Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

নুসরাত জাহান আজমী

৯ বছর আগে লিখেছেন

বৃষ্টির শুরু, বৃষ্টির শেষ... (বর্ষা প্রতিযোগিতা ২০১৪)

১:

মাঝারি সাইজের এই রুমটায় দুটি জানালা। একটি দক্ষিণদিকে, একটি পূর্বে। দক্ষিণের জানালাটা রেজাউল সাহেবের ভীষণ পছন্দের। এখানে দাঁড়ালে পাশের গাছে একটি পাখির বাসা দেখতে পাওয়া যায়। তিনটি পাখির ছানা আছে বাসাটায়। ছানাদের খাবার খাওয়ানোর দৃশ্যটা তার খুব পছন্দের

আজ সকাল থেকে পাখির বাসাটা নিয়ে তিনি খুব চিন্তিত। সকাল থেকে ঝুমবৃষ্টি হচ্ছে। সাথে দমকা হাওয়া। পাখিগুলো এখন কি করবে তার মাথায় সেই চিন্তা। প্রাণপণে দোয়া করছেন বৃষ্টির ঝড়ে পড়া যেন বন্ধ হয়ে যায়। পাখিগুলোর কষ্টে তিনি নিজে কষ্ট পাচ্ছেন।

একসময়ের ভীষণ প্রিয় এই বৃষ্টি এই বর্তমান রেজাউল সাহেবের মনে কোনরকম অনুভূতির সৃষ্টি করেনা। অথচ, তার এখনো মনে আছে ছোটবেলায় বৃষ্টি নামলেই চলে যেতেন বিলের ধারে তার বন্ধুদের সাথে মাছ ধরতে। আমের দিনে তো তাকে শিকল দিয়েও বেঁধে রাখা যেতনা বৃষ্টি নামলো কি, ছুটে যেতেন কেরামত খাঁর বিশাল আম বাগানে। বৃষ্টির মধ্যে আম কুড়ানোর মজাটাই যেন অন্যরকম। কাদায় মাখামাখি করে খেলা হত ফুটবল। বাড়ির টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ এখন মনে হয় অন্যজগতের কোন রিমঝিম ছন্দ ছিল বুঝি। রাতে ঘুম না আসলে টিনের চালে পড়া বৃষ্টির শব্দ শুনেই কেটে যেত কতখানি সময়। যেন অচিনপুর থেকে কোন মনমাতানো সুর নিয়ে এসে একের পর এক ঝমঝম করে তাদের বাড়ির চালে পড়ছে। এখনকার সময়ে ঐ দিনগুলোর কথা মনে হলে মনে হয় ওসব বুঝি তার না, অন্য কারো দিন ছিল।  

পড়ালেখা শেষ করে ব্যাংকের চাকরি করেছেন ৯টা-৫টা। সেখানেও বৃষ্টির সাথে তার সখ্যতার কথা জানা ছিল প্রায় সবারইআকাশে মেঘের ডাক শুনলেই পাশের টেবিলের হানিফ সাহেব বলে উঠতেন- রেজা ভাই, রেডি হন, আপনার প্রেমিকা আসছে। শুনে আশেপাশের সবার সে কি হাসি।

বিয়ের পর তার স্ত্রী রাত্রির সাথে এই বৃষ্টি নিয়ে কম খুনসুটি হয়নি। মাঝে মাঝে তো ঝগড়াই লেগে যেত। রেজাউল সাহেব এখনো ঐ কথা মনে করে নিজের অজান্তে হেসে ফেলেন, কেমন ছেলেমানুষ ছিল রাত্রি। বৃষ্টির প্রতি আলাদা টান দেখে রাত্রি মাঝে মাঝে বলে উঠত, আচ্ছা, কাকে বেশি ভালবাসো? সত্যি করে বলতো, আমাকে নাকি এই বৃষ্টিকে?? অভিমান করে বসে থাকা রাত্রিকে যখন জোর করে বৃষ্টিতে ভেজার জন্য নিয়ে যেতেন তিনি, তখন এই ছেলেমানুষ রাত্রি আরো ছেলেমানুষি শুরু করে দিত। কতদিন আগের হারিয়ে যাওয়া সেই দিনগুলি, আজো রেজাউল সাহেবের মনে স্মৃতি হয়ে আছে পরম যত্নে।

