Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

আহসান কবির

৬ বছর আগে লিখেছেন

রক্তের দাগ

প্রিয় দীপন,

হয়তো সত্য কথাই লিখেছেন তিনি। নাজিম হিকমতের ভাষাতেই বলা যায় তোর মৃত্যুর পর আরও একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করেছে পৃথিবী। পৃথিবীটা যেমন ছিল হয়তো তেমনই আছে, শুধু প্রিয় কিছু মানুষের স্মৃতির ডায়েরিতে ছাড়া আর কোথাও তুই নেই দীপন! তোর বাবা আবুল কাশেম ফজলুল হক স্যার পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বেদনার জায়গাতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন- আমি এই হত্যার (দীপন হত্যার) বিচার চাই না। আইনের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে কিন্তু বিশ্বাস কমে গেছে! স্যারের আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে। বছর ঘুরলেও তোর হত্যাকারীরা রয়ে গেছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে!

স্মৃতির ডায়েরিটা খুললে তোর সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার স্মৃতিটা খুব বেশি মনে পড়ে!
নৌ বাহিনীর চাকরি হারানো এই আমি টিউশনি আর রাতভর গাড়ি চালানোর টাকা দিয়ে শাহবাগ আজিজ মার্কেটের তিনতলায় একটা দোকান ভাড়া নিয়েছিলাম। পুরোনো তিনটে চেয়ার ( আমার অফিস ছিল তিনতলার ৪৮ নম্বর রুমে । উপদ্রব মনে করে আগের ভাড়াটে চেয়ার তিনটে নিয়ে যায়নি) রেখে দিয়েছিলাম তিনতলার এক কোনে। একদিন বিকেলে দেখলাম সেখানে পনের বিশ জন ছেলে এসেছে। তারা চেয়ার তিনটে দড়ি দিয়ে সুন্দর করে তিনতলার রেলিং এর সাথে বাধলো। আমি জানতে চাইলে ইংরেজদের মতো দেখতে টকটকে ফর্সা একটা ছেলে বললো- মুদি বা রাস্তার দোকানে সিগারেট কিনতে যাবেন দেখবেন ম্যাচটা সুতা দিয়ে বান্ধা। কোনও কোনও দোকানে কলমও বাইন্ধা রাখা হয় যেন কেউ নিজের মনে কইরা নিয়া যাইতে না পারে। চেয়ারগুলা আমরা বুকিং দিয়া গেলাম। এখানে এখন থেকে আড্ডা আর কনসার্ট হবে!

টকটকে ফর্সা এই স্মার্ট ছেলেটার নাম দীপন। বন্ধুরা তাকে ফরেনার বলেই ডাকতো! আজিজের তিনতলার কোনায় দীপনদের আড্ডাটা ক্রমশ জমে উঠলো। উদয়ন স্কুল আর ঢাকা কলেজ থেকে পাস করা পনের বিশ জন ছেলে নিয়মিত আড্ডা দিতে আসতো এখানে। বিপ্লব, জাহিদ, পথিক নবী আর সোহেল আমিনরা এই আড্ডাতে এসে গান গাইতো! বই আর গান ছাড়া দীপনের আর কিছুতে আসক্তি ছিল না। কোনও আড্ডাতেই মানুষেরা চিরস্থায়ী না হলেও দীপন আর তার বন্ধুরা আজিজেই থেকে গেল।

অর্থনীতি থেকে পাস করে বাবা-মা কিংবা বোনের মতো দীপন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারতো। হতে পারতো কোন বড় চাকরিজীবী। তাকে যে নামে ক্ষেপানো হতো সেই ফরেনেও যেত পারতো দীপন। বইয়ের প্রতি ভালোবাসা তাকে নিয়ে গেল মরণের দিকে।
আজিজ মার্কেটের এই আড্ডাটা বছরে একবার চলে যেত বইমেলাতে। দীপনের সঙ্গে পনের বিশ জনের দলটাও চলে যেত মেলায়। বইমেলা যখন বারোয়ারি ছিল, যখন মেলাতে দা খুন্তি আর মুড়ি মুড়কি পাওয়া যেত, গান ও কবিতার ক্যাসেট শব্দ করে বাজানো হতো সেই সময়ে দীপন ও তার বন্ধুরা মেলাতে স্টল নিয়ে আড্ডাবাজিটা জমিয়ে রাখতো। লোকায়ত নামের সাহিত্য পত্রিকা যেটার সম্পাদক ছিলেন দীপনের বাবা আবুল কাশেম ফজলুল হক স্যার, সেই লোকায়তের নামেই স্টল নেওয়া হতো। স্টলে বই কিনতে গেলে বোঝা যেত না কে মালিক আর কে কর্মচারি। স্টলের ওপরে থাকতো বইয়ের পসরা, নিচে লুকিয়ে সিগারেটও খাওয়া যেত! এরপর সিগারেট খাওয়ার জায়গাটা দখল করেছিল প্রেম। মাথার ওপরে বই, সামনে মানুষের পা, এর মাঝে হাত ধরাধরি করা লুকোনো প্রেম!

