কলকাতার সিনেমাগুলোতে পরিবর্তনের ছাপ দিনকে দিন নজরে আসছে। তাদের গল্প বলার ঢং, অভিনয়ের দক্ষতা সবকিছুতেই প্রশংসা পাচ্ছে। অনেক গল্প তাদের আর্টিস্টিক ভঙ্গির জন্য দর্শকদেরও বিনোদনের খোরাক জোগাচ্ছে। গতবছর মুক্তি পাওয়া সিনেমা গয়নার বাক্স তেমনই একটি ছবি।
হরর কমেডি মুভিকে কীভাবে নতুন মাত্রা যোগ করে আকর্ষণীয় করা যায় তার প্রমাণ গয়নার বাক্স।
তিন প্রজন্ম নিয়ে “গয়নার বাক্স” ছবির পরিচালক অপর্ণা সেন। গল্পের প্রধান উপজ্জীব্য বিষয় ‘গয়না’। সুতরাং বাঙালি সমাজে গয়নার সঙ্গে উঠে আসে নারী। আর তাই তিন প্রজন্মের নারীদের গল্পই বলতে চেয়েছেন অপর্ণা সেন। যদিও ছবিটি জনপ্রিয় সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে।
বাঙালি বিনোদন পছন্দ করেন। তা যেভাবেই তাকে দেয়া হোক। সে নেবে। একটা পক্ষের লোকই শিল্পের আলোচনা-সমালোচনা পড়ে ভাববার অবকাশ পাবেন। কিন্তু বড় একটি জনগোষ্ঠী সিনেমাকে নেবে বিনোদনের খোরাক হিসেবেই। সে খোরাক জোগাতেই সীমানা পেরিয়ে গয়নার বাক্স ছবিটি চলে আসে ঢাকায় ডিভিডি হয়ে। একদিন দেখা হলো গয়নার বাক্স।
গয়নার বাক্স চলচ্চিত্রের গল্পটি কয়েকটি লাইনে শেষ করা মুশকিল। তবুও চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। গল্পের শুরু হয় ‘ব্যাক ভয়েস’ দিয়ে। দর্শকদের কাছে টানার জন্য শেষ প্রজন্ম চৈতালী একটি গয়নার বাক্সের গল্প বলে। গল্প বলে তার পিসিমা রাসমণীকে নিয়ে। তখনই পর্দায় উঠে আসেন মাত্র ১১ বছরের এক কিশোরী। যার সদ্য বিয়ে হয়েছে। গয়নার বাক্সের চকচকে আয়নার তার সুন্দর মুখোশ্রী দেখা যায়।
গয়না পড়ে সে নিজেকে দেখছে সেই চকচকে আয়নায়। কয়েক সেকেন্ডেই সেই গয়নাগুলো ছুড়ে পড়ে গয়নার বাক্সে। পেছনে কান্নার আওয়াজ। কারণ পিসিমা ১২ বছর পার হবার আগেই হয়ে গেলেন বিধবা।
গল্পের শুরু মূলত এখান থেকেই। বিধবা হয়ে ভাইয়ের সংসারে আশ্রয় হয় রাসমণির। তারপর থেকে সে সংসারে রাসমণির দিন কাটতে থাকে নির্জনে একাকী।
এই একাকিত্ব তাকে করে তোলে মেজাজি। তবে সংসারে রাসমণির মূল্য ওই গয়নার বাক্সের জন্যই। তারপর একদিন রাশমণির ভাইপো বিয়ে করে। ভাইপো চন্দনের স্ত্রী সোমলতা ঘরে আসে। বলতে গেলে গল্পের ক্লাইমেক্স তৈরি হয় সেখান থেকে।
এক পর্যায়ে রাসমণির মৃত্যু হয়। তবে মৃত্যুর পর রাসমণির সে-ই আত্মা একমাত্র দেখতে পায় সোমলতা। ছবিতে ঢোকে ভুত।
সোমলতা দিয়ে শুরুতেই গয়নার বাক্স লুকিয়ে ফেলেন রাসমণি। ঘরের সবাই যখন গয়নার বাক্স খুঁজে হয়রান, তখন সোমলতার বিছানার নিচেই রয়েছে যক্ষের ধন। এখন গয়নার বাক্সের পাহাদার রাসমণি এবং সোমলতা। এর মধ্যে অকর্ম স্বামী চন্দনকে গয়না বন্দক রেখে ব্যবসায় লাগায় সোমলতা। তারপর থেকে গল্পের মোড় ঘুরতে শুরু করে। যে পরিবার একসময় কর্জের উপর চলতো, আমরা দেখতে পাই গয়নার বাক্সের কল্যানে তারা ঘুরে দাঁড়াতে থাকে।
