২৮ ফেব্রুয়ারি’১৪। এ দিনটিতে সাপ্তাহিক ছুটি হওয়ায় ছিল না কোন অফিসের তাড়া কিংবা কাজের চাপ। মেলায় আসায় জন্য তাই ছিলনা কোন বাঁধা। মেলা খোলা ছিল সকাল ১১টা থেকে রাতনয়টা পর্যন্ত। এই শেষের দিনেও ছিল ক্রেতাদের ভিড়। অন্যান্য দিনের মত ভয়াবহ ভিড় না হলেও এ ভিড়কে কম বলা যায় না। এই দিনে নিজের পছন্দের বইটি সাথে করে নিতে কিংবা মায়ার টানে বইমেলায় এসেছিলেন অনেকেই। পাঠকদের পাশাপাশি ছিলেন লেখকেরাও।
বাংলা একাডেমির জরিপ সূত্রে জানা গেছে, এই একুশে বইমেলায় ১ ফেব্রুয়ারি – ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট সাড়ে ১৬ কোটি টাকার বইবিক্রি হয়েছে। যা বিগত বছরের তুলনায় অনেক বেশি। একাডেমিরতথ্য মতে, গত বছর একুশে বইমেলায় ১০ কোটি ১৪ লাখ ৭৩ হাজার টাকার বই বিক্রি হয়েছিল এবং নতুন বই প্রকশিত হয়েছিল মোট ২,৯৬৩টি। চলতি বছরের ২৮ দিনেরএই বইমেলায় নতুন বই বের হয়েছে মোট ২,৯৫৯টি। অতএব, বিগত বছরের তুলনায় এবার বই বিক্রি বেশি হলেও নতুন বই প্রকাশিত হবার সংখ্যা কমেছে।
২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শুধু বাংলা একাডেমির প্রকাশিত বই বিক্রিহয়েছে এক কোটি ১০ লাখ ২৪ হাজার টাকার। গতবার তা ছিল ৬৭ লাখ ৪০ হাজার ৭৮০টাকা, যা গতবারের চেয়ে ৪২ লাখ ৮৩ হাজার ২২০ টাকা বেশি।এবার বাংলাএকাডেমি থেকে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছিল ৬৪টি। শেষ দিনেও মেলায় এসেছে ১৭৪টিনতুন বই। ১৪টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান হয় নজরুল মঞ্চে।
পছন্দের বইটি সংগ্রহে রাখার পাশাপাশি প্রিয় লেখকের অটোগ্রাফ নিতে ভুল হয়নি ভক্তদের। তবে এখন অটোগ্রাফ নেয়ার পাশাপাশি প্রিয় লেখকের সাথে ফটোগ্রাফ রাখার প্রবণতাই বেশি দেখা গেছে। অনেকে তাদেরকে ‘অটোগ্রাফ শিকারী’ নামে আখ্যায়িত করলেও আমার মনে হয় এটি সম্পূর্ণ সঠিক নয়। কারণ, ‘অটোগ্রাফ শিকারী’ বললে যিনি অটোগ্রাফ দিচ্ছেন তাঁকে নাক উঁচু ধাঁচের মানুষ বলে মনে হয়। একজন মানুষের জীবনে ‘অটোগ্রাফ’ নামক জিনিসটি কাউকে উপহার দেয়া কোন সহজ ব্যাপার নয়। কারণ অনেক কষ্টে, অনেক শ্রমে একজন অটোগ্রাফদাতা সেই পর্যায়ে পৌঁছেছেন, যেখানে মানুষের অন্তর অবস্থিত। কেউ প্রকাশ করুক বা না করুক; অনেকের অন্তরেই আছে ‘আমি যদি কাউকে অটোগ্রাফ দিতে পারতাম’। সুতরাং একজন অটোগ্রাফদাতার কাছে এই অটোগ্রাফ দেয়াটা যেমন সৌভাগ্যের, ঠিক তেমনি একজন ভক্তের কাছেও ব্যাপারটি মহা আনন্দের। সংক্ষেপে এবং এক কথায় বলতে গেলে ব্যাপারটি এমন, ‘সুযোগ পেলে সবাই অটোগ্রাফ নিতে পারে কিন্তু সবাই অটোগ্রাফ দিতে পারে না’।
