দুইজন বাবা
১৯৮৪ ইং সালে আমি ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে সুযোগ পেয়ে ভর্তি হই।
আমার জীবনকে সম্পুর্ণ ওলট-পালট করে দিয়ে চিন্তা-ভাবনার জগৎটাকে সহ আমি এক ভিন্ন যায়গায় এসে পড়লাম যেন। সবে ছয়টি ক্লাস পার করা বলতে গেলে এক শিশুই তো ছিলাম তখনো। সারাদিন ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়ানো খুলনার চিরপরিচিত সেই মুক্ত পরিবেশ থেকে আমাকে নিয়ম-শৃংখলার এক আবদ্ধ ভূবনে পাঠানো হল। যেখানে সবাধীনভাবে শ্বাস নেবার মতোও অবকাশ ছিল না। আর 'সিনিয়র' নামের কিছু দানব সদৃশ দু'পেয়েদের নিষ্ঠুরতায় সেই পরাধীন জগতটি আরো ভয়ংকর হয়ে উঠল আমার কাছে।
শারীরিক এবং মানসিক টর্চারে আমার ঠাই হয়েছিল যশোহর সিএমএইচ (সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল) এর কমিশন্ড ব্লকে। আমার 'প্লুরাল ইফিউসন' হয়েছিল। অবস্থা খুবই সিরিয়াস আঁকার ধারণ করে। আমি কেমন একটা ঘোরের ভিতর থাকতাম। আজ অনেক বছর হয়ে গেলেও আবছা আবছা সে সময়গুলোকে এখনো মনে করতে পারি।
আমার আব্বা তখন খুলনা কাস্টমস হাউসে 'প্রিভেন্টিভ অফিসার' পদে কর্মরত। প্রতিদিন খুলনা থেকে অফিস করে তিনি আমাকে দেখতে আসতেন। আমার সাথে কিছু সময় কাটিয়ে আবার বাসায় চলে যেতেন পরবর্তি দিনে অফিস করার জন্য। আমার জ্ঞান ফিরলে আমি আমার আব্বাকে আমার পাশে বসা দেখতে পেতাম। তখন খুলনা থেকে যশোর এর রাস্তা ছিল খুবই খারাপ। আর আমার আব্বা একটি মটর বাইক চালাতেন। সারাদিনের ক্লান্তিকে ঝেড়ে ফেলে বিকেল ৫টার পরে সেই বাইকটি নিয়ে প্রতিদিন আমাকে দেখতে চলে আসতেন সিএমএইচে!! এভাবে প্রায় ৪ মাস ওনাকে আসতে হয়েছিল।
আজ আমি নিজেই সুন্দরী বাবু এবং জ্ঞানী বাবু'র পাপা!
আর আমার আব্বা থেকে অনেক দূরে রয়েছি... প্রায় ১৪ বছর ধরে।
বছরে ও একবার তাঁর সাথে দেখা হয় না। মোবাইলে কথা হয়। তবে এখন আর তিনি সেইভাবে আমাকে চিনতে পারেন না। আমাদের চারভাই এর নাম্বার তাঁর মোবাইলে সেভ করা রয়েছে। তারপরও অনেকক্ষণ কথা বলার পরে হঠাত বলে উঠেন, " কে তুই?"। আসলে আব্বা আব্বার মতই রয়ে গেছেন। আমিই পালটে গেছি। না হলে আমি কেন তাকে দেখতে যেতে পারি না?
আমার দুই মেয়েকে ছেড়ে সপ্তাহের ৫ দিন ঘন্টাখানেক দূরত্তের পথ থাকতে আমার কেমন কষ্ট হয় সেটা এখন অনুভব করছি। আর আমার আব্বা আমাকে ছেড়ে এতোগুলো বছর হৃদয়ে কি যাতনা ই না অনুভব করছেন!
১৯৮৪ ইং সালে একজন বাবা তাঁর শত ব্যস্ততার মাঝেও তাঁর সন্তানকে প্রতিদিন সময় দিয়েছিলেন। এরপর আরো অনেকগুলো বছর ও দিয়েছেন... যতদিন জীবিত থাকবেন দিয়ে যাবেন।
কিন্তু সেই সন্তান আজ বাবা হয়ে তাঁর জনকের জন্য কিছুই করছে না। এতটাই যান্ত্রিক জীবনে সে অভ্যস্ত যে হৃদয়টাও তাঁর যন্ত্রে পরিণত হয়েছে।
আসলে দুইজন বাবা লেখাটাই ভুল হয়েছে।
এখানে একজন ই বাবা!
দুই সন্তান এর জন্মনিবন্ধন কার্ডে আমার নাম লেখা থাকলেও আজো আমি বাবা হতে পারলাম না!!
Comments (10)
ভালো লাগলো পোষ্ট, জানা হলো বেশ, শেয়ার করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ, শুভেচ্ছা জানবেন ভালো থাকবেন।