এভাবেই গল্প এগিয়ে যায়। একসময় সোমলতার কোলে আসে চৈতালী। তার জন্মের পরই রাসমণির ভুতকে দেখতে পায় না সোমলতা। একমাত্র চৈতালীই দেখতে পায় রাসমণিকে।
গল্প থেকে অনেকটাই হারিয়ে যায় চৈতালী বাবা এবং অন্যান্য চরিত্রগুলো। সেসময় ছবিতে উড়ে এসে জুড়ে বসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য পশ্চিম বঙ্গের তরুণরা নিজেদের বিলিয়ে দেয়। তাদের আর্থিক সহায়তার জন্য রাসমণির বুদ্ধিতে সেই বাক্স চলে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। অন্যদিকে চৈতালী খুঁজে পায় তার মায়ের পুরানো প্রেমিক রফিক কবির কবিতার কাগজ। অপরূপ শব্দ চয়নের কবিতা দিয়ে, প্রেম দিয়ে শেষ হয় গয়নার বাক্স।
গল্পের ভেতর অবশ্যই স্বাদ আছে। অকপটে বলে দেয়া যেতে পারে, এই চলচ্চিত্র মার্জিত মধ্যবিত্তের ছবি।
এবার আসা যাক আলোচনায়। এ ছবিতে নারীকে প্রগতিশীল করে গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা ছিল পরিচালক অপর্ণা সেনের। সেটা রাশমণি হোক কিংবা সোমলতা কিংবা চৈতালি।
প্রথমেই নারীদের চিত্রায়নের কথাই আলোচনায় নিয়ে আসা যাক। নারীকে এক অন্যরকম সংগ্রামী অবয়ব দেয়া হয়েছে গয়নার বাক্স চলচ্চিত্রে।
এককালে নারীর হাতিয়ার ছিল গয়না কিংবা অলঙ্কার। সেটিকে বাক্সে লুকিয়ে রাখাটাই হয়তো চলন ছিল। তারপরের প্রজন্ম একটু আগ বাড়িয়ে চিন্তা করলো।
সোমলতা চিন্তা করলো এই গয়না দিয়ে ব্যবসাও করা যায়। তবে বিক্রি করে নয়, এটিকে বন্দক করে কিছু অর্থ জোগাড় করে কর্মসংস্থানেরও সন্ধান করা যায়।
এরপর তৃতীয় প্রজন্ম প্রগতিশীল। তাদের কাছে এসব রীতি নীতির বালাই নাই। তাদের কাছে চেতনা, মুক্তবুদ্ধি, স্বাধীনতার মূল্য অনেক বেশি। এ জন্য রীতি-নীতিকে তারা বুড়ো আঙ্গুল দেখাতে জানে। এজন্য বিক্রিও করে দিতে পারে মূল্যবান অনেক কিছু।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের পথচলা ছবিতে মন্দ লাগবে না। তবে অনেক জটিল বিষয়ের প্রশ্ন সবার সামনে আসতেই পারে। যেমন, চৈতালীকে দেখা যায় ভেসপা চালিয়ে কলেজে যেতে। সময়কালটা দেখানো হয় ১৯৭১। সেসময় পশ্চিমবঙ্গের নারীরা কি ভেসপা চালাতো? এবিষয় আমার জ্ঞানের কিঞ্চিৎ কম। জানা নেই, তাই আলোচনা করা দূরহ হয়ে গেল।
শুধু তাই নয়, প্রগতিশীলতা মানে কি মেয়েদের হাতে সিগারেট? কারণ প্রগতিশীল দেখাতে গিয়ে অপর্ণা সেন সিগারেট তুলে দিলেন চৈতালীর হাতে।
চৈতালীর সিগারেট খাওয়ার দৃশ্যটি ছিল চমৎকার। পাশাপাশি দুটি প্রজন্ম। রাসমণি টানছে হুক্কা। অন্যদিকে চৈতালী ধরিয়েছে সিগারেট। এই শটটি অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য।
কিন্তু রয়ে যায় সেই প্রশ্ন। হুক্কার পর বাঙলার নারী সমাজে সিগারেট প্রবেশ করেছে কবে?