বইমেলার সাথে কথাটি হয়তো খুব বেশি প্রাসঙ্গিক নয়, তবুও বলছি। একবার এক দেশবরেণ্য লেখক আমাদের এলাকায় এসেছিলেন। আমি তাঁর নাম উল্লেখ করতে চাইছি না। তিনি তখন প্রথম সারিতে বসা। মঞ্চে অনুষ্ঠান চলছে। ইতোমধ্যে তাঁর ভক্তরা অটোগ্রাফ নিচ্ছে এবং তাঁর সাথে ছবিও তুলছে। সেই লেখকের দিক থেকে কোন ধরণের আপত্তি ছিল না, থাকারও কথা নয়। কিন্তু বাঁধা দিলেন উপস্থিত অন্যান্যরা। লেখক জানতেও পারলেন না, কিন্তু অন্যরা গোপনে নির্দেশ দিলেন ‘কেউ যেন অটোগ্রাফ নিতে না আসে’। সেই অতি জ্ঞানী মানুষেরা নির্দেশটি দেওয়ার আগে লেখককেও বলেছেন, ‘দেখুন তো আপনার কি যান্ত্রণাটাই না হচ্ছে!’। লেখক বিনয়ের সাথে সেই জ্ঞানীদের সাথে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন। তারপরও এই আদেশ! ভক্ত কি? ভক্ত কারা? সেই তথাকথিত জ্ঞানীরা হয়তো তা অনুধাবন করতে পারেননি, পারবেনো না।
বইমেলাকে কেন্দ্র করে বইমেলা প্রাঙ্গনের বাইরে অন্যরকম আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। চারদিকে বিভিন্ন জিনিসপত্রের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন বিক্রেতারা। অমর একুশেগ্রন্থমেলার প্রবেশ পথের নিকটে টিএসসি থেকে বাংলা একাডেমি পর্যন্ত রাস্তারডান দিকে ছিলেন অঙ্কন শিল্পীরা। ছোট্ট শিশুরা তাদের মুখচ্ছবি হাতে নিয়েছে এই অঙ্কন শিল্পীদের সাহায্যে। শুধু শিশুরা কেন? বাদ যাননি বড়রাও। শৌখিন মানুষেরা তাদের মুখচ্ছবি আঁকিয়ে নিতে ভোলেননি। বাংলা একাডেমির বইমেলার গেটথেকে শুরু হওয়া আঁকিয়েদের এই দলটি কিন্তু মোটেও সংখ্যায় কম ছিলেন না। অঙ্কন শিল্পীরা কেউ প্যাস্টেল রঙে, কেউপেন্সিল স্কেচ কিংবা কেউ জলরঙে স্কেচ করেছেন। নিজের মুখচ্ছবি অঙ্কনে আগ্রহীরাওঅপেক্ষা করেছেন সামনের জনের শেষ হলে তারপর তাঁর নিজের ছবি আঁকানোর প্রস্তুতি নেয়ার জন্য।
বইমেলা দেখা সবার ভাগ্যে হয়নি। যাদের হয়নি তারা টেলিভিশনে দেখেছেন। বাংলাদেশের চ্যানেল্গুলোকে আন্তরিক ধন্যবাদ। তারা অনেকেই নিজেদের চ্যানেলে বইমেলা নিয়ে সরাসরি অনুষ্ঠান করেছেন। যে কারণে তাঁদের চোখে এবং তাঁদের ক্যামেরায়, দেশ এবং দেশের বাইরের মানুষেরা বইমেলা দেখতে পেরেছে। এই আনন্দটুকুই বা কম কিসের? লেখক, পাঠক ও দর্শনার্থীদের ভিড় দেখেছি টিভিতে। লেখকদের সাক্ষাৎকার শোনা গেছে সেখানে। সেখানে