Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

মুহম্মদ সাখাওয়াত হোসেইন

১০ বছর আগে লিখেছেন

আত্নকেন্দ্রিক কে না বটে হে!

সাদার ওপর সবুজ ডোরাকাটা বাসটা আসতে দেখেই মন টা ভালো হয়ে গেলো শফিকের। সবুজ-সাদার মিশ্রণে রাঙানো এই বাসটি 'সিটিং বাস' নামে প্রচলিত। তবে, বলা বাহুল্য, কার্যত এ বাসটি কখনো 'সিটিং' হিসেবে চলেনা। অবশ্য এ বাসে দাঁড়িয়ে যাওয়া যাত্রীও বেশী নেয়া হয়না। হয়ত নামের প্রতি কিছুটা সুবিচার করবার জন্যই, কিংবা হয়তো স্রেফ চক্ষুলজ্জার খাতিরেই। হরফে লেখা 'সিটিং সার্ভিস' কথাটার কিছুটা ওজন আছে বটে। সিটিং সার্ভিস এর 'দি হরিণী পরিবহন' নন সিটিং এর 'সুগম যাত্রা' কিংবা 'সকাল-আলো' বাসের চেয়ে অনেক পরিষ্কার, ভাড়ায় একটু বেশী আর যাত্রীদের কোয়ালিটিও ভালো। গা থেকে তীব্র পেঁয়াজের গন্ধ আসতে থাকা তেল চটচটে বোরখা পরা এক বুড়ী পাশের সিট থেকে আচমকা 'হোঁৎ' করে গায়ের শার্টের ওপর শিকনী ফেলে দেবেনা। শিকনী ফেলা বুড়ী কিংবা খ্যাঁস খ্যাঁস করে হাতের দাদে চুলকাতে থাকা কোন ছোটলোক শালার পুতই ভদ্রতর এই বাসে উঠতে চায় না। নিশ্চিতভাবেই, তাদের এই অনিচ্ছা সিটিং বাসের বেশী ভাড়ার জন্যই। সিটিং আর ননসিটিং বাসের সিট সংখ্যা আসলে একই, যাত্রী ধারণক্ষমতাও এক। তবে সিটিং বাসে সবগুলো সিট ভর্তি হয়ে মোটামুটি জনা দশেক লোক দাঁড়িয়ে থাকলে বাস ছাড়ার জন্য উপযুক্ত হয়েছে বলে মনে করা হয়। এ বাস লোকাল বাসের জগতে কুলীন সমাজের অন্তর্গত। অনুজপ্রতীম ভাঙাচোরা, বয়সের ভারে  জীর্ণ আর জং ধরা  নন সিটিং লোকাল বাসগুলোতে সিটের প্রায় সমান সংখ্যক যাত্রী দাঁড় করিয়ে নেয়া হয়। যাঁরা এ ইঁদুর দৌড়ে আগে এসে বসে যান সিটগুলোতে, তাঁরা তো বসেই যান। বাকিরা কেউ অন্যের পিঠের ওপর হেলান দিয়ে, কারো পায়ের ওপর পা রেখে কিছু টের না পাবার ভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে যেতে থাকেন। কেউ কেউ 'অবলা' জাতি নারীদের অবলতা, ব্রীড়া ও কোমলতার সুযোগ নিয়ে 'মহিলা সিটে' বসে পড়েন, কিঞ্চিত বলপ্রয়োগ করেই। মহিলা সিটে চারজন নারীর সাথে সিট ভাগাভাগি করে বসবার সময় দখলকারী পুরুষ যাত্রীর মাথা এমনি যাত্রাপথে নড়তেই থাকে সচরাচর। তবে পঞ্চম একজন নারী-যাত্রী বাসে উঠে পড়লে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন না হতে চাইবার জন্যই বোধহয় তাঁর চোখের দৃষ্টি বিপরীত দিকের কাঁচের গায়ে একেবারে সেঁটে যায়। সে চোখ ওই মুহূর্তে পৃথিবীর কারো সাথে যোগাযোগ করতে চায় না। নিজে পুরুষ হয়ে নারীর  সিটে আশ্রয় নিয়ে নারীজাতির এক প্রতিনিধিকে সামনে দাঁড় করিয়ে ভ্রমণ করাটাই যখন প্রতিদিনের অনেক সংগ্রামের একটি হয়ে দাঁড়ায়, চোখে চোখে যোগাযোগের চেষ্টা তখন তার কাছে বড় সন্দেহজনক হয়ে পড়ে। মনে হয়, এই যোগাযোগের উদ্দেশ্য আসলে পুরুষত্বের বলে পাওয়া তার সিটটা থেকে তাকে উৎখাত করা। আগে এসে বসে পড়া কিংবা 'লুইচ্চামী' করে মহিলা সিট বাগিয়ে নেয়া যাত্রীদের দেখে দাঁড়িয়ে যাওয়া কারো হয়ত রাগে গা রি রি করতে থাকে। হয়ত কেউ বসে থাকা এক যাত্রীর কাঁধে কনুই দিয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন হিংসে করেই। মনে হয়তো চিন্তা চলে তাঁর "শালার আরাম করা বাইর করুম। দুইন্নার মানুষ খাড়ায়া যাইতাছে, আর শালায় বইছে চ্যাগায়া"; মুখে হয়ত বলেন, "আপনের গুঁতা লাগতাছে না কি? ভীড় তো, একটু কষ্ট করেন"।