আজ রাত্রি নেই। বৃষ্টির প্রতি কেমন একটা উদাসীনতা চলে এসেছেছোটবেলা যখন বৃষ্টিপড়া শুরু হতেই খোলা মাঠে কাদায় ঝাপাঝাপি শুরু হয়ে যেত, তখন কি মনের কোনে একটি বারও এসেছিল, এই বৃষ্টির প্রতি এক সময় ভয়ঙ্কর উদাসীনতা কাজ করবে তার

জানালা দিয়ে বেশ ভালোই বৃষ্টির ছাট আসছে। প্রায় ভিজে যাচ্ছেন রেজাউল সাহেব। কপাট আটকাতে যেয়ে আরেকটিবার দেখে নিলেন পাখির বাসাটিকে। বাচ্চাগুলোকে কেমন ডানা দিয়ে আগলে রেখেছে মা পাখিটা। তার পাশের ডালে গম্ভীর হয়ে বসে আছে বাবা পাখিটা।

২: 

এই মুহূর্তে তিনি তার রুমে একা। বৃদ্ধাশ্রমের এই বাড়িটায় প্রত্যেক রুমে দুজন করে থাকে।সবাই এখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি পড়া দেখছে। রেজাউল সাহেবের এখানে আসার পিছনেও প্রধান কারণ তার প্রচণ্ড ভালোলাগার এই বৃষ্টি।

আজকালকার আধুনিক ছেলেমেয়েরা বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দ থেকে বঞ্চিত। তাদের ঘন ঘন পরীক্ষা থাকে। বৃষ্টিতে ভিজে অসুখে পড়লে সেই পরীক্ষা খারাপ হয়, তারপর অবধারিত ভাবে বাবা-মা আর টিচারের বকুনি সহ্য করতে হয়।

কোন এক আশ্চর্য কারনে রেজাউল সাহেবের দুই নাতি ভয়ঙ্কর রকমের বৃষ্টি পাগল হয়েছে। বৃষ্টি নামলেই মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিটেফোঁটা গায়ে লাগানো তাদের চাই-ই- চাই।

দাদুর কাছে তার বৃষ্টির দিনের কাহিনী শুনে নাতিদের ছোটছোট চোখগুলো কেমন বড় বড় হয়ে যেত। সেই চোখে থাকত শুধু বিস্ময়। মাঝে মাঝে দুজনের একটি বুলি, “সত্যি দাদু??” যেন দাদু কোন রূপকথার গল্প বলছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হত তাদের। মাঝে মাঝে দুজনের আফসোস, কেন তারা বৃষ্টিতে এমন মজা করতে পারেনা।  

রেজাউল সাহেব ব্যাপারটা ভীষণ উপভোগ করতেন। তার কাছ থেকেই নানা কাহিনী শুনে একদিন বৃষ্টির দিনে দু’ভাই ছাদে পানি জমিয়ে সেকি দাপাদাপি। অবশ্য মায়ের মারটাকেও সাথে সাথে হজম করতে হয়েছিল তাদের

রেজাউল সাহেবের ছেলের বউ তার সন্তানদের ব্যাপারে ভীষণ সচেতন। বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আসবে তাই ভেজা বারন করে দিয়েছে ছেলেদের। শ্বশুরকেও বারন করে দিয়েছে নাতিদের এতটা লাই দিয়ে মাথায় তুলতে এবং শেষে স্বামীকে পাঠিয়েছেন বাবাকে সাবধান করে দিতে। ছেলে এসে একথা সেকথার পর বলেই বসল, তার জীবনে ঐ সব ঘটনা যেন নাতিদের না বলে, তারা নাকি বিগড়ে যাচ্ছে।

ছেলের কথায় বাবার মনে কষ্ট পেলেও মুখ দিয়ে কোন কথা বের করেননি রেজাউল সাহেব। ব্যাপারটা এখানেই শেষ হতে পারত।

কিন্তু না...

