Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

Azimul Haque

১০ বছর আগে লিখেছেন

স্বপ্নের সলিল সমাধি

 

 

 

ছেলেটা কাছাকাছি থাকতে চায় সবসময় বলে মনে হয় ডা. মাশার কাছে । এমবিবিএস ও,   চাকরী নিয়ে ঢাকা থেকে চলে এসেছে চিটাগাংয়ের এই ’মা ও শিশু’ হসপিটালে । গত কিছুদিন থেকেই দেখছে ও যে, বিশেষ করে শনিবার ছুটির দিনে ৮/৯ বছরের এই ছেলেটা পিছ পিছ ঘুর ঘুর করছে ওর ।

কেমন যেন একটা মায়া আছে ছেলেটার চোখে-মুখে । না পারে কিছু বলতে ওকে, আবার বিরক্তিও লাগেনা । কাজের ফাঁকে ফাঁকে চেয়ে থাকে সময় সময় খানিকক্ষন, আবার ডুবে যায় কাজে । এক আধবার গালও টিপে দিয়েছে ছেলেটার, ভালই লাগে । কেমন যেন মনে হয় ওর, নিজেই বোঝেনা ।     

এই ছেলে, তোমার নাম কি ? অবসরের একসময় জিঞ্জেস করে ও ।

দিপু, বলে ছেলেটা ।

দিপু ! তুমি বাংগালী ?

না, মারমা । বাংগালীও বলতে পারো ।

মানে ?

মানে মা মারমা, বাবা ছিল বাংগালী ।

ছিল মানে ! এখন নেই ?

না নেই, মারা গেছে ।

কোলে টেনে নেয় ছেলেটাকে মাশা । আদরও করে কিছুক্ষন ।

মার কাছে যাই বলে ছুট দিয়ে পালিয়ে যায় ছেলেটা ।

 

আপু কি করো ? পরদিন আবার ডেকে উঠলো ছেলেটা ওর পেছন থেকে । কথা বলছেনা দেখে ওর কামিজের একটা অংশ ধরে দাঁড়িয়ে থাকে দিপু । এক রোগীর সাজেশন দিতে ব্যস্ত তখন মাশা, বাঁ হাতটা দিপুর মাথায় ।

ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখতে পায় দিপুর মাকে । আগেরবারে চিকিতসার সময় দেখেছিল থামি (আদিবাসী মেয়েদের লুংগী-ধরনের পোষাক)পরা এক মারমা মহিলা, কিন্তু এবার দেখে আটপৌরে একখানা শাড়ি পরা । মনে হচ্ছে যেন এক বাংগালী মহিলা ।

’নমস্কার’ বলেন ম্যনাচিং, দিপুর মা ।

একইভাবে মাশাও বলে প্রতিউত্তরে ।

আপনারতো খুব ভক্ত হয়ে গেছে দিপু, ও কালকে বলে আপনি তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করেছেন । আজ তাই আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে এসেছি মা ।

না, কেন জানি মনে হোল, ওর বাবা নেই বলে খুব অসহায় ও, তাই আদর করতে ইচ্ছা হোল খুব, সেইজন্য আর কি । আমারওতো বাবা …

কথা কেড়ে নিয়ে ম্যনাচিং বলেন, কি হয়েছে আপনার বাবার ?

না, মানে মারা যাননি হয়তো এখনও, তবে নিখোঁজ । অবশ্য এরকম নিখোঁজ হওয়া উনার নতুন নয়, আগেও একাধিকবার হয়েছে এরকম ।

ও আচ্ছা, আমারও বাবা নিখোঁজ হয়ে গেছেন, সে অনেক বছরের কথা মানে প্রায় ২৫/৩০ বছর আগে থেকে উনি নিখোঁজ । আমার মা তাঁর জন্য চিন্তায় চিন্তায় মারাই গেলেন বছর কয় আগে । উনাদের বার্মা (মায়ানমার) যাতায়াত ছিল । শেষবার গিয়ে আর ফিরে আসেননি ।

আশ্চর্য, এতো মিল আমার আপনার সাথে ? আমার, আন্টি, বাবা ইন্ডিয়া যান, ঘুরে বেড়ান । বছরে দু’একটা বইও বের হয় ওনার, ইঞ্জিনিয়ারিং কিছু কাজ জানেন, কাজ করে নিজে কোনমতে চলেন, আর ঘুরেন ।

আপনার মা-কে নিয়ে যাননা ?