 

অফিস থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমেই 'দি হরিণী পরিবহন' পেয়ে যাওয়াটা বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার। সিটিং বলে বাস বেজায়গায় থামবে কম আর কিছুদূর গেলে সিটেও বসতে পারা যাবে। বাসের গেটে একগাদা লোক জড়ো হয়ে আছে, যেন তবারকের শিন্নী বিতরণ চলছে। এদেরকে কোনমতে ডিঙিয়ে বাসের শেষ মাথায় চলে এলো শফিক। বড় করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল সে। যত ভীড়ই হোক না কেন, বাসের শেষ দিকে চলে এসে দাঁড়িয়ে থাকলে সিট খালি পাওয়া যায়ই একটু পরে। এটা কলেজে থাকতে হামজা শিখিয়েছিলো শফিককে। এখনও থিওরীটা বেশ ভালোভাবেই কাজ করে। অফিস থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বাস যাত্রা শফিকের। "একটু পরেই সিট পেয়ে যাচ্ছি" ভাবতে ভাবতে দিনশেষের কর্মক্লান্ত শফিক চোখ বন্ধ করে ঝুলতে থাকে দাঁড়িয়ে যাওয়া যাত্রীদের সুবিদার্থে ওয়েল্ডিং করে দেয়া লোহার রেলিং ধরে। সহযাত্রীদের গা থেকে আসা ঘামের বোঁটকা একটা গন্ধ আর মাথার ওপর বাসের সিলিং এ টিমটিম করে জ্বলা অসুস্থ হলুদ বাল্ব শফিকের 'ঝুলন্ত-তন্দ্রা' কে গাঢ় করে তোলে।

 

"মামা ভাড়া দ্যান"! এই নিয়ে তৃতীয়বার ভাড়া চাইছে বাস কন্ডাক্টর। আগের দুবারই শফিক কন্ডাক্টরকে "পরে নিয়েন মামা" বলে ফিরিয়ে দিয়েছে। এবার নামার সময় হয়ে গেছে প্রায়। আশ্চর্য! পাঁচ মিনিট কম এক ঘন্টা ধরে বাস ভ্রমণ করলো শফিক, বাসের শেষে দাঁড়িয়ে। কিন্তু কোন সিট আজ পেলোনা। হামজার ওপর ভীষণ মেজাজ খারাপ হচ্ছে শফিকের। একটু আগেই দেখেছে বিশ্বরোডে ছ' সাত জন নেমে গেলো আর গেইটের ভীড়টা পাতলা হয়ে গেলো। সামনের চারটা সিট খালি হয়েছিলো, সব দখল হয়ে গেলো। সামনের দিকে দাঁড়িয়ে থাকলে একটায় বসা যেত। "এই হামজা ছাগলটার কথা শুনে বাসের পেছনে দাঁড়ানোটাই একটা ইডিয়েটিক কাজ হয়েছে" প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে ভুরু দুটো কুঁচকে ভাবলো শফিক। এতক্ষন সিদ্ধ হয়ে যাওয়া গরমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই বাস যাত্রাটা করায় পা দুটো সীসার মত ভারী হয়ে আছে। মাথায় একটা ভোঁতা যন্ত্রণা। কন্ডাক্টরের বারবার ঘুরেফিরে ভাড়া চাওয়াতে মেজাজটাও আরো খারাপ হয়ে গেলো শফিকের। সামনের মানুষগুলোকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে এগোতে লাগলো সে। পকেটে হাত দিয়ে ১৫ টা টাকা বের করে কন্ডাক্টরকে দিলো। টাকাটা হাতে নিয়েই কন্ডাক্টর খেঁকিয়ে উঠলো, "কত দিছেন? বিজয় সরণী থাইকা খিলক্ষেত বিশ ট্যাকা ভারা"।

