Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

প্রীতি রাহা

১০ বছর আগে লিখেছেন

সাধারণ কথা, তবুও কিছু কথা

ফেসবুকের নিউজ ফিডে হঠাৎ দেখি একটি পোষ্ট। সেখানে লেখা, ‘ঘরে ঘরে এমন মা দরকার’। মোটেও অপেক্ষা না করে পোষ্টে উল্লেখিত সেই জাতীয় দৈনিকের ওয়েব লিংকে পৌঁছলাম। সংবাদটির শিরোনাম, ‘বিচার না পেয়ে ঘাতক হয়েছি’ এবং এরপরের লাইনেই লেখা, ‘মেয়েকে উত্ত্যপ্তকারীকে হত্যার দায়ে গ্রেফতারকৃত মা’। সেখানে আছে একজন বিধ্বস্তভ দ্রমহিলার ছবি। তার নাম খাদিজা বেগম(৪৫)। হ্যাঁ, উনিই একজনকে খুন করেছেন; ঠিক মানুষকে নয়, এক মানুষরূপী পশুকে তিনি হত্যা করেছেন। খবরটা দেখে কেমন যেন অনুভূত হল।

 

যশোর সদর উপজেলার দেয়ারা ইউনিয়নেরভেকুটিয়া গ্রামে চলতি বছরের ১২ মার্চ এই ঘটনা ঘটে। উত্ত্যপ্তকারীর একই এলাকার বাসিন্দা ছিল। তার নাম মফিজুর রহমান মফি (৪৪)। ব্যাক্তিগত জীবনে সে পাঁচ সন্তানের জনক ছিল এবং মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি বিয়ে করেছিলেন মোট চারটি। পঞ্চম বিয়ে সম্পন্ন করার জন্য সে খাদিজা বেগম-এর ছোট মেয়েকে উত্ত্যপ্ত করতো। খাদিজা বেগম তার কিশোরী মেয়েকে মফির হাত থেকে বাঁচাতে সবার কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। সবাই আশ্বাস দিলেও কেউ তাকে শেষ পর্যন্ত সাহায্য করেনি। পরে তিনি নিয়েই মেয়েকে রক্ষার ভার তুলে নেন। একজন স্নেহময়ী মা-এর নাম উঠলো ঘাতকের তালিকায়।

 

তার মানে ঘাতক তৈরি করছে আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা? কেননা, যদি কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটি বিশেষভাবে নজর দিত তবে একজন মা-এর এমন অবস্থা হত না। একটি পরিবার মা-কে হারাতো না। গভীরভাবে চিন্তা করে দেখলে বুঝতে পারবেন, পরিবারটির অনেকটা ক্ষতি হয়ে গেল। কিন্তু এই ক্ষতির হাত থেকে পরিবারটিকে রক্ষা করতে কি পারতেন না কর্তৃপক্ষ? অবশ্যই পারতেন কিন্তু তাদের দায়সাড়া ভাবের জন্য সবটাই ওলট-পালট হয়ে গেল। সাদা চোখে দেখলে, আবার খাদিজা বেগম-এর মৃত্যুদন্ডও হয়ে যেতে পারে নয়তো যাবজ্জীবন কারাদন্ড! পরিবারটি কি ভীষণভাবে ক্ষতগ্রস্ত হল না? এই ঘটনার দায় সমাজ এড়াতে পারে না। এড়াতে পারে না সেই কর্তৃপক্ষের গদিতে আরাম করে বসে থাকা মানুষগুলোও।

 

আরেকজন মায়ের কথা বলি। আপনাদের চাঁপা রাণী ভৌমিকের কথা মনে আছে? ফরিদপুরের সেই মা, মনে পড়ে? তাঁর যমজ দুই তনয়াকে উত্ত্যপ্ত করার প্রতিবাদে জানিয়েছিলেন মা। পরিনামে তাঁর প্রাণ কেড়ে নেয় সেই উত্ত্যপ্তকারীরা। ২৬ অক্টোবর, ২০১০। মূল উত্ত্যপ্তকারী রনি ও তার দুই সহযোগী মোটরসাইকেল চালিয়ে পেছন দিক থেকে চাঁপা রাণী ভৌমিককে ধাক্কা দেয়। তিনি রাস্তায় ছিটকে পড়ে মাথায় প্রচন্ড আঘাত পান। তাৎক্ষণিক তাঁকে মধুখালী উপজেলা কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে সেখানে অবস্থার অবনতি হতে থাকলে তাঁকে সেখান থেকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়ার পথে সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে চাঁপা রাণী ভৌমিক তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