মনে হয়েছে অপর্ণা সেন প্রগতিশীলতার অর্থ ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি। বই পড়া, পত্রিকা পড়া, ভেসপা চালানো এবং সিগারেটে ঠোঁট লাগানোকেই তিনি বুঝাতে চেয়েছেন নারীরা এগিয়ে গেছে।
এবার আসি চৈতালী এবং রাসমণির মাঝামাঝি। অর্থাৎ সোমলতার কাছে। পুরো ছবিতে এই একটি চরিত্রই মুগ্ধ করবে দর্শকদের। একজন বাঙালি নারীর সবগুলো গুণই তার মধ্যেই ফুটে উঠেছে।
যেই অপূর্ণতা আমরা রাসমণি এবং চৈতালীর মধ্যে পেয়েছি, ঠিক উল্টোভাবে সোমলতা পেয়েছে পূর্ণতা। এর অন্য কারণও হতে পারে। ছবিটির অধিকাংশ জুড়েই রয়েছে সোমলতা। এজন্যই হয়তো তাকে খুব যত্ন করে বিশ্লেষণ করতে পেরেছেন পরিচালক।
যার কথাবর্তা, চালচলন, শাড়ি পড়ার ঢং সবকিছুতেই ছিল নারীর সৌন্দর্য। যদিও স্বামীর পাশাপাশি এক অন্য পুরুষকে অবচেতন মনে কিংবা রাসমণির প্রলোভনে ভালোবেসে ফেলেছিল। কিন্তু পরমুহূর্তেই সেই প্রলোভনকে দুরে ঠেলে দিয়ে স্বামী চন্দনের বুকে গিয়ে আশ্রয় নেই।
বোঝা যায়- নারীর হৃদয়ে সবচেয়ে উপরে রয়েছে তার স্বামী। তার বিশ্বাসে চেতনায় একমাত্র স্বামীকেই ধারণ করতে চায় বাঙালি নারী। নারী এগিয়ে যাবে তার আপন যোগ্যতায়। সোমলতাকে দিয়ে সেটিই প্রমাণ করতে পেরেছেন পরিচালক অপর্ণা সেন।
যেমন, ছবিতে এক জায়গায় তার স্বামীকে সে প্রশ্ন করে বসে, আমার ভাত কাপড় কে দেন? উত্তরে স্বামী চন্দন বলে, আমাদের বংশের পোলারা কখনও পরের গোলামী করে না। আমরা হইলাম জমিদার।
এই স্বামীকেই আমুলে বদলে ফেলেন সোমলতা একাই। অকর্মা স্বামীকে সে দাঁড়া করিয়ে তোলে। এ ছিল তার আপন দক্ষতা।
রাসমণি চরিত্রকে বরাবরই খিটখিটে মনে হবে। কিন্তু তার ভেতরও আছে দুঃখ-বেদনার গল্প। অনেক চাহিদাকে পেছনে ফেলে মাত্র ১২ পেরোনো আগেই বিধবা রাসমণি পুরো গল্পেই ছিল অসাধারণ ভূমিকায়।
এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন মৌসুমী চ্যাটার্জি। তার অসাধারণ গুণে ফুটিয়ে তুলেছেন রাসমণি চরিত্রটিকে। তার ব্যঙ্গ বিদ্রুপতার মধ্যে থাকে দুঃখ ও অনেক না পাওয়ার সংলাপ।
একটি ঘরে গয়নার বাক্সকে নিয়েই যার জীবন পার হয়ে গেছে। মৃত্যুর পরও তার প্রতি পরম মমতা আর ভালোবাসা ছাড়তে পারেনি। কিন্তু এই খিটখিটে মেজাজি রাসমণিকেও আমরা কাঁদতে দেখি। যখন সে জানতে পারে তার গয়না বন্দক রেখে সোমলতা আর চন্দন একটি শাড়ির দোকান দিয়েছে। আর সেই দোকানের নাম রাসমণি।
যৌনতার শুড়শুড়ি:
