Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

হাসান ইকবাল

১০ বছর আগে লিখেছেন

চৈত্র সংক্রান্তির সেইসব হিরন্ময় দিন

চৈত্র সংক্রান্তির সময় এসে গেলে ব্যস্ততা বেড়ে যেত গাঁয়ে। পাটক্ষেতে তখন নিড়ানীর ধূম। বাড়ির বড়রা দলবেঁধে বসে পাটের চারা নিড়ানী দিত। বড়রা বলতে আমার বাবা, চাচা, বাড়ির বাৎসরিক কাজের লোক। সংক্রান্তির আগেই নিড়ানী শেষ করার জন্য দূর গায়ের লোকেরা আসতো কাজের খোঁজে। বৃষ্টি ও ঝড় শুরু হয়ে গেলে উর্বর জমি নরম হয়ে যায়, তখন আর নিড়ানী দেয়া যায়না। ঘন পাটের চারা তোলা যায়না, আগাছা সরানোও যায়না। জমিতে পা দেবে যায়। ক'দিন বাদেই বৈশাখ, আর বৈশাখী ঝড়ের তান্ডব আর আম কুড়ানোর ধূম।

এই সময়টাতে আমরা ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ঘুড়ি উড়তাম। তেলেঙা ঘু্ড্ডি, চিল ঘুড্ডি, ঢোল ঘুড্ডিসহ নানা জাতের নানা রঙের ঘুড়ি। কোনটা ভোঁ ভোঁ শব্দ তোলে আকাশে পাড়ি দিত। সে ঘুড়ির নাম চিল ঘুড়ি। চিলের মত বিশাল ডানাওয়ালা ঘুড়ি। ঘুড়ির মাথায় বেঁধে দিতাম তালের পাতা দিয়ে বিশেষ ভাবে তৈরি ধনুক। তালের পাতলা পাতায় বাতাসে ছোট লেগে দারুন এক শব্দ হতো । কেউ কেউ বলতো-"এইড্যা হেলিকপ্টার ঘুড্ডি।"
ঘুড়ি উড়াতে হলে নাটাইয়ের সূতো ধরে দৌড়াতে হয়। আর সূতোর টান লেগে ঘুড়ি উপরে উঠতে থাকে। আর ছেলেরা চিৎকার করে বলতো-"ঘুড্ডি উড়ে ফন্ফন্।" সুতোর নাটাই ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে কখন যে আমরা সেই নিড়ানী দেয়া বৃষ্টি ভেজা নরম পাট খেতের উপর দিয়ে দৌড়েয়েছি তার হুশ জ্ঞান আমাদের থাকতোনা। কাদামাটি থেকে পা যখন উঠাতে পারতাম না, তখন টের পেতাম। কতজনের পাট খেত আমরা মাড়িয়েছি তা টের পেতাম পরদিন সকালে যখন ডজন ডজন নালিশ আসতো আমার দাদার কাছে-"তোমার বান্দর নাতী পাটখেতের সর্বনাশ কইর‌্যালছে।" আর তখন দাদার কাছাকাছি থাকাটা যে নিরাপদ নয়, সেটা ঠিকই বুঝতে পারতাম।

চৈত্র সংক্রান্তিতে লোকধাঁধাঁ ও শিলুক, মেয়েলী গীত, বৃষ্টির গান, বারোমাসী গান, ঘাটু গান, আমতলার সঙযাত্রা, লোকমেলা, ঘুড়ি উৎসব, কীর্তন, ফসল কাটা-ফসল তোলা, ধান ভানার গান, বাউল-মুর্শিদী, দেহতত্ব, মারফতি, ভাটিয়ালী, পক্ষী শিকারের গান (কোড়া শিকার), পুথি পাঠ, হালকার গান, আঞ্চলিক গান, কবিগান, পল্লীগান, ফকিরালী জিকির গান, খেয়ালী ও রাখালী গান, পালা-গীতি, পাড়া-গায়ের ছড়া, দরবারী শিলুক, পল্লীগীতি অভিনয়, সাপের মন্ত্র, বারনী-আড়ং, ষাড়েড় লড়াই, মুরগের লড়াই, চৈত্র সংক্রান্তিতে মশা-মাছি তাড়াবার আনুষ্ঠানিকতা, গিমাই শাক রান্না, মন্ত্রের বুলি আউরিয়ে শোলা দিয়ে দাদা-দাদী সম্পর্কীয়দের পেটানো, লোক-কাহিনি নির্ভর কিচ্চা, পালাগান, যাদু টোনা মন্ত্র, গাইনের গীত, হিরালী, পালকির গান এসব অধিকাংশই আমাদের দেখার ও শোনার সৌভাগ্য হয়েছে।

