রেল লাইন। তার দুই পাশ ঘেঁষে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট বস্তি ঘর। এখানে এলেই একধরনের বোঁৎকা গন্ধ, নাসাছিদ্র ভেদ করে ভিতরে প্রবেশ করে । ঘাস-পোড়ার গন্ধ। প্রায় সারাদিনই এখানে চলে গঞ্জিকা সেবীদের আড্ডা। রাতে এ আড্ডা আরো যুৎসই হয়। তখন এলাকার সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেরা আসে। ঘাসের পাশাপাশি পালাক্রমে চলে ফেনসিডিল হেরোইনের উৎসব। এই সমস্ত মালের জোগাড় দেয় বস্তির ভ্যানওয়ালা রিক্সাওয়ালারা। এমন কী নারী ও শিশুরাও এ কাজের সাথে যুক্ত। একজন আছেন, যার বস্তিতে খুব নামডাক। সবাই তাকে মীনাদি বলেই চিনে। এমন কোন নেশাদ্রব্য নাই, যা তার কাছে পাওয়া যায় না। থানা পুলিশ জেনেও কিছু বলে না। কারন থানায় মাসে মাসে তেজপাতা পাঠান হয়।
এখানে যে ভালো সৎভাবে বাঁচে, এরকম কোন পরিবার নেই তা বললে ভুল হবে। আছে। তবে খুব কম।
মীনাদি’র দেড়ার কয়েকটা কুঁড়ে পরই তনুদের কুঁড়ে। তনুর বয়স ১২/১৩ হবে। বাবা নাই। তিন বছর আগে রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। পরিবারের সদস্য বলতে, সে, তার মা এবং একটা বড় বোন আছে। পেশায় তনু একজন বাদাম বিক্রেতা। বাদাম বিক্রি করে যে লাভ আসে, তা দিয়েই তাদের সংসার চলে। অসুস্থ মায়ের ওষুধ কেনা হয়। বোনের লেখা-পড়ার খরচ চলে।
তনু বাদামের ঝুড়ি কাঁধে করতে করতে বলল, মা, হামি গেনু।
প্রতিদিনই এসময় তনুর মা, ছেলেকে এগিয়ে দিতে বাইরে বের হয়ে আসেন। ছেলের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। যতক্ষণ তনুকে দেখা যায়, ঠিক ততক্ষণই তিনি তনুর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। বিড়বিড় করে কী যেন বলে। হয়ত সন্ধ্যাবেলা তনু যাতে সুস্থভাবে আবার বস্তিতে ফিরে আসে, আল্লাহর কাছে এই দোয়ায় করেন।
প্রতিদিনের মতই তনুর মা ছেলেকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে বসছিলো। তনু তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আরে কী করো । তোমার না আইজ শরীলে অসুক? আইজ একটু স্যাকালেই চইল্যা আসব্।আইসা তোমাকে ডাক্তারের কাছে লইয়া যাবো।
মা আর কিছু বলে না। অর্ধশোয়া থেকে আবার শুয়ে পড়ে।
তনু বস্তি থেকে বের হয়ে আসে। রেল লাইন ধরে হাঁটতে থাকে। সরু রেল লাইন। কিছুদূর হাঁটার পরই প্লাটফর্ম। তনু এবং তার কিছু সংগি মিলে এখানেই বাদাম বিক্রি করে। প্রতিদিন বিকেল হতে না হতেই তার বাদাম বিক্রি হয়ে যায়। আজো বেলা বাড়ার সাথে সাথে তনুর বাদাম ভালোই বিক্রি হয়। তাই তার মনটাও বেশ ফুরফুরে। সে গুনগুন করে গান গায়তে থাকে।
তখন মাথার উপর সূর্যতা। চারদিকে তার আগুন ছড়াচ্ছে। ভালোই তার দাপট।
প্লাটফর্মের দখিন পাশে দুইটি কাঁঠাল গাছ। দুইটি কাক পাখা ছড়িয়ে গাছের উপর বসে আছে। গাছের নিচে একটি নেড়ী কুত্তা, তার জিহ্বা বের করে হাঁপাচ্ছে।
এই প্রখর তাপে তনুর প্রচন্ড তৃষ্ণা পায় । সেই সাথে ক্ষুধাও। তনু কাছের এক দোকান থেকে পাউরুটি কিনে। পাউরুটিতে প্রথম কামড় বসায়।
এরই ভিতর ১০-১২ জন লোক আসে। প্লাটফর্ম এলাকায় তাদের ভালোই দাপট। একজন লম্বা, মোটা-সোটা, মাথায় কোঁকড়ান লম্বা চুল, গালে একইঞ্চি পরিমাণ খোচা খোঁচা দাড়ি আছে। সেই বলে, এই পিচ্ছি, বাদাম কয়টাকা পুরিয়া?
