আইন বলতে বইয়ের ভাষার বাইরে আমি যা বুঝি তা হলো বেয়াড়াকে কন্ট্রোল করা। একটু খেয়াল করুন আমি বলেছি কন্ট্রোল করা । তার অর্থ এই নয় যে বেয়াড়াকে ভালো মানুষ করে তোলা।
আইনের কাজ সমাজের শৃঙ্খলা আনায়ণ। অর্থাৎ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বশে রাখা যাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করতে পারে। খেয়াল করুন এখানেও কিন্তু বলা হলো না যে ঐ জাতীয় মানুষকে ভালো মানুষ করা।
অনেকেই বলেন কঠোর আইন প্রয়োগের কথা। হ্যাঁ আইনের দরকার নেই এই কথা কিন্তু আমি বলছি না। কিন্তু একটু খেয়াল করুন আরবের চেয়ে কঠোর আইন কি পৃথিবীতে আর আছে? ধর্ষণ সেখানেও চলে এবং পৃথিবীর অন্যতম।
তাই আইন কানুন অজুহাত মাত্র। আর নিজের দুষ্টু চঞ্চল বখে যাওয়া মনটাকে সামলাতে মহাপুরুষ হওয়া লাগে না। সুপুরুষ হলেই হয়। হ্যাঁ সুপুরুষই বলছি এর অর্থ সুদর্শন হওয়া নয় কিন্তু।মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন একজন পরিপূর্ণ মানুষ।
চলুন দেখি আইন কি বলে?
>>নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ৯ ধারায় ধর্ষণের বিচার হয়। এ আইনে ধর্ষণের সর্বনিম্ন শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদন্ড এবং সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড করা হয়েছে।
>>আইনের ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে, তাহলে সে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডীত হবে। এ ছাড়া অর্থদন্ডে দন্ডিত হবে।
>>৯(২) উপধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা ওই ধর্ষণ-পরবর্তী তার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহলে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডীত হবে। অতিরিক্ত এক লাখ টাকা অর্থদন্ডেও দন্ডীয় হবে।
>>উপধারা ৯(৩)-এ বলা হয়েছে, যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের ফলে ওই নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহলে ওই দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যু দন্ডেদন্ডীত হবে, যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করে, তাহলে ওই ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডেদন্ডীত হবে ও এর অতিরিক্ত অর্থদন্ড হবে। ধর্ষণের চেষ্টা করলে ওই ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর ও সর্বনিম্ন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদন্ডেদন্ডীত হবে । এ ছাড়া অতিরিক্ত অর্থদন্ডে দন্ডিতদ হবে।
কিন্তু এদেশে ধর্ষণের পাকাপোক্ত আইন থাকলেও তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না কারণ যারা আইন প্রয়োগ করবেন তারাইতো মানবিক গুণাবলী ধারণ করেন না।অর্থের কাছে বিকিয়ে দেয় নিজেকে। অর্থাৎ সুষ্ঠু প্রয়োগ হচ্ছে না আইনের।
কেন হচ্ছে না ? এই প্রশ্নের জবাব যদি হয় মনিটরিং ব্যবস্থা দূর্বল তবে সেটাও কিন্তু একই পর্যায়ে পড়ে গেলো। অর্থাৎ এখানেও মানবিক গুণাবলী সম্বলিত মানুষের অভাব আছে।
তাই ধর্ষণ রোধে নারীকে পর্দানশীল হওয়ার পরামর্শ দেওয়ার আগে পুরুষকে তার কলুষিত মনকে ধুয়ে মুছে ছাপ করতে হবে। আর পর্দা যদি লাগাতেই হয় তবে পুরুষের চোখেই পর্দা লাগাতে হবে।ভাববেন না আমি বলেছি পর্দা থাকবে না। পর্দা বলতে শালীনতাকেই বুঝি আমি।
কিন্তু যখন একজন বোরকা পরা পরহেজগর মহিলাও ধর্ষিত হন কিংবা চীরদিন ঘরের কোণে থাকা মেয়েটাও ধর্ষণের শিকার হয় তখন কি দোষ পর্দার থাকে? নাকি পুরুষের ভোগ করার মানসিকতার? এই মানসিকতাকে ঢেকে রাখাকেই আমি পুরুষের চোখের পর্দা বা মনের পর্দা বলেছি। অর্থাৎ মানসিকতার পরিবর্তন এনে নারীর প্রতি সম্মান জাগ্রত করা।
যে সকল পুরুষ নারীকে মাতা/ভগ্নী কিংবা প্রেয়সী না ভেবে ভোগের সামগ্রী মনে করে ধর্ষণ কিন্তু তারাই ঘটায়।
প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। কিভাবে এই মানসিকতার পরিবর্তন সম্ভব?
>> ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলা।
>> পারিবারিক সুশিক্ষায় প্রদান।
>> সামাজিক সহনশীলতা এবং পারষ্পারিক শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি করা।
>> সন্তানদের সঠিক বন্ধু নির্বাচনে পিতা-মাতার ভূমিকা রাখা।
>> অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকা।
>> নারীকে ভোগের নয় মর্যাদার আসনে বসানো।
>> পাশাপাশি নারীকেও পোশাক নির্বাচনে সচেতন হওয়া।
আর এই সকল ইচ্ছাগুলোকে বাস্তবায়ন করতে হলে বড় বড় কথা না বলে, রাজনীতির মঞ্চ না কাঁপিয়ে কিংবা মানবাধিকার কমিশনের দিকে তাকিয়ে না থেকে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যার যার অবস্থান থেকে জাগ্রত হতে হবে।
সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সমাজের বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের সমন্বয়ে এই সকল উদ্যোগ বাস্তবায়নে অগ্রণি ভূমিকা পালন করতে হবে।
এতকিছু বাস্তবায়ন হলে আইনের দায়বদ্ধতাও কমে যাবে। মানুষ তখন একটা ধর্ষণ হলে আইন প্রণয়ন কারীকে বাধ্য করবে আইন বাস্তবায়ণ করতে। নচেৎ কোনদিনই আইন আইন করে চিল্লাপাল্লা করলেও লাভ হবেনা।