Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

শফিক সোহাগ

৭ বছর আগে লিখেছেন

অতঃপর সাজেক ভ্রমণ

পার্বত্য চট্টগ্রামের দুটি জেলা বান্দারবান ও রাঙ্গামাটি বহুবার ভ্রমণ করেছি । কিন্তু খাগড়াছড়ি জেলা ভ্রমণ করা হয় নি । অবশ্য বছর পাঁচেক আগে একবার খাগড়াছড়ি জেলার তবলছড়িতে গিয়েছিলাম । তাও আবার ব্যক্তিগত কাজে, পর্যটনকেন্দ্রে ভ্রমণের জন্য নয় । খাগড়াছড়ি ভ্রমণের অপূর্ণতা পূরণের জন্য দু’বছর ধরেই নানান প্রচেষ্টা চালিয়েছি । বিশেষ করে আলুটিলার গুহা আর সাজেক ভ্রমণের ইচ্ছে ছিল প্রখর (উল্লেখ্য, সাজেক এলাকাটি রাঙ্গামাটি পার্বত্যজেলার একটি অংশে পড়েছে তবে খাগড়াছড়ি দিয়েই যাতায়াত সুবিধাজনক)  ভ্রমণের প্রচণ্ড ইচ্ছে থাকা সত্তেও সময় সুযোগ হয়ে উঠেনি ।ভ্রমণের প্রচণ্ড ইচ্ছে থাকা সত্তেও সময় সুযোগ হয়ে উঠেনি । বন্ধুদেরও কারোও না কারোও সমস্যা থাকবেই । কেউ যেতে পারছে তো কেউ পারছে না । বেশ কয়েকবার প্রোগ্রাম নির্ধারণ করেও বাতিল করতে হয়েছে । ফলে ইচ্ছে অপূর্ণই রয়ে যায় । অতঃপর কোনো প্রকার পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই সম্প্রতি তা পূরণ হল ! 
 

ঈদুল আযহার দিন, ২০১৬ । সকল বন্ধুরাই গ্রামের বাড়িতে গিয়েছে । সারাদিন ব্যস্ততায় ছিলাম কিন্তু রাতের বেলায় ভালো লাগছিল না । আমার খুব প্রিয় বন্ধু ডাঃ সুমনকে ফোন দিলাম ।

 

আমিঃ দোস্তো, মন-মানসিকতা ভালো নেই । চল কালকে কোথাও বেড়াতে যাই ।

সুমনঃ কাল তো চেম্বারে বসতে হবে ।পার্মানেন্ট কিছু রোগী এসে খুঁজবে ।

আমিঃ কাল চেম্বার বন্ধ রাখ । টাকা আর কত কামাবি ? জীবনে বিনোদনেরও দরকার আছে ।

সুমনঃ (আমতা আমতা করে) উমমম... আচ্ছা দেখি

আমিঃ (ঝাড়ি দিয়ে) মন-মানসিকতা এমনিতেই ভালো নেই, দেখিটেখি না বলে ইয়েস অর নো একটা বল

সুমনঃ আচ্ছা যা, যাবো । তোর জন্য কাল চেম্বার বন্ধ ।

আমিঃ ওকে থ্যাংকস । সকালে ফোন দিবো ।

 

ঈদের পরদিন সকাল ৮ টায় সুমনকে ফোন দিলাম

 

আমিঃ কিরে ঠিক আছিস তো ? নাকি আবার মত পাল্টেছিস ?

সুমনঃ (আমতা আমতা করে) উমমম .... উমমম...., আচ্ছা যাবি কোথায় সেটা বল ।

আমিঃ কোথায় যাবো জানি না, তবে যাবো । এটাই হল কথা । এক ঘণ্টার মধ্যে রেডি হয়ে জিইসি মোড়ে আয় ।

সুমনঃ আচ্ছা ।  

তড়িঘড়ি করে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম । বাসায় সবাই জানতে চাইলো কোথায় যাচ্ছি । বললাম, তা এখনও জানি না, তবে কক্সবাজার না হয় সাজেক । জিইসি, গরীবউল্লাহ্‌শাহ এলাকায় এসে পৌঁছাতে সকাল পৌনে ১০টা বাজলো । কিছুক্ষণের মধ্যেই সুমন এলো ।