 

 

সেই সময়ের এমন আরেকটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছিল। মোটরসাইকেলে পিষ্ট করে যেভাবে চাঁপা রাণীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল ঘাতকেরা, ঠিক তেমনি একটি ঘটনা ঘটেছিল এরও আগে।

 

নাটোরের বাগাতিপাড়ার লোকমানপুর কলেজ-এর শিক্ষক ছিলেন মিজানুর রহমান। তাঁর ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার (ইভ টিজিং) প্রতিবাদ করায় ২০১০ সালের ১২ অক্টোবর হামলা চালানো হয় তাঁর ওপর। বখাটেদের মোটরসাইকেলের আঘাতে গুরুতর আহত হন। প্রথমে তাঁকেস্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবংশেষে সেই বছরের ১৪ অক্টোবর রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ)-তে ভর্তি করা হয়। এরপর থেকে তিনি সেখানেনিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন। কৃত্রিমশ্বাস-প্রশ্বাস যন্ত্রের সাহায্যে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল শিক্ষক ছিলেন মিজানুর রহমান-কে।২৩অক্টোবর রাতরাত ১২টা ৫৫ মিনিটে হৃৎপিণ্ডের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে 'লাইফসাপোর্ট' খুলে নিয়ে মৃত ঘোষণা করা হয়। টানা১১ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করার পর শিক্ষক মিজানুর রহমান-এর জীবনাবসান ঘটে।

 

পরবর্তীতে মিজানুর রহমান ও চাঁপা রাণী ভৌমিক-এর হত্যাকান্ডকে সাধারণ দুইটি দুর্ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দেবার অভিযোগ উঠেছিল। বিচারের অপেক্ষায় থাকা মানুষগুলো কি আদৌতেও বিচার পাবে?

শিক্ষক মিজানুর রহমানের একমাত্র তনয়া নুসাইবা রহমান মমো। মমোর বাবা যখন মারা যান তখন তার বয়স মাত্র চার বছর। মেয়েটি তখনো বিজেই উঠতে পারেনি, তার বাবার আর নেই। আজ হয়তো বোঝে, আজ নিজে নিজে কাঁদে। কিন্তু এটি নির্মম সত্য, তার বাবা আর কোনদিন ফিরবে না। না ফেরার দেশে যারা যায়, তারা আর ফেরে না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি লাইন মনে পড়ে গেল,

“সত্য যে কঠিন,

কঠিনেরে ভালোবাসিলাম-

সে কখনো করেনা বঞ্চনা।”

-     রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

যার কাছ থেকে হারিয়েছে জীব, সেই জানে তার শূন্যতার গভীরতা। আমরা কি জানি? আমরা কি বুঝি? হ্যাঁ, তবুও কিছুটা বুঝি; মানুষ বলে বুঝি। সবটুকু নয় যদিও, তবুও কিছুটা তো বুঝি। এই মানবজীবন মায়ায় কাটে, মায়ার টানে ভাসে। মায়ায় বাঁচে, মায়ায় মরে; মায়ায় খেয়া ভাসে।

 

হ্যাঁ, মায়া। অদ্ভুত এক অনুভূতি। এই মায়ার টান ছিন্ন করেই মানুষ না ফেরার দেশে চলে যাইয়; চলে যেতে হয়। শিক্ষক মিজানুর রহমান যে শিক্ষার্থীকে ইভ টিজিং করায় প্রতিবাদ করেছিলেন, যে শিক্ষার্থীর কারণে তিনি বখাটেদের হাতে নিহত হয়েছেন এবং যে শিক্ষার্থীর কারণে তাঁর কন্যা আজ পিতৃহারা সেই শিক্ষার্থীর নাম ‘ববিতা’। ববিতা আজ আর নেই। সেও না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছে। নিজ ইচ্ছায় সে স্বেচ্ছামৃত্যুকে বেছে নিয়েছে। ২০১৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর, প্রেমিকের অন্যত্রবিয়ে করার বিষয়টি মেনে নিতে না পেরে বিষপানের পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীনঅবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। মৃত্যুকালীন সময়ে ববিতা রাজশাহী বরেন্দ কলেজে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল।

 

ববিতার জন্য আমার আক্ষেপ হয়। শিক্ষক মিজানুর রহমান স্যার এবং তাঁর পরিবারের জন্য আমার কষ্ট হয়। ববিতা কত বোকা, কত আবেগপ্রবণ। নিজের জীবনের গুরুত্ব সে অনুধাবন করতে পারেনি।

Likes ১০ Comments
০ Share