মাকে নিয়েও একবার উধাও হয়েছিলেন, আমরা জেনেছিলাম দিনকয় পরে । মাসখানেক বাদে দেখি চলে এলেন আবার । আসলে বাবার কিছুটা মানসিক অসুস্থতা আছে বলে আমার মনে হয় ।

আপনার মা বাধা দেননা ?

বাধা দিলেও হয়না । উনি তো আর বলে যাননা আমরা বাধা দিব বলে ।

কাজের সময় ডা. মাশার এখন, ডাক এসেছে, ছুটতে হোল কাজে । বলে গেল, আপনার বাসাতো কাছেই, অবশ্যই বেড়াতে আসবেন আন্টি । আর দিপুতো যাবে এখন আমার সাথে, চলো দিপু । আপনি ভিতরে বসেন আন্টি ।

পেটের খিঁচুনির কারনে এই হাসপাতালে কয়েকদিন ভর্তি ছিলেন ম্যনাচিং । সেই সূত্রেই ডা. মাশার সাথে পরিচয় । কিন্তু এক পরিচয়েই সম্পর্কের এক বিচিত্র দিগন্ত উন্মোচন হলো যখন তাদের, হৃতপিন্ডের দু-একটি বিট সেই মুহূর্তে তাঁর বন্দই হয়ে গিয়েছিল । ছোটবেলায় বাবাকে পেতেন অনিয়মিত, তারপর একসময় আর কোনদিনই দেখতে পেলেননা । তারপর একসময় বিয়ে হয়, পাঁচমাসের মাথায় স্বামীর সাথে ডিভোর্স । সন্তানহীন ম্যনাচিং ভালই চলছিলেন । অফিসে মূদ্রাক্ষরিকের সকাল-বিকেলের কাজ, আর বাসায় নৈমিত্তিক সময় কাটানো । এমন সময় আসে দিপুর বাবার আহ্বান । ওরই অফিসের বস, ঢাকায় থাকে দুই মেয়ে আর স্ত্রী, আর তিনি এই পাহাড়ে ওদের ইঞ্জিনিয়ারিং বস । 

না, খুব বেশী ভালবাসাসি ছিলনা তাদের মধ্যে । ম্যনাচিং এর একাকীত্ব ওদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠার দ্বিতীয় কারন, কিন্তু প্রথম এবং বলা যায় প্রধান কারনই হাসান । লোকটার আহ্বানে কিরকমভাবে যেন মোমের মত গলে যান ম্যনাচিং । গোপনে বিয়ে করেন তারা এক কাজী অফিসে এবং কেটে যায় একটি বছর এরপর ।

বিয়ের পর কেন যেন হাসানের উচ্ছ্বাসটা কিছুটা মন্থর গতি পায় । বিয়ের পরদিনই উদ্ভ্রান্ত রাতে ম্যনাচিং লক্ষ করেন, কেমন যেন অস্বাভাবিকভাবে বলে উঠেন হাসান, বিয়ে করে উনি উনার প্রথম স্ত্রী এবং সন্তানদের উপর অবিচার করেছেন । ম্যনাচিংকে শপথ করান বিষয়টা গোপন রাখার । ম্যনাচিংও মেনে নেন । হাসান তাঁর কাছে যে আকর্ষনীয় ।

হাসান দেশ এবং রাজনীতির চিন্তা লালন করা এক ব্যক্তি । সারা জীবন দেশ-সমাজের কথা ভেবে এসেছেন তিনি । চিন্তা আছে তার, সাথে কেউ থাকুক বা না থাকুক, একদিন তিনি দেশে গনমানুষের, প্রধানত: তরুন সমাজের সমস্যাগুলি সমাধান-উপযোগী সারাদেশব্যপী একটা সংগঠন গড়ে তুলবেন, বিরাট এক আন্দোলন গড়ে তুলবেন, তরুনদের প্রত্যক্ষ যে আন্দোলনের তোড়ে দেশ থেকে সকল দু:শাসন ধুয়ে-মুছে যাবে । আর ফুটে উঠতে শুরু করবে সুশাসনের আলো, সারাদেশময় । এধরনের চিন্তাধারার একটা আত্মবিশ্বাসী অবয়ব ফুটে থাকত হাসানের চোখে । আর এটাই আকৃষ্ট করে রাখত ম্যনাচিংকে । আহ্বান পেয়ে সাড়া দিতে তাই মোটেই দেরী হয়নি তাঁর ।