সুমনঃ কই যাবি চল

আমিঃ চল সাজেক না হয় কক্সবাজার যাই । তবে আমার ইচ্ছে সাজেক ।

সুমনঃ উমমম, চল কক্সবাজার-ই যাই ।

আমিঃ ওকে 

 

গরীবউল্লাহ্‌শাহ এলাকার বিভিন্ন এসি কাউন্টারে এলাম কিন্তু কক্সবাজারের কোনো টিকেট নেই । নন এসিতেও খোঁজ নিলাম, তাও নেই । সুমনকে বললাম 

আমিঃ চল তাহলে সাজেক-ই যাই ।

সুমনঃ কিন্তু আমি তো বাড়তি কাপড় আনিনি ।

আমিঃ আমি বাড়তি অনেক কাপড় এনেছি । আমার গুলো ব্যবহার করতে পারবি ।

সুমনঃ খাগড়াছড়ির গাড়ির জন্য তো আবার অক্সিজেন যেতে হবে । চল তাহলে

আমিঃ ওকে চল । 

অক্সিজেন কাউন্টারে এসে দেখি খাগড়াছড়ি যাওয়ার যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় । নিয়মিত যাত্রী ছাড়াও প্রচুর পর্যটক ভ্রমণে যাচ্ছে । তাই এমন পরিস্থিতি । বহু কষ্টে বাসের টিকেট ম্যানেজ করলাম । অতঃপর খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হল । বিকেল ৩ টা ২৬ মিনিটে পৌঁছে গেলাম খাগড়াছড়ি শহরে । দু’জনই খুব ক্ষুধার্ত । শাপলা চত্বরে এসে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম । এরপর সময় নষ্ট না করেই রওনা হলাম আলুটিলার দিকে । উদ্দেশ্য- অন্ধকার ভয়ঙ্কর গুহা অভিযানের এডভেঞ্চার । উপমহাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গ এই আলুটিলায় অবস্থিত । নামে টিলা হলেও মূলত এটি একটি পর্বত । খাগড়াছড়ি শহর থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে আলুটিলা পর্বত অবস্থিত । ইতিহাস থেকে জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে খাগড়াছড়ি এলাকার মানুষ এই পর্বত হতে বুনো আলু সংগ্রহ করে তা খেয়ে বেঁচে থাকে। সেই থেকে এ পর্বতটি আলুটিলা নামেই পরিচিত ।

 

                                                           আলুটিলা পাহাড়ে 

আমরা আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রের সম্মুখ হতে টিকেট কেটে ভিতরে প্রবেশ করলাম । সাথে নিয়ে নিলাম দুটি মশাল । বাঁ পাশে নীচের দিকে চলে যাওয়া রাস্তা ধরে সবার মত আমরাও নীচের দিকে নামছি সেই সাথে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছি চারপাশের নয়নাভিরাম অফুরান সবুজের সমারোহে । আর সেলফিতে মগ্নতা তো আছেই । কিছুদূর যাওয়ার পর দেখতে পেলাম গুহায় যাওয়ার পথটি সিঁড়ি করা রয়েছে । ২৬৬ টি সিঁড়ি অতিক্রম করে পাহাড়ের পাদদেশে এসে দেখা মিলল সেই রহস্যময় গুহার ।স্থানীয় লোকের ভাষায় এর নাম “মাতাই হাকর”যার বাংলা অর্থ দেবগুহা। অন্ধকারে আচ্ছন্ন গুহাটির মুখের ব্যাস প্রায় ১৮ ফুট এবং দৈর্ঘ্য প্রায় ২৮০ ফুট।

 



গুহা অভিযানে আসা অন্যান্য টুরিস্টদের মত আমরাও মশাল জ্বালিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম । চারপাশ নিকষ কালো গাঢ় অন্ধকার । তলদেশ দিয়ে শীতল জলের ঝর্ণাধারাপ্রবাহমান । উপর থেকেও বৃষ্টির মত পড়ছে জল । রহস্যময় ভূতুড়ে এক পরিবেশ ! বড় বড় পাথর অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা । ভয়ঙ্কর পরিবেশেও বাদ যায় নি সেলফি তোলা ।

 