তনু পাউরুটির বাকি অংশ একটা পলিউথিনে মুড়িয়ে, বাদামের ঝুড়ির একপাশে রেখে দেয়। তারপর বলে, ১০ টাকা, সার।
লোকটি সামনে ঝুলে থাকা চুল পিছনে ঠেলে দিয়ে বলে, আমাদের সবাইকে একটা করে পুরিয়া দে।
তনু বিপুল উৎসাহে সবার হাতে একটি করে বাদামের ঠোঙা ধরিয়ে দেয়।
লোকগুলো নির্বিকারভাবে বাদাম চিবুতে থাকে। যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।
তনু বলে, সার, বদামের টাকাটা?
তারা ঘুরে দাঁড়ায়। এইবার একজন বেঁটে পাতলা রোগাটে চেহারার ছেলে মুখ খুলে। সে বলে, কীসের টাকা বে... তুই জানস ওই কে? চাইনিজ আতিকের ছোট ভাই।
তনু অনুনয়ী কণ্ঠে বলল, সার, হামাকে টাকাটা দিয়া দেন।
লম্বা চুলওয়ালা বলল, কীরে... ও কী বলল শুনস নাই? তোর বাড়ি কোথায়? তু্ই, বস্তিতে থাকিস না?
তনু হ্যাঁ সূচক মাথা ঝাঁকায়। বলে, সার, হামাকে টাকাটা দিয়া দেন। হামি বাড়ি চইল্যা যায়। হামার মা অসুক। ডাক্তারের কাছে লইয়া যাইতে হইবে।
লোকটি একগাল হাসি দিয়ে বলে, তুই ছোট ছেলে। এত কষ্ট করছিস কেন? তোর মাকে মীনাদির মতো লাইগা যেতে বল। তাহলে আমাদেরও একটু সুবিধা হয়।
সবাই হো হো করে হাসতে থাকে।
এইবার আরেকজন বলল, আসাদ ভাই, এই সালার একটা বড় বোন আছে। সরকারী কলেজে পড়ে। ফিগার তো না, যেন টসটসে আঙুর। সেদিন মীনাদি’র দেড়া থেকে বের হওয়ার সময় দেখেছি।
আসাদ বলল, কীরে... পোলাপাইন কি বলে? ঘটনা কী সত্য? তা একবার তোর বোনকে নিয়া আয়, আমরা দেখি। ভালো জিনিস হলে, আমারে খাওয়া শেষে হোটেলে দিয়া দিব। ম্যানেজারের সাথে আমার ভালো খাতির-বাতির আছে। তোদেরও ভালো ইনকাম আসবে। পায়ের উপর পা তুলে খাবি।
তনু কিছ বলে না। লজ্জায় অপমানে চুপ করে থাকে। তার দুইগাল বেয়ে অনবরত জল ঝরছে।
আসাদ পকেট হতে মানিব্যাগ বের করে আনে। সেখান থেকে েএকটা ১০০ টাকার কড়কড়ে নোট বের করে, বাড়িয়ে দেয় তনুর দিকে। বলে, এই নে তোর বাদামের দাম।
তনু এত অপমান হওয়া সত্ত্বেও টাকা নিবার জন্য হাত বাড়ায়।
তারপর যা ঘটে, তা খুবই দ্রুত ঘটে । আসাদের পা বুক বরাবর উঠে আর তনু মেঝেতে চিৎ হয়ে পড়ে যায়। ঝুড়ির সমস্ত বাদাম প্লাটফর্মে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে।
তনু দু’হাতের উপর ভর দিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে। তার দুই চোখ রক্তাক্ত লাল। এমতাবস্থায় তাকে হিংস্র জানোয়ারের মতো দেখায়। যেন এখনই ঝাঁপিয়ে পড়বে শিকারীর উপর।