কেন আজকে তার ঘুম আসছেনা ! মাশাকে যেদিনই দেখেন, সেদিনই ঘুম আসেনা ম্যনাচিংএর । মনে পড়ে হাসানের কথা । চিকিতসক হিসেবে প্রথম দেখার দিন একটু চমক যে লাগেনি তা নয় । অবশেষে রিলিজের দিন বিঁধে থাকা সেই খটকার অবসান ঘটে ।

দিপুটা এরকম কেন, কিভাবে ও তার এতো কাছের হয়ে উঠছে আস্তে আন্তে, ভেবে পায়না মাশা । পাশাপাশি চলতে চলতে মাশার হয় আংগূল না হয়তো কামিজের প্রাস্ত ধরেই থাকা লাগবে তার । আর সে-ই বা কম কিসে! কথা বলার সময় তারও এক হাত থাকে দিপুর মাথায় । কেন এমন হচ্ছে ? মনে মনে ভাবে, দিপু যদি ওর ভাই হোত, তবে কতই না ভাল হোত ! পিতৃহীন এই ছেলেটিকে নিজদায়িত্বে অতিযত্নে মানুষ করতো ও । মনে মনে ভাবে মা-কে বলতে হবে ।

বাবার নাম শুনে সেদিন ওরকম, মানে ম্যনাচিং কেন কিছুটা চমকে গিয়েছিলেন, সেটাও ছোটখাটো এক রহস্য হয়ে আছে মাশার কাছে । দুবছর একসাথে চাকরীই করেছেন ওরা, কিন্তু সেজন্য ওরকমভাবে চমকে উঠতে হবে ? চমকে উঠেই সামলিয়ে নিয়ে সোজা বাথরুমে চলে গিয়েছিলেন তিনি, বাথরুমে কি করেছিলেন তিনি ? চোখের পানি আড়াল করতেই তো মানুষ ওকাজ করে থাকে । বাবার নামের সাথে এই মহিলার চোখের পানির সম্পর্কের কারন হতে পারে একটাই । না, বাবাকে ওরকম ভাবতে পারেনা মোটেই মাশা । সরকারী চাকরী করার কারনে রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট হতে-না-পারার ক্ষোভে অতৃপ্ত বাবা কখনও এতো জঘন্য হতে পারেনা । বাবা সম্পর্কে এই চিন্তাটা মাশার মনে দৃঢ়ভাবে গাঁথা । আর একারনেই বাবা সম্পর্কে এধরনের দুশ্চিন্তা তার কেটে যেতে সময়ও লাগেনি ।

কিন্তু মহিলাকে দেখলেই কেন এই দুশ্চিন্তাটা তার বেড়ে উঠে ? আজ সকালে যখন আবার উনাকে দেখে মাশা, মনে হয় যেন অত্যাচারিতের আধার এক মহিলা তার সামনে দাঁড়িয়ে । কেন এমন হয়, ভেবে পায়না ও । যে বাবা ওর বলতো, রাজনীতিই আমার প্রথম ধ্যান-ঞ্জান, সে বাবার রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা কোথায় গেল, কেন গেল, কেনই বা মহিলা সেদিন বাবার নাম শুনেই বাথরুমে চলে গেল, ভাবতে ভাবতে সিদ্ধান্ত নেয় ও, আজই এবং এখনই জানতে হবে ।

ভাড়া করা ছোট্ট বাসাটায় কলিং বেল বেজে উঠলো ম্যনাচিংএর, রাত তখন বারোটা পেরিয়েছে । জেগেই ছিলেন ম্যনাচিং । দরজা খুলেই ক্লান্ত-শীর্ণ দুটি হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেন মাশাকে । জড়িয়েই থাকেন, ছাড়েন যখন বুঝতে পারেন তার চোখের পানি মাশার পিঠে পড়ছে ।

এতো রাতেও ঘুমাননি! চোখ মুছিয়ে দিয়ে জানতে চায় মাশা ।

ঘুমাবো কি মা! তোমাকে যেদিন দেখি, সেদিন রাতে আমার ঘুম আসেনা ।

আমারও এমন হয়, কেন হয় বলতে পারেন আন্টি ?