                                                          গুহার ভিতরে আমরা 


কিছু কিছু স্থানে উচ্চতা খুব কম হওয়ায় নতজানু হয়ে হাঁটছি । প্রায় ১৮ মিনিট পর ২৮০ ফুট দৈর্ঘ্যের গুহা অতিক্রম করে আমরা বেড়িয়ে এলাম । সমস্ত শরীর থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরছে । শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিও বৃদ্ধি পেয়েছে । আমরা বড়ই ক্লান্ত । সামনে এগুতেই পেয়ে গেলাম ডাব বিক্রেতার দেখা ।ডাবের পানিতে চুমুক দিয়ে ক্লান্তি দূর করলাম । গুহা অভিযানের এডভেঞ্চারটি যেমন ছিল ভয়সংকুল তেমনি রোমাঞ্চকরও বটে।গুহা থেকে সামান্য দূরেই ছিল রিসাং ঝর্ণা । সন্ধ্যে হয়ে যাওয়ায় সেখানে যেতে পারলাম না ।

 

                                                              হোটেল মাউন্ট ইন 

গুহা এডভেঞ্চার শেষে খাগড়াছড়ি শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ‘হোটেল মাউন্ট ইন’ এ এসে উঠি ।বিনোদনের পাশাপাশি দুশ্চিন্তাও আমার সঙ্গী হয়ে আছে । ঈদের মৌসুম হওয়ায় সাজেকে জমেছে পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড় । সকল কটেজই বুকিং হয়ে আছে । আমি ফোন করে বিভিন্ন কটেজের সাথে যোগাযোগ করে যাচ্ছি । কোনো কটেজই মিলছে না ।অবশেষে এক উপজাতি মহিলা ফোন করে জানালেন যে, তাদের কটেজে একটি রুম ম্যানেজ হয়েছে, ২ জন থাকা যাবে । কিছুটা স্বস্থি পেলাম তবে সম্পূর্ণ নয় । কারণ সাজেকে যাওয়ার গাড়ি এখনও ম্যানেজ হয় নি । হোটেলের ম্যানেজার নিজেও অনেক চেষ্টা করলেন ।পরে তিনি পরামর্শ দিলেন সকাল ৬ টা থেকে ৭ টার মধ্যে শাপলা চত্বরের সামনে গেলে গাড়ি অবশ্যই ম্যানেজ হবে ।সকল পর্যটক নাকি ওখানে গিয়েই ভিড় করেন । ওখান থেকেই ছোটছোট গ্রুপ গুলো একত্রিত হয় ।

সকাল পৌনে ৭ টায় শাপলা চত্বরে এসে দেখি পর্যটকদের ভিড় ।স্বল্প সময়ের মধ্যেই ২টি গ্রুপের সাথে যুক্ত হলাম । একটি গ্রুপে একই পরিবারের ৪ জন সদস্য ঢাকা থেকে এসেছেন । তারা হলেন সাদান ভাই, তার বোন সারকা দিদি ও ভগ্নিপতি আশিক ভাই এবং কাজিন লেনিন ভাই। সারকা দিদি ও আশিক ভাই স্বামী-স্ত্রী দু’জনই চার্টার্ড একাউন্টেন্ড । অপর গ্রুপেও আছেন ৪ জন ।সজীব ভাই, হাসান ভাই, মাঈনুল ভাই ও আকাইদ ভাই । প্রত্যেকেই উচ্চ শিক্ষিত । কেউ কলেজের ইংরেজির লেকচারার ।গ্রুপ দুটো আমার মনের মতই হল । ভ্রমণ সঙ্গী যদি সমমনা ও মিশুক প্রকৃতির না হয় তবে সবই পানসে হয়ে যায় । তাদের দেখে মিশুক প্রকৃতিরই মনে হচ্ছে ।অতঃপর ১০ জনের টীমের জন্য একটি জীপ ভাড়া করলাম । একরাত থাকা সহ আসা যাওয়া সাড়ে সাত হাজার টাকা ।           

