ওসমান সাহেব ভুল করে ফেলেছেন। একজন অযোগ্য ছাত্রকে প্রশ্নপত্র সরবরাহ করে ডাক্তার হওয়া সুযোগ করে দিয়েছেন। যখন ভুল ভেঙ্গেছে ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। তিনি এখন সেই ডাক্তারের ছুরির নিচে অপারেশনের টেবিলে কাতরাচ্ছেন। ভাবছেন ভুল ডাক্তারের কাটাকুটির চাইতে মরে যাওয়া ভাল। ভুলটা উনার একান্তই নিজের। এর সাক্ষীও একমাত্র তিনি নিজেই। সেই সুত্রে এটাকে আবু ওসমানের নিজস্ব ভুলই বলা যায়। বয়ানটা বেশ শক্তিশালী।
এভাবেই সমকালীন বিষয়, সমকালীন অংসঙ্গতি নিয়ে চারিপাশে চেনা মানুষের গল্প রম্য আর তীর্যক ভাবে তুলে এনেছেন সময়ের আলোচিত কথাসাহিত্যিক পলাশ মাহবুব। ২০১৬ সালের বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের নাম আবু ওসমানের নিজস্ব ভুল। অন্য প্রকাশ থেকে প্রকাশিত রম্য গল্পের সংকলনটির প্রচ্ছদ করেছেন জনপ্রিয় প্রচ্ছদ শিল্পী ধ্রুব এষ। যতদুর জানা যায় প্রচ্ছদের আলোকচিত্রটি ধ্রব এষের নিজের ছবি যেখানে তিনি সিড়ি দিয়ে নামছেন। আলোকচিত্রের ক্যমেরা যার মুন্ডু বাদ পড়ে গেছে। লেখক স্বত্বের বইটির মুল্য রাখা হয়েছে দুইশত টাকা।
পলাশ মাহবুব মুলত গল্প, উপন্যাস লেখেন। পাশাপাশি ছড়াও লিখেন। লেখার অন্যতম প্রধান বিষয় সমকালীনতা আর লেখনির ধরণ তীর্যক ও রম্য। আবু ওসমানের নিজস্ব ভুল গ্রন্থটি আগাগোড়া তীর্যক রসাত্নক গল্পের সমাহার। পড়ার সময় হা হা হো হো করে হাসি আসবেনা কিন্তু লবন দিয়ে জিহ্বা নাচিয়ে তেতুল খাওয়ার মত এক চোখ বন্ধ হয়ে আসবে।
যারা গল্পের প্লট খুজে পাননা। অথবা গল্প খুঁজতে অনেক পথ পাড়ি দিয়ে তবে গল্প সংগ্রহ করতে হয় তাদের সহায়ক হতে পারে পলাশ মাহবুবের বই আবু ওসমানের নিজস্ব ভুল। লেখক তার চারিপাশের জগত, কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গল্প সাবলীলভাবে নিজস্ব ঢঙ্গে বর্ণনা করে গেছেন। তার লেখার একটা নিজস্ব ভঙ্গি আছে যা সহজেই পাঠককে আকর্ষন করবে। ছোট ছোট পরিপুর্ণ গল্প গুলি পাঠ শেষে পুর্ণ তৃপ্তি দেয়ার পাশাপাশি পরবর্তি গল্পে নিয়ে যাওয়ার জন্য আগ্রহী করে তুলবে।
মুলত মানুষ হাসানো অনেক কঠিন কাজ তার উপর যদি লিখে হাসাতে হয়। তবে যারা অহেতুক নিটোল হাস্যরসের মাধ্যমের সময়কে ব্যয় করতে চান তাদের জন্য পলাশ মাহবুবের লেখা হয়ত ভাললাগবেনা। কিন্তু যারা সামাজিক সচেতনতা থেকে শুরু সামগ্রিক বিষয় থেকে কিছু শিক্ষা গ্রহন করতে চান তাদের জন্য বইটি নিসঃন্দেহে সুখপাঠ্য। বোধ করি এমন পাঠকের সংখ্যাই বেশী।