আন্টি নয় মা, আমি আপনার আব্বার দ্বিতীয় স্ত্রী, আপনারা যা জানতেননা ।

বলেন কি, সত্যি, স্বগোতক্তি করে মাশা । মাথার মধ্যে বিদ্যুত খেলে যায় তার ।  

হাঁ মা, তোমার বাবার চোখে স্বপ্ন দেখার কি একটা অবয়ব যেন ফুটে থাকত সর্বদা, যাতে আকৃষ্ট হয়ে পড়ি আমি, তবে তোমার বাবাই এগিয়ে এসেছিলেন প্রথম । বলে চলেন তিনি, আমাকে নিয়ে ঘুরতে ভালবাসতেন, কোনরকম খারাপ নজর ছিলনা আপনার বাবার ।  বিপ্লবী হওয়ার কারনে স্বপ্ন নিজে দেখতেন এবং আমাদেরও দেখাতেন, একদিন আমাদের এই জনপদে সঠিক একজন জন্মলাভ করবে, নিপীড়িত এই জনগোষ্টির উপর থেকে সংঘটিত সমস্তরকম অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে যে শুধু রুখেই দাঁড়াবেনা, জীবন তুচ্ছ করে এগিয়ে যাবে শুধুই অধিকার প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামে । এ সম্পর্কিত কিছু লিখাও ছিল তার । এগুলিই আমাকে মোহিত করে তুলেছিল মা ।

মুখ নীচু করে অনেকক্ষন বসে আছে সোফায় মাশা । বাবার রাজনৈতিক চেতনার বিনাশের শুরু তাহলে এখান থেকেই, ভাবে সে । সম্ভবত: বিয়ের কারনেই তার মনে একধরনের অপরাধবোধের জন্ম হয় এরকম যে, প্রথম স্ত্রী ও সন্তানদের তিনি ঠকাচ্ছেন । এই অপরাধবোধই তাঁর সকল কর্মক্ষমতাকে ম্রিয়মান করে দিয়েছে । আজ আর তিনি বিপ্লবী নন, অপরাধবোধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কোথায় কোথায় যেন । বিপ্লবী সত্ত্বার তেজী ভাবটা মরে গেছে আজ তাঁর । অপরাধবোধ এমনই জিনিস । অনেক কষ্টকর অনুভূতির এসমস্ত জায়গায় বিচরন করতে করতে মনে হয় তার, দিপু! কে এই দিপু ?

কে এই দিপু, মা ?

ও তোমারই ছোটভাই মা, দু:খী ছেলেটাকে এখনও চিনতে পারলেনা মা ?

ছুটে যায় ও পাশের ঘরে ঘুমিয়ে থাকা দিপুর বিছানায় । তাকিয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষন, এই ছেলেটিই তার ভাই, অতি আদরের ছোটভাই ? আহা কি মায়াময় আদল, অনেকটা তার বাবারই মত । এই ছেলেটিই অবহেলায় বড় হচ্ছে, যে নিজেও জানেনা, মমতাময় বাবা বেঁচে আছে ওর । আর থাকতে পারেনা ও, জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে ওরই বিছানায় । নিজ বাসায় ফেরা হয়না আর, আজ রাতে তো নযই, হবে কি-না আর কোনদিন, তারও যে কোন ঠিক ‍নেই আর ।                         

Likes Comments
০ Share

Comments (3)

  • - আলমগীর সরকার লিটন

    পোষ্টটা পড়লাম সত্য কথায় বলেছেন

    অভিনন্দন--------

    - মুখোশের ফেরীওয়ালা

    ধন্যবাদ ভাইয়া। এটা শুধুই আমার আত্মউপলব্ধি.