সকাল পৌনে নয় টায় আমাদের যাত্রা শুরু হল । আমি আর সুমন বসেছি জীপের সামের সীটে । আকাইদ ভাই, সাদান ভাই, আশিক ভাই ও সারকা দিদি বসেছেন জীপের ভিতরে । জীপের ছাঁদে বসেছেন সজিব ভাই, হাসান ভাই, মাঈনুল ভাই এবং লেনিন ভাই । আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ বেয়ে ছুটে চলেছে আমাদের জীপ । আমাদের সামনে পিছনে সারিবদ্ধ হয়ে চলছে শত শত গাড়ি । সকলেই ছুটে যাচ্ছে আকাশের সাথে পাহাড়ের প্রেম দর্শন আর সবুজের স্নিগ্ধতা মন্থনের আশায় । প্রায় দেড় ঘণ্টা পর বাঘাইহাট এসে পৌছলাম । সেখানে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে আমাদের নাম এন্ট্রি করানোর পর সেনাবাহিনী প্রোটোকল দিয়ে আমাদের সাথে নিয়ে সাজেকের পথে রওনা হল । আমি বেশকিছু চকলেট কিনে নিলাম । রাস্তার দু’পাশে উপজাতিদের বিচ্ছিন্ন কিছু ঘর রয়েছে । উপজাতি শিশুরা রাস্তায় এসে হাত নাড়িয়ে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে ।আমি তাদের মাঝে চকলেট ছুড়তে থাকি । চকলেট পেয়ে শিশুরা বেশ আনন্দিত ! তাদের আনন্দের হাসি দেখে আমিও আনন্দিত !   

 

                                                                  সাজেকের পথে 

দুর্গম গিরির বন্ধুর পথ বেয়ে ছুটে চলেছে আমাদের জীপ । চারপাশে সবুজের সমারোহ । আকাশচুম্বী পাহাড়ের বুকে সবুজে সজ্জিত উদ্ধত শিখর তুলে দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষগুলো অপূর্ব রূপ ধারণ করেছে । প্রকৃতির এই নয়নাভিরাম দৃশ্য আরও ভাল ভাবে উপভোগ করার জন্য আমি এবং সুমন জীপের ছাঁদে উঠে সজীব ভাইদের সাথে যোগ দিলাম ।নিজেকে দুর্গম গিরিজয়ী মনে হচ্ছিলো ।    

দুপুর ১ টা ১৭ মিনিটে আমরা সাজেকের রুইলুই পাড়ায় এসে পৌঁছলাম । জীপ থেকে নেমেই আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি কটেজ নিয়ে । সদস্য সংখ্যা ১০ জন হয়ে যাওয়ায় পূর্বে বুকিং দেওয়া দু’জনের রুমটি বাতিল করতে হল । অনেক খোঁজাখুঁজির পর মনাস নামক এক ত্রিপুরা উপজাতির বাড়িতে দুটো রুম মিললো । সাড়ে তিন হাজার টাকায় রুম বুকিং দিয়ে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললাম । এরপর পাহাড়ী ছড়ায় গিয়ে শীতল জলে গোসল করে আরেকটু স্বস্থি পাই । ক্ষুধায় তখন কাতর সবাই । এমন পরিস্থিতিতে খাবার দোকানে গিয়ে আরেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হল ।দুপুরের খাবারের জন্য সকালেই অর্ডার করতে হয়; তা নাহলে খাবার পাওয়া যায় না ! অনেক অনুরোধের পর দোকানদারকে রাজি করানো গেল, তাও আবার রান্নার জন্য আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে ! সাজেকের পাহাড় যেমন আকাশচুম্বী ঠিক তেমনি এখানকার খাবারের দামও আকাশচুম্বী ! ভাত-ডাল-সবজি আর ডিম জনপ্রতি ১৫০ টাকা ! সবজি শেষ হয়ে যাওয়ায় ১৫ টাকা বাদ দেওয়া হয়েছে । তাহলে ভাত আর ডালের দাম বাদ দিলে ১টি ডিমের দাম পরছে ১০০ টাকা! আমি নিশ্চিত- মুরগী যদি জানে তার একটি ডিমের মূল্য ১০০ টাকা, সে অবশ্যই গর্ববোধ করবে ।         

    