সেদিন নাতিদের নিয়ে আসতে স্কুলে গিয়েছিলেন তিনি। বাসায় বউমা কি যেন কাজে ব্যস্ত। বাসায় ফেরার সময় নামলো ঝুম বৃষ্টি।নাতিদের প্রবল ইচ্ছায় রিক্সার হুড ফেলে দিয়ে ঝুমবৃষ্টিতে নাতিদের নিয়ে ভিজতে ভিজতে ফিরলেন বাসায়। সারারাস্তা ওদের উচ্ছ্বাস দেখতে দেখতে মনে হল চোখের সামনে যেন নিজের শৈশবের ছবিটা দেখতে পাচ্ছেন তিনি বহুদিন পর

রাতে ছেলে বাসায় ফেরার পর বউমার সাথে ছেলের শুরু হয় প্রচণ্ড বাকবিতণ্ডা। অবশেষে ছেলে ঘরে শান্তি বজায় রাখার সুত্র খুঁজে পায়, এই বৃদ্ধাশ্রম।

৩:

বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে রেজাউল সাহেব বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন।একাধারে বৃষ্টির শব্দটাকে কিছুক্ষণ শুনার পর মনে হয় কোন এক ছন্দের তালে বুঝি বৃষ্টিটা পড়ছে। নিজের মনে কোন এক ছন্দ তৈরি করে নিতেন তিনি, মনে বৃষ্টি বুঝি তার শেখানো ছন্দেই পড়ছে। এটা অবশ্য তার ছোটবেলার অভ্যাস। সন্ধ্যার কিছু পরেই বৃষ্টিটা থামল।

তবে সেই থেমে যাওয়া বৃষ্টি আবার যখন রাতে ঝড়কে সঙ্গী করে ফিরে আসলো, যখন এই ঝড়ের কারণে পাখির বাসাটা ভেঙ্গে গেলো, ছানাগুলো মারা গেলো, তখন রেজাউল সাহেবের মনে আর পাখির বাসাটা নিয়ে কোনরকম চিন্তা উঁকি মেরে গেলনা। প্রচণ্ড ঝড়ে বাইরে যখন সব দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময়টাতেই রেজাউল সাহেব একদম চুপচাপ ভাবেই বিদায় নিলেন এই অসম্ভব সুন্দর পৃথিবী থেকে।

একসময় সব কিছু শান্ত হয়। হয়ত সবকিছু ঠিকও হয়, কিন্তু কখনো কি ঠিক হয় সেই ছেলেটার মন। যে তার বাবাকে নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়? কখনো কি সেই ছেলেটা বুঝতে পারে তার ভুল হয়েছিল, প্রচণ্ড ভুল হয়েছে। ভয়ঙ্কর ভালোলাগার জিনিসগুলো থেকে কি সবসময়ই এমন চরম মূল্য মানুষকে দিতে হয়?? হয়ত, তা না হলে শুধুমাত্র বৃষ্টির কারণেই কেন রেজাউল সাহেবের জীবনের সমাপ্তিটা এমন হবে??   

Likes ৩১ Comments
০ Share

Comments (31)

  • - এই মেঘ এই রোদ্দুর

    সুন্দর হয়েছে । শুভকামনা

    • - আলমগীর সরকার লিটন

      সুন্দর লাগার জন্য

      অশেষ ধন্যবাদ আপু

      ভাল থাকুন-------------

    - মেঘলা আনজুম

    ফাল্গুনবিলাস আর রংধনু বিকেল

    পরিচয়টা জানো এখন বর্ষাঝরা রাত;

    সুন্দর

    • - আলমগীর সরকার লিটন

      জ্বি আপু অনেক অনুপ্রেরণা পেলাম

      সুন্দর লাগার জন্য

      অশেষ ধন্যবাদ আপু

      ভাল থাকুন-------------

    - কবিরুল ইসলাম কঙ্ক

    ভাল লাগল লিটনভাই । শুভকামনা রইল । 

    • - আলমগীর সরকার লিটন

      জ্বি দাদা

      ভাল লাগার জন্য

      অশেষ ধন্যবাদ

      ভাল থাকুন-------------