যেমন ছিলেন নতুন লেখক, তেমনি ছিলেন পুরোনো লেখক। প্রথমবারের মত বই প্রকাশিত হওয়ায় অনেকের মুখেই ছিল অফুরন্ত হাসি। মেলায় পরিবারের সাথে আসা শিশুদেরও ছিল উচ্ছ্বল পদচারণা। লেখা পড়তে শেখেনি এমন শিশুও বই কিনেছে। শিশুদের হাতে বই আর মুখে হাসি। প্রাণোচ্ছ্বল সেই হাসির সাথে যোগ হয়েছেন বড়রাও। পছন্দের বইটি নিয়েছেন সাথে।
তবে এবারের বইমেলাটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বর্ধিত করায় অসন্ত্বোষপ্রকাশ করেছেন অনেকেই। অন্যান্যবারের একুশে বইমেলার মত এবারে আর সেই ভিড় নেই বয়রাতলার লিটলম্যাগ চত্বরে। প্রতি বছরের মতো এবারও লিটলম্যাগের জন্য জায়গা বাংলা একাডেমির বয়রাতলায়।নতুন আঙ্গিক আর ভিন্ন স্বাদের রচনা নিয়ে মেলায় এসেছে বেশ কিছু ছোট কাগজ। তবুও বইয়ের স্টল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হওয়ায়, বাংলাএকাডেমির এ অংশটি এড়িয়ে গেছে বেশিরভাগ পাঠকের চোখ। তবে একটু ব্যতিক্রমীলেখার স্বাদ নিতে এ চত্বরেও এসেছে কেউ কেউ। কিন্তু এই দর্শনার্থীদের সংখ্যা অবশ্যই চোখে পরার মত নয়। এমন অনাকাক্ষিত সমস্যা সমাধানে পরবর্তী বছরগুলোতে পুরো বইমেলাটি এক জায়গায় আনার বিষয়ে ভাবতে হবে সংশ্লিষ্টদের।
বইমেলা বাঙ্গালীর এক প্রাণের মেলা। এ যেন লেখক – পাঠকের এক মিলনমেলা। বছরের এই ২৮টি দিনের অপেক্ষায় থাকেন লেখক এবং পাঠকেরা। তবে প্রতি চার বছরান্তে এটি ২৮ দিনের পরিবর্তে ‘লিপ ইয়ার’ হিসেবে আর ১টি দিনকে অতিরিক্ত পায়। মাস জুড়ে বইমেলায় যাওয়া এই মানুষগুলোর এক ধরনের নেশা হয়ে যায়, বিশেষ করে লেখকদের এবং পাঠকদের তো বটেই। অনেক লেখক-পাঠকের ফেসবুক স্ট্যাটাসেই দেখা গেছে এ বিষয়ে দুঃখের কথা। টিভিতে যারা সরাসরি বইমেলার অনুষ্ঠান দেখতেন তাদেরও কিন্তু দুঃখ কম হয়নি। অনুভূতি এক অপূর্ব জিনিস। টিভিতে দেখলেও বইমেলা দেখার নেশা কিন্তু অপূর্ব। আবার ১১টি মাসের অপেক্ষা।
যারা লেখালেখিতে যুক্ত আছেন, তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই মনের ভেতর এক সুপ্ত আশা আছে। তা হল – নিজের লেখাগুলো আসবে এক মলাটের ভাজে, ছাপার অক্ষরে সেই বইয়ের ওপরে ভাসবে নিজের নাম। এমনি করেই এক একজন লেখকের বই আসে, বইমেলা আসে। হাসি-আনন্দে ভাসে, চোখের জলে হাসে। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারীর জন্য অপেক্ষা, আবার আসবে বইমেলা। নতুন নতুন লেখক আসবে, আসবে নতুন বই।
সকলের অপেক্ষা শুভ হোক, স্বপ্নগুলো পূর্ণ হোক।