                                                              হেলিপ্যাডের উপরে

বিকেলে আমি আর সুমন এলাম সাজেকের মূল আকর্ষণ হেলিপ্যাডে ।এখানে ভিড় জমিয়েছেন শত শত পর্যটক । প্রায় ১৮০০ ফুট উপড়ে পাহাড়ের চূড়ায় এই হেলিপ্যাডের অবস্থান । এখান থেকে পুরো সাজেক এলাকাটিতে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যায় । তাই বোধহয় সাজেককে বলা হয় রাঙ্গামাটির ছাঁদ । দূরে তাকিয়ে দেখি আমাদের দিকে উঁকি দিয়ে তাকিয়ে আছে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের লুসাই পাহাড় ।



                                                             
                                                             হেলিপ্যাডের উপরে

আকাশ নীল রঙের চাদর পরিধান করেছে । পাহাড় পরিধান করেছে সবুজ রঙের চাদর । সূর্য বিলিয়ে যাচ্ছে সোনালী কিরণ । সূর্যের কিরণে পাহাড়ের উজ্জ্বলতা আরও বৃদ্ধি পেলো । যেন সবুজে সোনালীতে মিলেমিশে একাকার । পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে নীল আকাশ । তুলোর মত ভেসে বেড়াচ্ছে দলছুট সাদা মেঘের ভেলা । সবুজে সোনালীতে প্রেমময় পাহাড়ের কিছু কিছু স্থানে পরেছে মেঘের ছায়া । এ যেন প্রকৃতির নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের এক অপার লীলাভূমি ! প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্যে মুগ্ধতায় শিহরিত হল মন।এই মুহূর্তটিকে সংরক্ষণ করে রাখার জন্য সবার মত আমরাও কিছু ছবি তুলে নিলাম ।

 

                                                           
                                                                    হেলিপ্যাডের উপরে





গোধূলিলগ্ন । সূর্য রক্তিমরূপ ধারণ করে বিদায়ের পথে ।আমি সুমনকে নিয়ে পাহাড়ী গ্রাম দেখতে যাচ্ছি । পথিমধ্যে সাদান ভাই, লেনিন ভাই, আশিক ভাই ও সারকা দিদির সাথে দেখা হয় । পাহাড়ী গ্রামে এসে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করি । চায়ের তৃষ্ণা মিটিয়ে আবার এসে বসি হেলিপ্যাডে ।সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো ।পর্যটকরা যার যার গ্রুপ নিয়ে মেতে উঠেছে আড্ডায় । কিশোরদের একটি গ্রুপ সম্মিলিত কণ্ঠে গেয়ে চলেছে গান । আমাদের সাথে এসে যোগ দিলেন সজীব ভাই, হাসান ভাই, মাঈনুল ভাই এবং আকাইদ ভাই । একটি গ্রুপ জটলা বেঁধে ফানুস উড়াতে ব্যস্ত । আমিও তাদের সাথে যোগ দিয়ে ফানুস উড়ালাম ।

                                                                     ফানুস বিলাস 

রুইলুই পাড়ায় এসে রাতের খাবার খেয়ে নতুন এক অনুভূতি সৃষ্টি হল । কারণ খাবারের মেন্যুতে অন্যান্য তরকারির সাথে আরও ছিল বাঁশের তরকারি ! হ্যাঁ সত্যি সত্যিই বাঁশ ! সেখানে কচি বাঁশ সবজি হিসেবে রাঁধা হয় ! চায়ে চুমুক দিয়ে শরীর চাঙা করে পুনরায় হেলিপ্যাডে এসে বসলাম । সাথে নিয়ে এলাম চিপস, মোটর ভাঁজা, ডাল ভাঁজা আর মিরিন্ডা ।



