দেখা যাইতেছে দেশ স্বাধীন করার সংগ্রাম আজও শেষ হয় নাই।- সলিমুল্লাহ খান
অনেকেই কথাটা বলে থাকেন, স্বাধীনতা যুদ্ধ আজও শেষ হয় নাই। এই কথাটা যতদূর ইতিহাসে জানা যায় সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে সর্বহারা পার্টি বলেছিল একাত্তরের ষোল ডিসেম্বরের পরপর। তারা যে কারণে অস্ত্র জমা দেয় নাই। 'যুদ্ধ' চালিয়ে গিয়েছিল। তাদের এই অসমাপ্ত যুদ্ধকান্ড অনেকেই তখন পছন্দ করেন নাই, 'বিচ্ছিন্নতাবাদি', 'সন্ত্রাসি' ইত্যাদি বলে তাদের সমালোচনা করেছিলেন। 'দেশ গড়ার সময় যখন' তখন এমন নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের রুখে দেয়ার নানা তৎপরতাও ইতিহাসের জানা আছে। তো দেশ গড়ার নানা চড়াই ও উতরাই পার হয়ে জাতি যখন চল্লিশটা বছর পার করে দিল তখন কেন ফের দেশ স্বাধীন করার জরুরত ঝান্ডাসমেত খাড়া থাকল? পাকিস্তান নাই, 'বিজাতীয়' বৈষম্য নাই, বেলুচিস্তান রেজিমেন্ট নাই তারপরও দেশ স্বাধীন করার জরুরতটা কোথায় জাগিয়া আছে? দেশ গড়ার কাজের খবর লইতে গিয়া আমরা জানতে পারলাম হায় দেশটাই তো 'অস্বাধীন' থেকে গেছে আজও!
এমনকি দেশে বিপ্লব সাধন করতে চান, সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চান তারাও দেশ স্বাধীনের অপূর্নতার কথা স্বীকার করেন, মেনে নেন। এখন দেশ পুনরায় অথবা সম্পুর্ণ স্বাধীন করার কথায় আমরা কি বুঝব? 'রাজাকারদের বিচার' করার মধ্য দিয়েই কি দেশ সম্পূর্ন স্বাধীনতা লাভ করবে। মনে হয়া না এ কথায় কেউ সায় দিবেন। সামাজিক বৈষম্য, অনাচার, ইত্যাদি ইত্যাদি দূর করার মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হবে? এ কথায় কেউ কেউ সাড়া দিবেন। কিন্তু একে তো আমরা দেশ স্বাধীন বলব না। বা আসলে বলা যাবেও না। অন্যের কাছ থেকে দেশের সীমানা বা শাসন, স্বার্বভৌমত্ব উদ্ধারের নাম দেশ স্বাধীন করা। এখন সেই পরিস্থিতি নাই, অন্য না নিজেদের ভোটে, নিজেদের অর্জিত ভূখন্ডে, নিজেদের সংবিধানের আওতায় যখন আমরা বাস করি তাইলে আবার কার কাছ থেকে দেশকে স্বাধীন করব?
আমরা যে একটা রাষ্ট্রে বাস করি সে বিশ্বাস বোধহয় কম লোকই করেন। মানে নিজেদের পছন্দের একটা রাষ্ট্রের বাসিন্দা হিসাবে মন খুলে কথাটা বলবার কোশেশ অনেকেই করেন না। না করারও অনেক কারণ আছে। 'পাকিস্তানি ভূত' এখনও আছে, এখনও তারা দেশটাকে পাকিস্তান বানাতে চায়, 'জাতীর পতাকা খামছে ধরেছে সেই পুরোন শকুন', ফলে এই দেশটাকে এসব দূরভিসন্ধিকারীদের কবল থেকে মুক্ত রাখতে হবে, স্বাধীনতার কাজ সমাপ্ত করতে হবে- এমনটাই বয়ান করেন অনেকে। নানা কারণেই রাষ্ট্রের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপনের মানসিকতা এ দেশে 'অসম্পূর্ণ স্বাধীনতার পূর্ণ করার' বাসনা হিসাবে রাজনৈতিক বয়ানে হাজির থাকে।
কিন্তু আমরা যখন স্বাধীন দেশেই বলব দেশ স্বাধীন করা দরকার তখন কিছু মুশকিলের মধ্য পড়ে যাব। প্রথমত, এই দেশ স্বাধীন করব কথাটার অর্থ তো এই যে আমরা এমন একটা রাষ্ট্র গঠন করব যেটা আমাদের স্বাধীনতার চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। মানে বেশিরভাগ মানুষের গনতন্ত্র আমরা কায়েম করব, এই কথাটার অর্থ তো আর দেশ স্বাধীন হয়নি সম্পূর্ণ এই রাজনৈতিক স্বীদ্ধান্ত দিয়ে বুঝা যাবে না। কি নামে আমরা রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ডাকব বা পরিচিতি করাব তা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি বলি সমাজতন্ত্র কায়েম করব আর যদি বলি স্বাধিনতার বকেয়া কাজ আদায় করব তাইলে দুইটা ভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচির দিকে আগাব। দুইটা একসঙ্গেও কিন্তু বলা মানে হলো সবকিছু পেঁচিয়ে ফেলা। মানে কোনটা আগে, কোনটা পরে এই গোঁজামিলের সমাধান তখন কে দিবে?