বারোয়ারি বই মেলার এই সময়টাতে বিশ ফেব্রুয়ারি সারারাত এবং পরদিন একুশ ফেব্রয়ারিতে বইমেলা চালু থাকতো। বিশ ফেব্রুয়ারির গভীর এক রাতে মেলায় যখন জমজমাট মানুষ তখন লোকায়ত স্টলের আড্ডাবাজদের মনে পড়লো তাদের খাওয়া হয়নি। স্টল বন্ধ করে চানখার পুলে এসে দেখা গেল হোটেল বন্ধ। এরপর নীরব হোটেলে যেয়ে খাবার পাওয়া গেল কিন্তু ভেতরে ঢোকার অনুমতি মিললো না। কী আর করা?

শেষরাতে রাস্তার ওপরই বসে পড়লো সবাই। মাথা গুনে দেখা গেল তেইশ জন! হোটেল নীরবের কর্মচারি চিৎকার করে মেন্যু ঘোষণা করলো- ওই ছিচল্লিশ পরাটা আর তেইশ সিঙ্গেল ব্রেইন (গরু বা খাসির মগজ)!

ততদিনে বন্ধুদের আড্ডা থেকে পালাতে শিখেছে দীপন। তবে খুব বেশিদিন পালিয়ে থাকতে পারেনি। যার জন্য আড্ডা থেকে পালাতো তাকেই নিয়ে এসেছিল আড্ডায়, ওর নিজেরও জীবনে। মানুষটার নাম রাজিয়া জলি। কখনোই জলির পক্ষে ভোলা সম্ভব না বিশ ফেব্রুয়ারির সেই রাতভর আড্ডা। অথবা আজিজ মার্কেটের সামনে দিনভর আড্ডার সময় মনে হলো বরিশালের ডাব আর ইলিশ মাছ অন্যরকম। খাওয়া চাই-ই-চাই। দুই ঘণ্টার নোটিশে লঞ্চের সাতটা কেবিন ভাড়া করা। বৌদ্ধ পূর্ণিমার মনকাড়া জোসনায় সারারাত লঞ্চের ডেকে বসে গান গেয়ে কাটিয়ে দেওয়া। বরিশালে গিয়ে ইলিশ আর ডাব খেয়ে পরদিন ফিরে আসা। হায় সেই সব দিন।

অথবা বিয়ের পর একদিন। জলিকে খুব দেখতে ইচ্ছে হলো দীপনের। জলি তখন বাজিতপুরে। সারাদেশে বৃষ্টির ধুম লেগেছে। ওলি আর দীপন ঢাকা থেকে মোটর সাইকেল নিয়ে রওনা হয়ে গেল! ভোরে জলি দরজা খুলে দেখলো বৃষ্টি আর ঠাণ্ডা মাথায় নিয়ে কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দীপন আর ওলি!

দীপন যখন তার স্বপ্নের জগৎ প্রকাশনী ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে তখন সেটার নাম রেখে দিয়েছিলেন আবুল কাশেম ফজলুল হক স্যার- জাগৃতি প্রকাশনী। হয়তো তখন থেকেই শুরু হয়েছিল তার শেষ দিনগুলোর যাপন যা আমরা বুঝতে পারিনি, বুঝেছিল দীপন নিজেই! তার স্ত্রী ডা. রাজিয়া জলিকে দীপন যতগুলো বই উপহার দিয়েছে তাতে একটি মাত্র কবিতাই লেখা থাকতো! জীবনানন্দের বিখ্যাত সেই কবিতা- অদ্ভুত আধার এক এসেছে পৃথিবীতে আজ/অন্ধ যারা আজকাল সবচেয়ে বেশি দেখে...
জলি তার কাছে অসংখ্যবার জানতে চেয়েছে শুধু এই কবিতাটাই দীপন কেন লেখে? দীপন সেই প্রশ্নের উত্তর দীপন দিয়েছে এভাবে -জীবনানন্দ আমার সবচেয়ে প্রিয় কবি। সবচেয়ে ভালো লাগে তার এই কবিতাটি। আর আমি বাঁচব মাত্র চল্লিশ বছর। জলি তুমি যদি আমার সঙ্গে পথ চলতে চাও তাহলে এটা মেনে নিয়েই আমার কাছে আসতে হবে!

