Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

আহসান কবির

৬ বছর আগে লিখেছেন

নিঃসঙ্গ নন হ‌ুমায়ূন

তৃষ্ণা পেয়েছে।টেবিলে পানি ভর্তি জগ। ইচ্ছে হয় না বিছানা থেকে নেমে গ্লাশে ঢেলে খাই। বাইরে অপার জোসনা। জানালা খুলে দিলে অপার জোসনায় ভেসে যাবে ঘরটা।ইচ্ছে হয়না জানালাটা খুলি।দুঃখ হয় তাদের জন্য যাদের সঙ্গ আজ আমায় নিঃসঙ্গ করে দেয়! .................... হ‌ুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ কী নিঃসঙ্গ ছিলেন?তার জীবন যাপনে কিংবা লেখালেখিতে? সম্ভবত এই প্রশ্নটা অমিমাংসিতই থেকে যাবে। তবে কেউ যদি জানতে চায় প্রয়ানের পরে হ‌ুমায়ূন এখন কেমন আছেন,সাহিত্যের কোথায় আছেন বা থাকবেন তাহলে এই প্রশ্নের উত্তরও কী অমিমাংসিত থাকবে? নাকি সেটা মহাকালই নির্নয় করবে?

মানুষ যদি নিঃসঙ্গ হয়ে যায় তবে সেটা কবরে যাবার আগে নয়! হ‌ুমায়ূন আহমেদের এই কথার সূত্র ধরে আবারো বলা যায় হ‌ুমায়ূন কী নিঃসঙ্গ ছিলেন নাকি এখন চির নিঃসঙ্গতা তাকে গ্রাস করেছে? জীবন যাপনে রাজকীয় ভাব ছিল তার। রাজারা একাকী জীবন যাপন করতে পারেন না।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেবার পরে সেই অল্প আয়ের জীবনে শ্যামলীর বাসা থেকে হেটে হেটে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার বিবরন তার একাধিক লেখাতে আছে। সেই সময়টাতে কী তিনি একা থাকতেন?নাকি মধ্যবিত্ত জীবনের সাথে স্বপ্ন সংযোগের ব্যাপারটা তার সাথে তখন হেটে যেত সমান্তরাল? একা একা হাটার এই ব্যাপারটা জীবনানন্দের জীবনে কতোটা ছিল পুরোপুরি জানা না গেলেও তার কবিতায় আছে-হাজার বছর ধরে আমি পথ হাটিতেছি পৃথিবীর পথে! পৃথিবীর পথে কী কেউ একা থাকে? রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দে প্রভাবিত ছিলেন হ‌ুমায়ূন। তার বইয়ের নামগুলো থেকেই সেটা অনুমেয়। যেমন-যখন গিয়াছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ কিংবা মেঘ বলেছে যাব যাব। অবশ্য তার একটা লেখাতে আছে- মানুষ যখন একা থাকে তখন আসলে সে একা থাকেনা। সবার কথা ভাবে,সবাইকে নিয়ে থাকে।কিন্তু অনেকের ভীড়ে সেই মানুষটা যখন থাকে তখন যতো মানুষই আশে পাশে থাকুক আসলে সে একাই থাকে!
একাকী মানুষের অনুপ্রেরণাও ছিল তার জীবন যাপনে। একজন আহমেদ ছফা কিংবা আহমদ শরীফ লিখেছিলেন তার উপন্যাস নিয়ে। হ‌ুমায়ূন আহমেদ নিজেই লিখেছেন যে তিনি দেখা করতে গিয়েছিলেন জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সাথে। যেয়ে দেখেন রাজ্জাক স্যার বিছানায় মশারী বন্দী হয়ে তার( হ‌ুমায়ূন ) বই হ ুমায়ূনেরপড়ছেন! আহমদ ছফা কিংবা আব্দুর রাজ্জাক কিন্তু জীবন যাপনে একাকী ছিলেন। হ ুমায়ূন সেটা ছিলেন না। তবুও হৃদয়ের বড় একটা অংশ কী সব সময়ে একা থাকে? সে কারণেই কী আবুল হাসান লিখতে পারেন-মানুষ মূলত একা!

