলা চালিয়ে অস্ত্র লুঠ করে নেয় রিপাবলিকান আর্মির বিল্পবীরা। এরপর পুলিশ রিজার্ভ দখল করে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। সূর্যসেন অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠনের ঘোষণা দিয়ে বলেন, “ভারতের জাতীয় পতাকা আকাশে উড়ছে। আমাদের কর্তব্য নিজেদের জীবন ও রক্তের বিনিময়ে এটিকে রক্ষা করা।“চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের” এই ঘটনার পর চট্টগ্রাম চারদিন ব্রিটিশশাসনথেকে মুক্ত ছিল।

তোমরা নিশ্চয় জান যে ব্রিটিশরা প্রায় ২০০ বছর উপমহাদেশের মানুষকে শোষণ করেছে। তারা ভারতীয়দের মানুষ হিসেবে ভাবত না। এ জন্যে পাহাড়তলীর ইউরোপিয়ান ক্লাবে যেখানে তারা আমোদ ফুর্তি করত তার ফটকে লেখা থাকত “কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ”। ভারতীয়রা যে এ ক্লাবকে ঘৃণা করত তা মাস্টারদা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই জালালাবাদ হত্যাযজ্ঞের প্রতিশোধ নিতে বেছে নেওয়া হয় এটিকে। ১৯৩২ সালে ১৮ এপ্রিল, আইরিশ অভুত্থ্যানের স্মরণীয় দিনে মাস্টারদা’র নির্দেশে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নেতৃত্বে সন্ধ্যাবেলা আক্রমণ করে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি। এতে নিহত হন ৫ জন ব্রিটিশ সভ্য, আহত হয় অনেকেই। এ সফল অভিযানের পর দেশের জন্য আত্মাহুতি দেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম নারী শহীদ প্রীতিলতা। তার এই আত্মত্যাগ এ মাস্টারদা গর্বিত হলেও প্রীতিলতার মত বিপ্লবীকে হারিয়ে কিছুটা ভেঙে পড়েন।

এ ঘটনার পর মাস্টারদা কে ধরতে মরিয়া হয়ে উঠে ব্রিটিশ সরকার। ১০,০০০টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয় তাকে ধরিয়ে দিতে। আত্মগোপনে চলে যান মাস্টারদা বেশ কিছুদিনের জন্যে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে তাঁরই স্নেহের আত্মীয় নেত্রসেনের বিশ্বাসঘাতকতায় ১৯৩৩ সালের ১৯ শে ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করা হয় মাস্টারদাকে। নেত্রের এ বিশ্বাসঘাতকতায় বিপ্লবীদলে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয় । রাতে

এদিকে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচার শেষে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় মাস্টারদা সূর্যসেন ও তারাকেশ্বর দস্তিদারকে। দীপান্তর যাবজ্জীবন হয় কল্পনা দত্তের।

১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি  গভীর রাতে তাঁদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। আদর্শের বিস্ফোরণ হতে পারে এই ভয়ে ব্রিটিশসরকার পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর না করে বঙ্গোপসাগরে সলিল সমাধি দেয় এই মহান বিপ্লবীকে।

১১ জানুয়ারি জীবনের শেষ রাতে মাস্টারদা তাঁর শিষ্যদের উদ্দেশ্যে এক চিঠিতে লিখেন, “আমার বিদায় বাণী- আদর্শ ও একতা। আজ এ আনন্দময়, পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ দিনে আমি তোমাদের জন্য কি রেখে গেলাম? আমার স্বপ্ন, একটি সোনালি স্বপ্ন। স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। প্রিয় বিপ্লবী বন্ধুরা, এগিয়ে চলো কখনও পিছিয়ে যেও না। দাসত্বের শৃঙ্খল ভাঙার সময় এসে গেছে। বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত”।

এখন নিশ্চয় তোমরা বুঝতে পারছ যে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সূর্যসেন এক মহানায়ক। কেননা ভারতের অনেক মাস্টারমশাই ই বিপ্লবীনেতা হয়েছিলেন বটে কিন্তু “মাস্টারদা’ হতে পেরেছেন কেবল তিনিই। 

Likes ১০ Comments
০ Share