ছবিতে যৌনতাকে খুব ভালো মতই আশ্রয় দিয়েছেন পরিচালক অপর্ণা সেন। তবে মনে হয়েছে তিনি দ্বিধাদ্বন্দে ছিলেন। ঠিক কোন অবস্থান নেবেন তিনি? এমন প্রশ্নে খেই হারিয়েছেন ভালোমতই। তিনি ১১ বছরের এক নারীর পশ্চাতদেশ দেখাতে একটুও লজ্জা পাননি। অথচ প্রতিটি চুম্বনের দৃশ্যে তিনি ক্যামেরা ধরেছেন পেছন দিকে। এত লজ্জা কেন পরিচালকের? প্রগতিশীলতার জন্য যে সিগারেট, যে ভেসপা সেখানে চুম্বনে কেন অপর্ণার লজ্জা? এ প্রশ্ন পুরো সিনেমাতেই থেকে যায়।
ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও একটু শুড়শুড়ি দেয়া হয়েছে মাঝে মাঝে। পুরুষের চরম যৌন সুখানুভূতিও দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন, সূর্য ওঠার কিছু আগে যখন সোমলতা পুকুরপাড়ে যায়, তখন রাসমণিকে দেখা যায় পুকুরের পানিতে। সেখানে ছায়া হয়ে আসে। আর সোমলতাকে প্রশ্ন করে,
…রাইতে বলদটার লগে যা করস? …১১ বছরের বিয়া, ১২ না পড়তেই বিধবা। …ক না কেমন লাগে?
সোমলতা লজ্জায় মিনমিন করে উত্তরে বলে, ভালো।
রাসমণি তখন উত্তেজিত হয়ে বলে, মর মাগি। ভালো যে হেইডা হগ্গলেই জানে। কেমন ভালো একটু ভাইঙ্গা ক না!
এ ডায়লগ ব্যবহার করেও দর্শককে যৌন শুড়শুড়ির বন্দোবস্তো করেছেন পরিচালক। দর্শক নির্ঘাত অপেক্ষা করেছেন সোমলতার মুখে রাইতের কামের স্বাদ শোনার।
অন্যদিকে রফিক কবির সঙ্গে এক গোপন প্রনয় তৈরি হয় সোমলতার। এ ঘটনাতেও দর্শক অপেক্ষা করবে কখন রফিক কবির উপর ঝাপিয়ে পড়বে সোমলতা। দর্শকের যৌন আকাঙ্খায় পানি ঢেলে দিবে পরিচালক।
ছবিতে বেশ কয়েকটি চুম্বনের দৃশ্য আছে। দৃশ্য আছে চাদরের মোড়ানো সোমলতা আর স্বামীর।
পুরো ছবি জুড়ে রয়েছে রাসমণির যৌন আকাঙ্খা। তার সব যৌন অপ্রাপ্তি সে পূরণ করাতে চায় সোমলতাকে দিয়ে।
এজন্যই রফিক কবির প্রেমে হাবুডুবু খাওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করে তাকে। তার সঙ্গে শরীর বিলিয়ে দিতেও উৎসাহিত করে। তবে রফিক কবির তীব্র প্রেম দর্শকের হৃদয় ছুয়ে যাবে। প্রতিদিন ঘরের দরজায় গোলাপ ফুল রেখে যাওয়ার দৃশ্য হৃদয় কেড়ে নেবে সবার। প্রেমের তীব্র অনুভূতিতে একাকার হয়ে যাবে দর্শক। যখন রফিক কবির ফুলকে মেনে নিতে দৌড়ে যাবে সোমলতা। সেই দৃশ্য।
রফিক কবি দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। এক হাতে লণ্ঠন, অন্য হাতে গোলাপ। ছাদে দাঁড়িয়ে সোমলতা। কি এক অপার দৃষ্টি বিনিময় হয় রফিক কবি এবং সোমলতার। বিশেষ করে সোমলতার পুরো শরীর মন জুড়ে যেন গোলাপ হাতে পুরুষটি জায়গা করে নিয়েছে। সোমলতার ঠোঁটের প্রকাশভঙ্গি চমৎকার। প্রেমের তীব্রতাকে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টায় সোমলতা। কিন্তু শৃঙ্খল ভেঙে রাসমণি বলে উঠলেন, যা, ওরে ফিরায়া দিস না।