সাহিত্যের মানুষদের কাছে হ‌ুমায়ূন এখন কীভাবে আছেন? ভক্তদের হৃদয়ে কী ভাবে আছেন? সাহিত্যে তার অবস্থান কেমন? যখন বেচে ছিলেন সাহিত্যের মানুষদের সাথে হ‌ুমায়ূনের বন্ধুত্ব কেমন ছিল? রবী ঠাকুরের বন্ধু কয়জন ছিলেন? হ‌ুমায়ূনের অগনিত ভক্ত ছিল,আছে এবং সম্ভত থাকবেও। কিন্তু বন্ধু?সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর সাথে অবশ্য হ‌ুমায়ূনের সম্পর্কটা ভালো ছিল অনেক। দুজনই জনপ্রিয় সাহিত্যিক ছিলেন। কেউ কারো সাহিত্য কর্ম নিয়ে কোন কিছু লেখেন নি। ইমদাদুল হক মিলনের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে দারুন এক লেখা লিখেছিলেন হুমায়ূন। চোখে জল চলে আসার মত লেখা। ইমদাদুল হক মিলনের সুখ,দুঃখ আনন্দ বেদনায় ঠাসা জীবন যাপন নিয়ে সে রকম লেখা সহসা চোখে পড়ে না। হুমায়ূনকে নিয়ে তেমন লেখা চোখে পড়ে নি,তার সাহিত্য কর্ম নিয়েও আলোচনা হতে দেখিনি। যা চোখে পড়ছে তা স্মরন সভা আর টেলিভিশনের খবরের অনুষঙ্গ।

শামসুর রাহমানের কবিতা নিয়ে দারুন এক বই লিখেছিলেন হুমায়ুন আজাদ যার নাম ছিল নিঃসঙ্গ শেরপা। হুমায়ূন আজাদ অবশ্য ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় এবং অসাহিত্যের লেখালেখিতে(শব্দটা হুমায়ূন আজাদের কাছে থেকেই নেয়া) পরবতীর্ কালে শামসুর রাহমানের ব্যাপারে আগের ধারণা(নিঃসঙ্গ শেরপা কালীন মূল্যায়ন)পোষণ করেন নি। কখনো সখনো বিদ্রুপও করেছেন।হ ুমায়ূণ আহমেদকে নিয়েও তার ধারণা পরবর্তীকালে ভালো থাকে নি। হুমায়ূনের উপন্যাসকে তিনি অপন্যাস হিসেবে আখ্যায়িত করতেন! তার এই ধারণা আড়ালে আবডালে এখনও অনেকে প্রচার করে থাকেন। একবার বই মেলাতে হুমায়ূন আহমেদের পাঁচটি বই বের হলে এবং এই ব্যাপারে হুমায়ূন আজাদের দৃষ্টি আকর্ষন করা হলে তিনি বলেছিলেন-ইতর প্রানীর প্রজনন ক্ষমতা বেশি থাকে! প্রতি উত্তরে হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন- প্রতি বছর পাঁচটি করে বই বের হলে এবং আশি বছর ধরে লেখালেখি করা গেলেও রবীন্দ্রনাথের লেখার সমান হবে না। তাহলে কী ধরে নিতে হবে রবীন্দ্রনাথ ইতর প্রাণী ছিলেন? বাংলা সাহিত্যের প্রানপুরুষ রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় কিন্তু এমন ট্রেইন্ড দেখা গিয়েছিল। তাকে অবজ্ঞা না করলে নাকি তখন সাহিত্যিক হওয়া যেত না। রবীন্দ্রনাথকে অবজ্ঞা করে তখন বহু লেখা প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্যিকদের ভেতর বিভাজন তৈরি হয়েছে। হুমায়ূনকে নিয়ে এধরণের বিভাজন তৈরি হয়েছে কিংবা হবে কিনা সেটাও বলা মুশকিল। কারণ সাহিত্যের রথী মহারথীরা হুমায়ূনের সাহিত্য কর্ম নিয়ে নীরবই থেকেছেন, সম্ভবত নীরবই থাকবেন। হুমায়ূনকে এদেশের একজন সব্যসাচী লেখক একবার বলেছিলেন টিভি নাটক লিখছ তো দেখছি কিন্তু সাহিত্য কী করছ? হুমায়ূন পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন মঞ্চ নাটক সাহিত্য হলে টিভি নাটক কেন সাহিত্য হবে না? বাংলা ছবি কেন সাহিত্যের অর্ন্তভূক্ত হবে না? সত্যজিতের ছবির চিত্রনাট্য কী কারো মূল্যায়নে থাকবে না? এই সব্যসাচী লেখকের নাম সৈয়দ শামসুল হক। তিনি অবশ্য মনে করেন হুমায়ূনের ছোট গল্পগুলো বহুদিন টিকে থাকবে। হুমায়ূনের স্মরণ সভায় তিনি একথা বলেছেন। হুমায়ূনকে নিয়ে তিনি কোন লেখা লিখেছেন কিনা সেটা জানি না। তাকে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখেছিলেন ইমদাদুল হক মিলন। সেসব স্মৃতিচারণ,সাহিত্য কর্মের মূল্যায়ন কিংবা সমালোচনা নয়!