শফিকের নামবার সময় এগিয়ে আসছে। বাস স্লো করে দিয়েছে। কন্ডাক্টরের কথা আর তার বলার রুঢ়তার ধরণে শফিকের রাগটা মনে হয় আরো তীব্র হয়ে গেলো হঠাৎ। এতক্ষনের কষ্টকর যাত্রা, সিট না পাবার হতাশা, ঘামের গন্ধ, জুতোর ওপর মাড়িয়ে দেয়া, এসব কিছুই যেন একটা অন্ধ ক্ষোভ হয়ে গলায় উঠে এসে চিৎকার করে উঠলো, "কিল্লিগা বিশ ট্যাকা ভাড়া? নেওয়ার টাইমে তো সিটিং কইয়া নিছ ঠিকি। আসলাম তো দাঁড়ায়া। সিটিং ভাড়া চাও কোন মুখে? এতো রকম কথা চোদাও ক্যা তোমরা?"

কনডাক্টরও সাথে সাথে উত্তর দিলো, "কথা তো মিয়া আপনে চোদান। সিটিং গারী, সিটিং ভারা দিবেন না?হুদাই মুখটা খারাপ করান। দ্যান! পাঁচ ট্যাকা দ্যান"

"হ তোমার বালের গাড়ীর সিটিং ভাড়া দিমু আমি! ফাইজলামি চোদাইতাস বেশী তোমরা। মাইর মুইর খাওনা তো কয়দিন। সর। নামতে দ্যাও।"

কন্ডাকটর শফিককে নামতে দিতে চায় না। পাঁচ টাকা তাকে বুঝিয়ে দিয়েই যেতে হবে। শফিকের কাঁধে আঙুলের টোকা দিয়ে বলে, " ছ্যাছরামী করতাছেন কিল্লিগা? ভদ্র মানুষ, ট্যাকা সুন্দর মতো দিয়া দিলেই তো হয়া যায়"।

বাসভর্তি যাত্রীরা এ দুজনের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের বিষয়ে একেবারেই উদাসীন। যাত্রী-কন্ডাক্টর এ দ্বৈরথ তাদের নিত্য পরিচিত দৃশ্য। শফিক আরো কিছুক্ষণ বাকবিতন্ডা করে কনডাক্টরকে রীতিমত ধাক্কা দিয়ে নেমে আসে তার গন্তব্যে, পাঁচ টাকা না দিয়েই। কনডাক্টর গলা বাড়িয়ে টিটকারি মেরে বলে, "না থাকলে কইবেন যে লগে ট্যাকা নাই। প্যান শাট পরছে দেইখানি ট্যাকার কথা কইতে পারে না"

 

বাস শফিককে নামিয়ে দিয়ে গতি বৃদ্ধি করে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। জানালা দিয়ে পেছনে দূরে শফিককে দেখতে দেখতে বাসের কয়জন  যাত্রীর উদ্দেশ্যে কন্ডাকটর বলে "হালায় ছ্যাছরা চোদা। খানকির পোলা!"

দূরে বাসটাকে শহরের লাখো গাড়ীর ভীড়ে মিশে যেতে দেখতে দেখতে আর অবিন্যস্ত শার্টের ইন ঠিক করতে করতে শফিক নিচু গলায় বলে ওঠে "শালা শুওরের বাচ্চা। মাদার ফাকার"।

Likes Comments
০ Share

Comments (0)

  • - মাইদুল আলম সিদ্দিকী

    খুব ভালো লাগলো শুভকামনা জানালাম

    • - আলমগীর সরকার লিটন

      সিদ্দিকী দা

      কবিতা ভাল লাগার জন্য

      অশেষ ধন্যবাদ
      ভাল থাকুন———–

    - কেতন শেখ

    চমত্কার! কবিকে অভিনন্দন।

     

    • - আলমগীর সরকার লিটন

      কেতন দা

      অশেষ ধন্যবাদ
      ভাল থাকুন———–