বইয়ের প্রতিটির গল্পের প্রতিটি চরিত্র আমাদের অতি পরিচিত। এই গল্প গুলো হর হামেশা আমাদের চারিপাশে তৈরী হচ্ছে আবার বাতাসে হারিয়ে যাচ্ছে যে গুলোকে আমরা আবারও তুলে নিয়ে আসছি। পলাশ মাহবুব সে গুলোকে সাহিত্য রুপ দিয়েছেন মাত্র। যে মানুষটি ছাত্রদের কাছে প্রশ্ন পত্র ফাস করে দিয়েছে সে যেমন আপনার পরিচিত ঠিক নতুন বউয়ের বাসর রাতে বিড়াল মারা ঘটনাও আপনার পরিচিত। কারো নতুন ব্যবসা শুরু করতে গিয়ে মানসিক উত্তেজনা কিংবা ফেসবুকে হরেক রকমের আইডির নাম নিয়ে নানান মুখরোচক গল্প আপরার পরিচিত। তেমনি পরিচিত কোম্পানীর টাকাকে নিজের টাকা মনে করা এমন হিসাব রক্ষক কিংবা নিজের ইস্কুলের রাশভারী কিংবা কমেডি চরিত্রের শিক্ষকও আপনার পরিচিত। এমনই কিছু গল্প নিয়ে পলাশ মাহবুব সাজিয়েছেন তার রম্য গল্পের বই আবু ওসমানের নিজস্ব ভুল।
পলাশ মাহবুব এই বইটিতে তার লেখক প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন চেনা গল্পের ব্যতিক্রমি উপস্থাপনার মাধ্যমে। সাধারণ সাবলীল সহজ বোধ্য শব্দের মাধ্যমে চেনা কথা চেনা ছবির মালা গেঁথেছেন। বহুল আলোচিত বহুল উক্ত কথা দিয়ে কথার পিঠে কথা সাজিয়েছেন। বইটি পাঠ করলে একটা বিষয় সহজেই উপলব্দি করা যাবে কত সহজে গল্প লেখা যায়।
বইয়ের প্রতিটি গল্পই সম্পুর্ন আলাদা। গল্পের বিষয়, উপস্থাপনার ধরন আলাদা শেষ ও রেশ সম্পুর্ণ আলাদা। ফলে পাঠক একের ভিতরে বহু রসের স্বাদ আস্মাদন করার সুযোগ পাবেন।
আমার পড়া গল্প সংকলনের মধ্যে আরো একটি বই যুক্ত হলো যার প্রতিটি গল্পই স্বয়ং সম্পুর্ণ সত্বার অধিকারী। কোন গল্পকে বাদ দিয়ে অন্য কোনটাকে সেরা বলা যাবেনা। এটা লেখকের লেখনির কারিশমাও বলা যেতে পারে। যিনি পাঠক বুঝেন পাঠকের মন বুঝেন তাকে ধরে রাখার কৌশলটাও করতলগত করে রেখেছেন।
“মানুষের চোখ উঠে কপালে, তিনি তুললেন গলায়। না নিজের না। দর্শকের।“ এভাবেই বয়ান শুরু করেন পলাশ মাহবুব। প্রতি লাইনে লাইনে প্রশ্নবোধক চিন্হ বিহীন প্রশ্ন আর সাথে সাথে উত্তর। ছোট্ট ছোট্ট ঢেউয়ের মতো যা কিনা পুকুরের উপর দিয়ে বাতাস বয়ে যাওয়ার মতো। প্যরোডি করতেও কম যান না পলাশ মাহবুব। ও মোর বানিয়ে বন্ধুরে এক খান লুঙ্গি কিনিয়া দে……………। তার কোন এক সদ্য ব্যবসা শুরু করতে যাওয়া বন্ধুর জন্য এভাবেই বয়ান করেন তিনি।
কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার পলাশ মাহবুব সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। সাহিত্য জগতে বিচরণ দেড় যুগ ধরে। এই সময়ে তিনি তার অবস্থানকে বেশ শক্ত করে নিয়েছেন। সকলের জন্য লেখেন তিনি। নাটক, গল্প উপন্যাস এবং কিশোর গল্পেও তার জনপ্রিয়তা উল্লেখযোগ্য। দেশের অন্যতম জনপ্রিয় নাট্যকার হিসেবে তার পরিচিতি রয়েছে। নির্মান করেছেন দেড় হাজারের মত টেলিভিশন অনুষ্ঠান। লেখা লেখির স্বীকৃতি স্বরুপ আদায় করেছেন, সিটি আনন্দ আলো পুরস্কার এবং ভারতের অন্নদা শংকর পুরস্কার।
শেষ করার আগে বলে রাখছি আবু ওসমানের নিজস্ব ভুলে সংকলিত হয়েছে পলাশ মাহবুবের চৌদ্দটি রম্যও তীর্যক গল্প। চারিপাশে ঘটে যাওয়া বা ঘটতে যাওয়া সমসাময়িক ঘটনাবলীর গল্পময় উপস্থাপনা। সমাজ পরিবর্তনের অঙ্গিকার নিয়ে লেখক ও পাঠকের মেলবন্ধন ঘটুক উভয়ের হাত ধরে