সংক্রান্তির দিন সন্ধ্যে থেকে আমরা পাটশোলার লুক্কা (আটি) বেধে প্রস্তুত থাকতাম পাড়ার পাড়ায় লুক্কা যুদ্ধে অবতীর্ন হবার জন্য। আর খেতের আইলধরে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে লোকছড়া বলতাম সবাই।

বাঁশ কাটি কাটুর-কুটুর
ঝিংগা কাটে মদিনা,
আমার বইন ছকিনা
তিনদিন ধইর‌্যা দেখিনা।
তিনদিনের জ্বরে,
মাথা বেদনা করে।
বকুল ভাইগো ভাই, কবে বিয়া করবাইন,
সামনের শুক্কুর বারে।
লাল একটা শাড়ি দিয়াম ঝিলমিল করে।
তেলের একটা পট দিয়াম সিঁথি বাইয়া পড়ে
হাত ভরা চুড়ি দিয়াম ঝুমুর ঝুমুর করে।
ছিম গাছের তলে বুজি গোসল করে
কালা জামাই দেইখ্যা বুজি টানামানা করে।
রাঙা জামাই দেইখ্যা বুজি ফুলের বিছনা করে।
(আঞ্চলিক শব্দার্থ: বইন-বোন, বেদনা-ব্যাথা, শুক্কুর বার-শুক্রবার, বুজি-বড় বোন ।)

চৈত্র মাসের সংক্রান্তির দিন আমতলা বাজারে বারনী-মেলা বসতো। গ্রামের মানুষের সমাজ জীবনের নানান নিরূপম অনুষঙ্গ দেখা যেত এই মেলায়।
আমাদের গ্রাম্য ভাষায় ‘চৈত-পরব’ কৃষি যন্ত্র-পাতি, লাঙল, জোয়াল, মই, বিন্দা, (আঁচড়া) বলতো প্রচুর আসতো। ছেলে-মেয়েদের খেলার জিনিস পুতুল, বাশী খাওয়ার জন্য লাড়– মুড়ি খৈয়ের মোয়া, শিরার গুড় বাতাসা খেলনা। ডাব তরমুজ খিরা বিভিন্ন ফলের সমাহার। বাবা অনেক সময় নেত্রকোনা যেতেন, ফেরার পথে আমাদের জন্য তরমুজ খেলার বাঁশী ঘুড়ি নিয়ে আসতেন। আজ বৈশাখ এলেই দাদার কথা মনে পড়ে।

দুঃখু কইও বন্দের লাগ পাইলে
গো নিরলে,
আমার বন্দু রঙিচঙি
জলের উপর বানচে টঙ্গিগো
দুই হাত উড়ায়া বন্ধে
ডাকে গো নিরলেঋ
দুঃখু কইও বন্ধের লাগ পাইলে।।
(রাখালী গান, রওশন ইজদানী)

আমাদের বাড়ির ডানপাশেই বড় পুকুর। পুকুরের চারধারে আমগাছ। যেদিন বিকেল থেকে আকাশে গুড়ুম গুড়ুম শুরু হতো, আমাদের মনের ভেতরও ঠিক তেমনি গুরুম গুরুম শুরু হতো। দিগন্ত ছুঁয়ে আকাশ জুড়ে মেঘের দাপাদাপি। কালো দৈত্যের মতো বিশাল বিশাল মেঘ, সন্ধ্যে হলেই শুরু হতো কালবোশেখী ঝড়। মা ভয়ে অস্হির থাকতেন-অনবরত পড়ে যেতেন-
'লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জুয়ালেমিন।'
আমরাও বিড়বিড় করে বলতাম। আর প্রতীক্ষার প্রহর গুণতাম, কখন থামবে এই ঝড়। কোনদিন রাত দশটা নাগাদ ঝড় থেমে গেলে ভাইবোনেরা সবাই মিলে বেরিয়ে পড়তাম আম কুড়াতে। দেরী হলে পাড়ার অন্য ছেলেরা আম কুড়িয়ে নিয়ে যাবে পিছনে সে ভয়। তাই বৈশাখ আসলে আমাদের রুটিন ওয়ার্ক বেড়ে যেত।