                                                              গভীর রাতে চন্দ্র বিলাস 

আজ জ্যোৎস্নার মন ভালো আছে । জ্যোৎস্নার আলোয় আলোকিত সমগ্র সাজেক । পাহাড়গুলো জ্যোৎস্না স্নানে মগ্ন । আকাশে মেলা বসিয়েছে অসংখ্য তাঁরা ।এ যেন এক স্বপ্নরাজ্য ! রাত গভীর হচ্ছে । হেলিপ্যাডে অবস্থান করা নর-নারী সকলেই নিশ্চুপ । সকলেই নীরবে জ্যোৎস্না স্নানে মগ্ন । আমি ঘাসের মেঝেতে শুয়ে জ্যোৎস্না স্নানে মগ্ন । শুনশান নীরবতায় চলছে আমার চন্দ্র বিলাস । সেরে নিচ্ছি আকাশ আর চাঁদের সাথে মৌন কথোপকথন । কতদিনের জমে থাকা কথা । যা সময় সুযোগের অভাবে বলা হয় নি । চিপস খাওয়ার জন্য সুমনের ডাকে হঠাৎ ঘোড় ভাঙলো । সে পাশেই শুয়ে ছিল । চিপস খেতে খেতে চলছে দুই বন্ধু কথোপকথন । এমনই এক কথোপকথন দুই বন্ধুর মধ্যে হয়েছিলো প্রায় ১ যুগ আগে । সেদিনের স্থানটি ছিল চট্টগ্রামের প্যারেড ময়দান । বিষয় ছিল জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ । সুমনের কাছে আমার আবদার ছিল তার নামের আগে ডাক্তার শব্দটি দেখতে চাই । বর্তমানে দু’জনই সামাজিক ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান কিছুটা হলেও অগ্রসর করেছি । সুমন এখন ডাক্তার । আজকের কথোপকথনের স্থান ও বিষয় দুটোই ভিন্ন । আজকের বিষয় ভবিষ্যৎ উন্নতকরণের পরিকল্পনা ।ভোর হতে ঘণ্টা দুয়েক বাকি ।হেলিপ্যাডে অবস্থান করা মানুষের সংখ্যা কমে আসছে । আমরাও রুমে এসে শুয়ে পরলাম ।  

 

ঝড়ের প্রচণ্ড তাণ্ডবে ভোর বেলা ঘুম ভাঙে । টিনের চালে প্রচণ্ড শব্দ । ছিটে পানি এসে পরছে গায়ে । মাঈনুল ভাই ব্যস্ত হয়ে পরেছেন জানলা বন্ধ করা নিয়ে । আমি লেপ মুড়িয়ে শুয়েই রইলাম । ঘণ্টা দুয়েক পর অপূর্ব এক সকালের দেখা পেলাম । মেঘের সাগরে ডুবে আছে পাহাড়গুলো । দূর থেকে মনে হচ্ছে যেন সমুদ্র । কোথাও কোথাও উঁকি মেরে থাকা পাহাড়ের চূড়াগুলোকে মনে হচ্ছে সমুদ্রের বুকে সৃষ্টি হওয়া বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। স্বপ্নীল আবেশে সৃষ্ট এমন সকাল আমার জন্য বাড়তি উপহার । 



                                                               সাজেকের সকাল 



মনাস ত্রিপুরার মা, স্ত্রী ও ছোট বোন আমাদের জন্য সকালের নাস্তা রেডি করলো । ডিম মামলেট, পরটা আর চা । নাস্তা খেতে খেতে তাদের সাথে অনেক গল্প হল ।মনাসদের কটেজটির কোনো নাম রাখা হয় নি, সাইনবোর্ডও নেই । পরিপূর্ণ বাণিজ্যিক কটেজও নয়, সুযোগ পেলে ভাড়া দেয় মাত্র । আমি মনাসকে পরামর্শ দিলাম যেন এটি আরেকটু উন্নত করা হয়, এবং পরিচিতি বৃদ্ধির জন্য বাহিরে একটি সাইনবোর্ড লাগায় ।এতে তাদের পারিবারিক আয় বৃদ্ধি পাবে । মনাস আগ্রহ প্রকাশ করে জানালো শীঘ্রই কাজ শুরু করবে । আমি কটেজটির একটি নাম রাখলাম “স্বপ্ন বিলাস”, মনাস অতি আগ্রহের সহিত নামটি লিখে রাখলো এবং বললো শীঘ্রই সে “স্বপ্ন বিলাস” নামে সাইনবোর্ড বানাবে । প্রিয় পাঠক, আপনারা যারা সাজেক ভ্রমণের কথা ভাবছেন তারা চাইলে পূর্বেই মনাসের কটেজটি বুকিং করে যেতে পারেন । অন্তত ভালো সমাদর পাবেন । যোগাযোগঃ স্বপ্ন বিলাস-০১৮৭৯-৬৯৮২৫৬ ।

 