একাত্তর আর তার সেই আগের জায়গায় নেই, দুই নম্বরে এটা আমাদের বুঝতে হবে। একাত্তর মানে যে শক্তিশালি ইতিহাস আছে এর নেতা শেখ মুজিব, এর নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামীলীগ, এর বিরোধীপক্ষ, সিরাজ সিকদারের দল, মওলানা ভাষানি, সিপিবি ইত্যাদি অনেক কিছুই বদলে গেছে, নাই হয়ে গেছে, আগের অবস্থানে নাই। ফলে দেশ স্বাধীন করার সংগ্রাম যে শেষ হয় নাই তা আমরা শেষ করতে গেলে এই পরিস্থিতি পাব না। অনেক বছর পার হয়ে এসেছি যেহেতু। এখন এই সংগ্রামকে তো আর স্বাধীনতা নামে ডাকা যাবে না। অন্য নাম দিতে হবে, গণতান্ত্রিক বিপ্লব, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ইত্যাদি। যে যে নামে ডাকবেন তার সেই রাজনৈতিক অবস্থান পাবলিক জানতে পারবে। যারা শক্তিশালী ইতিহাসের বয়ানের বিরোধীতা করেন তারাও কোন অর্থে স্বাধীনতাকে সম্পুর্ণ করতে চান তা পুরাপুরি বুঝবার বাকি আছে। তারা যদি মনে করেন, ভারত-পাকিস্তান 'একই চরিত্রের' আসলে, তারা যদি মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রকেও আমাদের শত্রু পক্ষ বলে ভাবতে হবে, তাহলেও তারা কেন নিজেদের রাজনৈতিক কর্মসূচির নাম দিবেন স্বাধীনতার অসমাপ্ত সংগ্রাম শেষ করা। কারণ তাদের তো আরও অনেক দায়িত্ব পালন করতে হবে, শ্রমিক, গ্রাম, নগর, কৃষি, পরিবেশ, তো এই যে ভিন্ন ভিন্ন বিষয় এসবতো একাত্তরে ছিল না। তাহলে পুরাতন কর্মসূচি নতুন সময়েও কেন জারি রাখতে হবে। পলিটিক্যালি তো এর নাম ভিন্নই হবার কথা। তাছাড়া শেষ তো কখনই করা যাওয়ার কথা না। পঞ্চাশ, সত্তর বছর পরেও কি আমরা বলে যেতেই থাকব স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ! নাকি দ্বিতীয়ের পর আরেকটা তৃতীয় মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সামনে আসবে! এখানে বলে রাখা ভালো যারা নিছক বিচারে আটকে রাখতে চান এই অসম্পূর্ণ স্বাধীনতাকে তাদের জন্য এত বিষদ আলোচনা নয়।
তিন নম্বরে বলব, এই কথাটা যেহেতু আওয়ামীলীগ বলে, তার সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা বলে, ফলে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দায় হিসাবেও যারা আজকের যুগে স্বাধীনতাকে সম্পূর্ণ করতে চাইবেন তারা এই দল থেকে নিজেদের আলাদা করতে পারবেন না। পাবলিকের সামনে নিজেদের আলাদা রাখার রাজনৈতিক বয়ান যারা দিতে পারবেন না তারা কীভাবে আওয়ামী চেতনার বিপরীতে নিজেদের দাঁড় করাবেন? মুক্তিযুদ্ধ তো আমাদের আছেই, থাকবেই, কিন্তু এর নতুন রাজনৈতিক রূপ দানের কাজই তো বিপ্লবীরা করবে। এই যে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ বলে আমরা একটা প্রকল্প দাড় করাই তার রাজনীতি তো এখন পরিষ্কার। তারপরও এই প্রপাগান্ডার আলোয় বিপ্লবের বাসনা কেন পতঙ্গের মতো আত্মবিসর্জন দিবে?
কিছু বিষয় পরিষ্কার করা দরকার এক্ষেত্রে, জামায়াত কিম্বা যুদ্ধাপরাধের বিচারেই আটকে থাকলে চলবে না এইটা তো সহজেই একজন বিপ্লবী রাজনীতিবীদ মানবেন। আরও অনেক প্রশ্ন, অনেক জটিলতার নিরসনের প্রশ্নকেও এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। ফলে নতুন কোন নামে ডাকতে হবে নতুন রাজনৈতিক সম্ভাবনাকে। বিপ্লব মাত্রেই যেহেতু সৃজন।
Comments (0)
ধন্যবাদ আপনাকে।
তথ্যপুর্ন একটি পোষ্ট।
ভালো লাগা রইলো।