বৃষ্টি থামলেও ঝড়ো হাওয়া পুরোপুরি থামতোনা। আমরা বেরিয়ে পড়তাম ঘর থেকে, মায়ের শত মানা সত্বেও। এক হাতে হারিকেন, কেরোসিনের কূপি বাতি নিয়ে আমকুড়ানোর নেশায়। কখনো গাছের ফাঁকে আলো আধারীর অদ্ভুত কিছু দেখে চিৎকার করে এক দৌঁড়ে চলে আসতাম ঘরে। মনটা পড়ে রইতো আম গাছতলায়। ঝড়ো হাওয়ায় কুপি বাতি যাতে নিভে না যায় বাঁশ-বেতের তৈরি মাছ ধরায় ঝাকায় কূপি রাখা হতো। আম কুড়াতে কুড়াতে খাচা ভারি হয়ে উঠলে বড়দের সাহায্যের জন্য চিৎকার করতাম।

বৈশাখের কোন রোদহীন বিকেলে আমাদের কাজের লোক ইসলামুদ্দী চাচার সাথে যেতাম বিলে পোনা মাছ ধরার জন্য। সে বিলের নাম 'হেলুচ্চিয়া বিল'। বিলের ধারে ধানখেতে ভেতর খুঁজতে হয় পোনা মাছ। পোনা মাছ হলো টাকি মাছের ছানা। একটা বড় মা টাকি মাছের সাথে ঘুরে বেড়ায় কয়েক লক্ষ টাকির পোনা। আমার মা কাঠালের বিচি কুচিকুচি করে কাচা মরিচ দিয়ে এক বিশেষ ধরনের সুস্বাদু নিরামিষ ভাজি তৈরি করতেন। পোনা ভাজি। গরম গরম ভাত দিয়ে খেতে এক কথায় অমৃত।

বৈশাখের মাঝামাঝি সময়ে নদীতে ও বিলে পানি বেড়ে যেত। আমাদের পুকুরে ডুবিয়ে রাখা বড় বড় দুটো বিশাল নৌকা উঠানো হতো বাইরে চলাচলের জন্য। আমাদের হালচাষের কয়েক ডজন গরু-বলদের ঘাস কাটতে হতো বিল থেকে। ইসলামুদ্দী চাচা খুব সকালে ডিঙাকলা কিংবা কাচা মরিচ আর পেয়াজ দিয়ে এক বোল পান্তা সাবাড় করে নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন গরুর ঘাস সংগ্রহের জন্য।

আমাদের বাড়ির অদূরেই ছিল একটি গ্রাম্য বাজার। লালছান্দের বাজার।
বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনে এখানে বারনী বসতো। সে বারনী মেলায় আমরা সবাই যেতাম। নানান রঙের বানর, খেলনা, মুড়ি-মুড়কী, বাতাসা, টমটম গাড়ি, ফটাস আর নারকেলী আর বোনদের জন্য পুতুল কিনে সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ফিরতাম।

বছরের শুরুর এই দিন গুলোর জন্য আমরা দিনের পর দিন অপেক্ষা করতাম। সে দিনগুলো ছিল সত্যিই মধুর।

হাসান ইকবাল
৩০ চৈত্র ১৪২০
ঢাকা।
ই-মেইল: hasan_netsu@yahoo.com

Likes Comments
০ Share

Comments (0)

  • - মুন জারিন আলম

    কাঁচা মরিচ থেরাপী   অনেক ধন্যবাদ

    - ওসমান শেখ

    আপনাকেও ধন্যবাদ 

    - বাধন আহমেদ

    আমি কাঁচা মরিচ like করতাম না। ভাবছি এখন থেকে কাঁচা মরিচ থেরাপী নিতে হবে। 

    Load more comments...