কথাটি শুনে একমুহূর্ত দেরি করেনি সোমলতা। সে দৌড়ে গেছে। এ সময়ের যে দৃশ্যায়ন তার জন্য পরিচালক দর্শকের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন অনেকদিন। শটটি ভুলতে পারবে না দর্শক।
দরজার দিকে ছুটে চলছে সোমলতা। সমাজ সংসারের দেয়াল ভেঙে দেয়ার যে পথ অনেক বড়। ছাদ পেরিয়ে, বারান্দা পেরিয়ে, উঠান পেরিয়ে দৌড়ে গেছে সোমলতা। দরজা খুলতেই রফিক কবি নেই। শুধু রয়ে গেছে একটি গোলাপ ফুল।
যে ফুলে লেপটে আছে প্রেম, ভালোবাসা। যে প্রেম নারী চায়, যে আবেগ নারী চায়, নারীর মন কামনা করে অসম্ভব প্রেমের তীব্রতা। যে তীব্রতায় সে নিজেকে বিলীন করে দিতে এক মুহূর্ত দ্বিধাবোধ করবে না। এই সোমলতা চরিত্রে দুর্দান্ত ও পরিপক্ক অভিনয় করেছেন কঙ্কণা সেনশর্মা।
যাইহোক, কথা হচ্ছিল রাসমণিকে নিয়ে। বলছিলাম তার অপূর্ণতার কথা। যে যৌন অনুভূতি সে পায়নি। সেই অনুভূতিকে সে সোমলতার মধ্য দিয়ে পেতে চেয়েছে। এজন্য সে ব্যর্থ হয়েছে বারবার।
রাসমণির সংলাপেও ছিল সমাজের প্রতি কটু-উক্তি। যা সত্য। যা সমাজ লুকিয়ে কানে ফিসফিস করে বলতে চায়। সে কথা রাসমণি সরাসরি বলে দেয় সোমলতাকে।
প্রেমে সাড়া দেয়ার জন্য সোমলতাকে বিভিন্নভাবে প্রলুব্ধ করে। যেমন কয়েকটি সংলাপ ছিল,
কি হবে সতী থেকে কিংবা ‘ভালবাসা তো দোষের কিছু না, মনের ওপর তো আর জোর চলে না গো’ কিংবা ‘যৌবন জীবনে একবারই আসে, সময় থাকতে কিছু করে নে’ কিংবা ‘পুরুষ মানুষের রক্ষিতা থাকতে পারলে মেয়েমানুষের কেন থাকতে পারবে না গো, আমাদের কি সাধ আল্লাদ নেই?
বিধবা হওয়ার পর ঘরের এক কাজের লোকের সঙ্গে রাসমণি সেই অনুভূতি পেতে চায়। ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে পৌঁছাতে পারেনি রাসমণির কাছে। রাসমণি চিরকাল এই আকাঙ্খার জন্য নিজেকে নিঃস্ব ভেবেছেন।
এভাবেই উঠে আসে মানুষের জীবনে জৈবিক চাহিদায় যৌনতা অন্যতম উপাদান। এটি ছাড়া মানুষ নিঃসঙ্গ, একাকি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ:
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অনেকটাই উড়ে এসে জুড়ে বসা মনে হবে এমন হরর কমেডি ছবিতে। প্রশ্ন হলো, কেন মুক্তিযুদ্ধ? খ- খ- ভাবে কয়েকটি চিত্র তুলে ধরেছেন পরিচালক অপর্ণা সেন। যার মধ্যে অনেকগুলো ছিল আপত্তিকর।
মেনে নিলাম দেশভাগের পর অনেকে ওপার বাঙলায় গিয়েও বাংলাদেশকে নিজেদের দেশ ভাবতো। তারা হয়ত যুদ্ধও করেছে।
কিন্তু যেই প্রশ্নটি সামনে আসে তা হলো মুক্তিযুদ্ধ তুলে ধরার ক্ষেত্রে অপর্ণা সেন মোটেও পরিপক্কতা দেখাননি। এমনকি সন্দেহ জেগেছে বাংলাদেশের স্বাধীকার আন্দোলনের ইতিহাস তিনি কতটুকু জানেন?