সকাল ১০ টায় মনাসদের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে আমরা রওনা হলাম । কিন্তু পথিমধ্যে বাধা । ভোরবেলার প্রচণ্ড ঝড়ে পাহাড় ধ্বস হয়েছে । ফলে বেশ কিছু স্থানে রাস্তার উপর মাটি জমাট হয়েআছে এবং বিশাল বিশাল গাছ পরে আছে । রাস্তা চলাচলের উপযোগী করার জন্য সেনাবাহিনী কাজ করছেন । তাই আমাদের বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে । শত শত জীপ সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে । পর্যটকরা সবাই ঘুরাফেরা করছে । সময় কাটানোর জন্য আমরাও রুইলুই পাড়ার বাজারে ঘুরাফেরা করছি, এটাসেটা খাচ্ছি আর ছবি তুলছি । রুইলুই পাড়া বাজারে কফি পান করতে এসে আশ্চর্য হওয়ার মত অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম ! দু’জন উপজাতি তরুণী অবিরত কফি বানিয়ে যাচ্ছেন । দুজনই দেখতে যেমন রূপবতী পোশাকও বেশ স্মার্ট ।সম্ভবত বাংলা বুঝেন না । অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলে যাচ্ছেন ।আমি বেশ অবাক হলাম । তাদের একজনের সাথে কথোপকথনে জানতে পারলাম তার নাম ‘হে লেন এনগুরি’, ইন্ডিয়ার বিখ্যাত মিজুরাম ইউনিভার্সিটি থেকে কেমিস্ট্রিতে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে এখন পিএইচডি’র জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন ! কফি বিক্রি করে পড়ালেখার মাঝে অবসর সময়টুকু কাজে লাগাচ্ছেন । সত্যিই তিনি কতই না সময় সচেতন এবং কর্মঠ ! সাথের অন্যজন তারই ছোট বোন । তাদের বাড়ি সাজেকেই । অল্প সময়ের কথোপকথনে তিনি খুব আন্তরিকতা দেখালেন । নিজ থেকেই আমাকে তার ফেইসবুক আইডি দিলেন ।

 





                                                            এনগুরি 

ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ১২ টা ছুঁইছুঁই । খবর পেলাম রাস্তা ঠিক হতে আরও বেশ সময় লাগবে । আমরা আবার এলাম মনাসের বাসায় । আমি আর সুমন তড়িঘড়ি করে গোসল সেরে হেলিপ্যাড সংলগ্ন মসজিদে আসি জুম্মার নামাজ আদায় করার জন্য । নামাজ আদায় করে দু’জন পাশের রেস্টুরেন্টে আসি দুপুরের খাবার খেতে । খাবারের অর্ডার আগে থেকে দেয়া ছিল না । তাই তারা জানালেন খাবার নেই । ক্ষুধায় তখন পেটের ভিতর বাদ্যযন্ত্রের বাজনা বাজছে । আমিও নাছোড়বান্দা, অনুরোধ করতে করতে বিরক্ত করে একপর্যায়ে খাবার ম্যানেজ করলাম । খাবার খেয়ে আমরা দু’জন তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছি । এরই মধ্যে খবর পেলাম রাস্তা ঠিক হয়েছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই রওনা দিতে হবে।আলহামদুলিল্লাহ্‌, রাস্তা ঠিক হতে দেড়ি হওয়ায় গোসল- নামাজ- খাওয়া দাওয়া সবই ঠিক ভাবে হল ।

ঘড়ির কাঁটা ২ টা ৪৩ এর ঘরে । সাজেককে বিদায় জানিয়ে আমরা রওনা হলাম ।পাহাড়ের গন্ধ, মেঘের সাথে পাহাড় আর রোদ্রের লুকোচুরি খেলা, নীল আকাশের হাতছানি, জ্যোৎস্না স্নানে মগ্নতা ও চাঁদের সাথে কথোপকথন, সব মিলিয়ে সাজেক ভ্রমণটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে ।

 

শফিক সোহাগ

কলামিস্ট-বোস্টন নিউজ, যুক্তরাষ্ট্র

কলামিস্ট- কর্ণফুলী ডট কম, সিডনী, অস্ট্রেলিয়া

E-mail: shafiq_shohag@yahoo.com    

Likes Comments
০ Share