হুমায়ূন আহমেদ একবার মানিক বন্দোপাধ্যায়ের কয়েকটি গল্পের চরিত্রের নাম বদলে দিয়ে সাহিত্য বোদ্ধা দুই তিনজনকে দেখিয়েছিলেন। তারা হুমায়ূনের লেখা ভেবে বলেছিলেন এসব হালকা লেখা। গভীরতা নেই। মহাকালের কাছে টিকবে না। হুমায়ূন আহমেদ তখন হেসে বলেছিলেন মানিক বন্দোপাধ্যায়ের লেখার যদি কোন গভীরতা না থাকে তাহলে আমার লেখার গভীরতারও দরকার নেই! বেঁেচ থাকা হুমায়ূনকে নিয়ে ভক্তদের যত উম্মাদনা ছিল সেটা কমে গেছে বলে মনে হয় না। সেখানে তিনি নিঃসঙ্গ নন। তার মৃত্যুর দিন(১৯ জুলাই)ফেসবুকে তাকে নিয়ে স্ট্যাটাস দেবার হিড়িক পরে গিয়েছিল। তার লেখা উপন্যাস থেকে ছবি হচ্ছে(মোর্শেদুল ইসলাম এবং অমিতাভ রেজা ছবিদুটো পরিচালনা করবেন) হুমায়ূনের উপন্যাস বা গল্প থেকে নাটক আর সিনেমা বানানোর ট্রেইন্ড সম্ভবত শেষ হবে না। হিমু আর মিসির আলী চরিত্রগুলোকে মানুূষ ভুলতে পারবে না। সকল ধরণের বিচারের শেষে এটাই প্রতীয়মান হবে যে সাধারন মানুষের সাথে যোগাযোগের যে সহজ সাধারন ভাষা সেটা হ ুমায়ূনের যেমন ছিল সেটা একেবারেই অনন্য,ইউনিক। আর কেউ এমন ভাষায় সব শ্রেনী ও পেশার মানুষকে প্রভাবিত করতে পারেনি। বাংলাদেশের যে সব মানুষের ঘরে বই আছে,যতোগুলো লাইব্রেরি আছে তাদের প্রত্যেকের কাছেই ছিলেন হুমায়ূন, থেকেও যাবেন অনাদিকাল। কোন অবজ্ঞা বা কারো নাক সিটকানোতে মানুষের হ্রদয় থেকে তাকে টেনে বের করা যাবে না।

কোথায় হুমায়ূনকে কবর দেয়া হবে সেটা নিয়ে ছোট্ট বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। এই ছোট্ট বিতর্কের মত তার বইয়ের মালিকানা কিংবা সম্পদ নিয়ে ভবিষ্যতে আর বড় বিতর্ক তৈরি হতে পারে,কিন্তু সাহিত্যে আর মানুষের হৃদয়ে হুমায়ূনের অবস্থান নিয়ে যদি কোন বিতর্ক থেকেই থাকে,মহাকালের সমুদ্রে সেসব ভেসে যাবে।

আসলে মহাকাল বেঁচে থাকে মানুষের হৃদয়ের ভেতর। হুমায়ূন সেখানেই ছিলেন,থাকবেনও। মানুষের হৃদয়ে ঁেবচে থাকা হুমায়ূন কখনো নিঃসঙ্গ নন!
Likes Comments
০ Share