বঙ্গবন্ধুকে দেখানো হয়, একটি রুমের থাকা ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে। এই শটটির বিশ্লেষণ না থাকলেও বলা যেতে পারে বঙ্গবন্ধুর অবদান তিনি জানেন। একটি জাতির জনককে তিনি তুলে ধরতে ভুলে যাননি। এজন্য তাকে ধন্যবাদ দিতেই হয়।
ছবিতে দেখানো হয় রাশমণির ভুত যায় বাংলাদেশের ফরিদপুরে। তাদের পুরানো ভিটাবাড়িতে। পাকিস্তানী সেনাদের ক্যাম্পের কথা বলা হয়।
এই শটে যেসব চিত্র দেখানো হয় তা সত্যিই অমুলূক। শুধু অমুলূক নয়, হাস্যকর। দেখানো হয়, পাকি সেনারা সেখানে ব্যায়াম করছে, তাস পেটাচ্ছে, রান্না করছে। পাকিস্তানী ক্যাম্পের যে বর্বরতা কিংবা হিংস্রতা তার কোনোটিই ফুটে উঠেনি এই শটে। ছবিতে মন মতো পরিচালক সব কিছুই করতে পারবেন বটে। কিন্তু ইতিহাস বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অসাবধানী হলে পরিচালকের পরিপক্কতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হবেই। এমনই প্রশ্ন তৈরি হতে একশভাগ সহযোগিতা করেছেন অপর্ণা সেন।
এমনকি চৈতালী বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বলেন, এরা মুক্তিযুদ্ধটা আর বেশিদিন চালাতে পারবে না বোধহয় পিসি ঠাকুমা।
এ সংক্রান্ত কারণ দেখানো হয়, সম্বল বড় কম। মুক্তিযোদ্ধারা শুধু মরছে খান সেনাদের হাতে। ডাক্তার নেই, আর্মস নেই, ওষুধ নেই। এই তো সেদিন। চোখের সামনে একটা ছেলে মরে গেল বিনা চিকিৎসায়।
মুক্তিযোদ্ধাদের সম্বলহীন বলেই সেই গয়নার বাক্সের কথা উঠে আসে। ৫০০ ভরির উপরের সোনা আছে সেই বাক্সে। রাসমণি বুদ্ধি দেয় সেই বাক্স মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে দেয়ার।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধাদের সহযোগিতায় করেছেন ভারতীয়রা সে বিষয়ে কারও কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু নিজের দেশের জন্য যে মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ দিয়েছেন। বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের জীবনকে। তাদের কোনোভাবেই সম্বলহীন বলা চলে না। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধারা মরছে খান সেনাদের হাতে। এমন সংলাপও আশা করা যায় না। মুক্তিযোদ্ধারা শুধু মরেই যাচ্ছে। মারছে না। প্রতিটি সংলাপের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসীকতার কোনো চিহ্ন ছিল না। বরং ছিল, তাদের সহযোগিতাতেই চলছে যুদ্ধ। এমন আস্পর্ধা অপর্ণা সেন দেখাতে পারেন না।
গয়নার বাক্স নিয়ে আরও বেশি আলোচনা হওয়ার দরকার ছিল। কারণ আলোচনার মতো অনেক উপাদান আছে এই চলচ্চিত্রে। আমার এ আলোচনায় বাদ পড়ে গেছে পুরুষদের অবস্থান, ব্যবসায়ীক প্রবৃদ্ধি কি করে সম্ভব এ সব বিষয়ে। আপাতত এখানেই ইতি টানতে হয়। ভবিষ্যতে সুযোগ হলে আরও আলোচনা করা যেতে পারে। যাওয়ার আগে বলে নেয়া ভালো, ছবিটির চিত্রনাট্য ও পরিচালনা করেছেন অপর্ণা সেন, প্রযোজনা : শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস।
কাহিনী তো শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস থেকে নেয়া। অসাধারণ সংগীত দিয়েছেন দেবজ্যোতি মিশ্র।
দুর্দান্ত অভিনয়ের কথা আলোচনাতেই বলেছি। রাসমণির ভূমিকায় ছিলেন মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়; সোমলতার ভূমিকায় কঙ্কণা সেনশর্মা; চৈতালীর চরিত্রে শ্রাবন্তী; সোমলতার স্বামী চন্দনের ভূমিকায় ছিল শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। এছাড়া অন্যান্য চরিত্রে ছিলেন কৌশিক সেন, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানসী সিংহ, অপরাজিতা প্রমুখ।
Comments (4)
হ্যা দাদা
ব্যস্তবতা এটাই
মাতৃভাষার প্রাণঢালা শুভেচ্ছা--