দীপনের কথাকে স্রেফ ইয়ার্কি ভেবেই তার সাথে ঘর বেধেছিল রাজিয়া জলি। দীপনের একচল্লিশতম জন্মদিনের দিন জলি জানতে চেয়েছিল চল্লিশের পরে আরও এক বছর গেছে! এখন কী বলবে? দীপনের উত্তর ছিল- এটা বোনাস লাইফ! দেখ কয় দিন থাকে!

মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সেই চাপাতির নিচে জীবন দিতে বাধ্য হয়েছে দীপন। জানি না দীপন যেখানে গেছে সেখানে আমাদের জাগ্রত চেতনার আজিজ মার্কেট আছে কিনা! সেখানে কি প্রতি বছর শীত চলে গেলে বসন্ত আসে? শাহবাগ কিংবা ঢাকা ভার্সিটির মতো তারুণ্যের মেলা জমে? প্রতি বছর বইমেলা হয়?

নাকি এটাই সত্য যে, অদ্ভুত আঁধারে ঘেরা এই দেশটা কোথায় যেন চলে যাচ্ছে। দীপনের মতো যারা দেশকে ভালোবাসতো, যারা সব কিছু বিসর্জন দিয়ে শিল্প আর সৃষ্টিশীলতা নিয়ে মেতে থাকতো, শেয়াল আর শকুনের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।

ধর্মের নামে যারা ওকে হত্যা করেছে বাংলার কোনও মা তাদের জন্ম দিতে পারে এটা আমি বিশ্বাস করি না। যারা ওকে হত্যা করেছে তারা যদি ওর কম্পিউটারের হার্ড ডিস্কটা নিয়ে যেত তাহলে পেত হাজার খানেক গান আর নতুন পুরোনো অনেক লেখকের সৃষ্টির পশরা। যারা ওকে হত্যা করেছে তারা যদি ওর হৃদয়টা নিয়ে যেত তাহলে দেখতো বুকে ওর অপরাজেয় বাংলার অহংকার!

খুব বেশিদূরে কখনও যেতে চায়নি দীপন। জন্মেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। খুব ছোটকালে ছয় নম্বর নীলক্ষেত এলাকা (আবুল কাশেম ফজলুল হক স্যারের বাসা) থেকে হেঁটে হেঁটেই যেত উদয়ন স্কুলে। স্কুল জীবন শেষে নিউমার্কেট পেরিয়ে ঢাকা কলেজ।
এরপর আবারও ফিরে আসা সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অর্থনীতিতে মাস্টার্স শেষ করে সে এসেছিল তার জন্মস্থান, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে কাছের এলাকা আজিজ মার্কেটেই। মরে যাওয়ার পরেও দীপন খুব বেশিদূরে যেতে পারেনি। আমরা তাকে শুইয়ে রেখে এসেছি আজিমপুরে!

বিশেষ দ্রষ্টব্য: আইন শৃংখলা বাহিনী দীপনের হত্যাকারী সন্দেহে ছয়জনকে চিহ্নিত করে তাদেরকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। এই ছয়জনের ভেতর দুইলাখ টাকা দামী আসামি সিফাতকে টঙ্গি থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এক বছরের অগ্রগতি এইটুকুই!

আজিজ মার্কেটের তিনতলায় যে রুমে দীপনকে হত্যা করা হয়েছিল সেই রুমের দেয়ালে আর সিলিংয়ে এখনও রক্তের দাগ লেগে আছে। দীপনের বন্ধু ওলি সেই রুমটা ভাড়া নিয়ে একইভাবে রেখে দিয়েছে। ওলির আশা দীপনের সব হত্যাকারীরা একদিন গ্রেফতার হবে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে। সে তখন গর্ব করে বলতে পারবে রক্তের দাগ শুকানোর আগেই দীপন হত্যার বিচার হয়েছে!

জানি না ওলিকে আর কতদিন এই রক্তের দাগ পাহারা দিতে হবে!
Likes Comments
০ Share