Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

নীল কাব্য

১০ বছর আগে লিখেছেন

আমি ভাল মানুষ, লোক দেখানো ভাল মানুষ

 

ঘটনা ঘটার জন্য কোন পুর্ব নির্ধারিত শিডিউল ঠিক করতে হয় না। ঘটনা ঘটে তার নিজস্ব গতিতে, আমরা শুধু ঘটনার সাক্ষী হয়ে পরে থাকি আজীবন। ছুটির দিন, সকাল বেলা, কি যেন একটা জরুরী কাজে ফার্মগেইট যাব, কাউন্টার সার্ভিস বা ডাইরেক্ট বাস বলতে যা বুঝায় সেই বাসের দেখা পাচ্ছিনা দির্ঘক্ষণ!! রোদে দাড়িয়ে থাকতে থাকতে চামড়া পুরে তামাটে বর্ণ ধারন করেছে অনেক আগেই, এখন ঘামে শরীরের সাথে শার্ট লেপ্টে আছে! ভাগ্যিস আমি পুরুষ! এই ভাবে একটা মেয়ে দাড়িয়ে থাকলে কতজনের দৃষ্টি দ্বারা যে ধর্ষনের শিকার হতো তা বলা মুস্কিল!। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থায় কোনমতে ঠেলেঠুলে "লোকাল বাস" নামক এই আজিব যন্ত্রটায় সাওয়ার হলাম!! লোকাল বাসে উঠতে অবশ্য হেব্বি মজা লাগে!! কোনমতে শরীরটাকে বাসের গেট পর্যন্ত নিলেই কেল্লা ফতে!! পেছনের লোকেরা নিজ উদ্দেগ্যে ঠেলা দিয়ে বাসের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়!!! যাই হোক!! মানবশ্রোত নামক আজব লিফটে চড়ে আপাতত বাসের ঠিক মাঝ বরাবর দাড়িয়ে আছি, বাসের ছাদের সাথে লটকানো জং ধরা স্টিলের একটা রড ধরে শরীরের ভাসসম্য ঠিক রাখার চেষ্টা করছি। গরম আর ঘাম এই দুইয়ের যন্ত্রনায় এতই অস্থির ছিলাম যে আমার ঠিক ডান পাশের জোরা সিটের একটিতে যে একজন সুদর্শনা তরুনী বসে আছে সেটা খেয়ালই করি নাই!! জিন্স প্যান্ট আর শার্ট পরিহিত আল্ট্রা মর্ডান ওই মেয়েটার ঠিক পাশেই কালো মতন একলোক! শ্রমিক শ্রেনীর হবে হয়তো!! শালার কপাল একখান!! জীবনে তো কম বাসে চড়লাম না এখন পর্যন্ত কোন সুন্দরীর পাশে বসার মধুর অভিজ্ঞতা হয় নাই কখনো!! আফসোস!! বিরাট আফসোস!!!

একজন মোটামতন লোকের ধাক্কায় সুন্দরী দেখার সুবর্ন সুযোগটা বাদ দিয়ে তার দিকে তাকালাম!! ভাই পিছে যান!! আদেশের সুরে বলল লোকটা!! ইচ্ছা ছিল কান বরাবর একটা লাগায়ে দেই!! কিন্তু শক্তিতে কুলোতে পারবোনা বিধায় চুপচাপ নিপাট ভদ্রলোকের মতন পিছনে সরে দাড়ালাম!! এখন ওই লোকটি নিস্পলক চোখে ওই সুন্দরীর দিকে তাকিয়ে আছেন!! তার দৃষ্টি নিক্ষেপের স্টাইলই বলে দেয় এই লোক জীবনেও মেয়ে মানুষ দেখে নাই!! কিছুটা রাগ, কিছুটা ক্ষোভ আর কিছুটা হতাশা নিয়ে একেবারে পেছনের সারির একটা খালি সিটে গিয়ে বসলাম!!! বাম পাশে বসা ছেলেটা তার দামী স্মার্ট ফোন দিয়ে ফেইসবুকে কিছু একটা করছে!! আমিও বা কম কিসের? নিজের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করেই আমিও ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিলাম "প্রাইভেট কারে করে ফার্মগেইট যাচ্ছি!! ওয়ান্না মিট এ নিউ ড্যুড!! হুয়াট য়্যু ডুয়িং?" বাহ!! শহরের কুখ্যাত ৮ নাম্বার বাসে বসে বসে প্রাইভেট কারের স্বাদ নিচ্ছি! আহ ফেইসবুক!! তুমি মোরে করেছো মিথ্যুক!!!

যাত্রাবাড়ীর জ্যাম সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নাই, সেই জ্যামে বসে বসে নানান কিসিমের ঘামের গন্ধ শুকছি!! শ্রমিকের ঘাম, মালিকের ঘাম, দুর্বলের ঘাম, সবলের ঘাম, সুন্দরী ললনা ও হাড্ডিসার নারীদেহের ঘাম!! নানান জাতের নানান বর্নের ঘামের গন্ধ!!! আশ্চর্য নিজ নিজ প্রয়োজনে আজ আমরা সবাই একই বাহনের সাওয়ারী!!! সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত!! নিজের প্রয়োজনে ধনীর দুলালের ঠিক পাশের সিটেই আমার মত দিন কামলাদের অবস্থান!! এ নিয়ে কারো মাথা ব্যাথা নেই!! অথচ প্রয়োজন শেষ হলেই অর্থাৎ এই বাস থেকে নামার পরেই আমরা কেউ কাউকে চিনবো না, এমনকি আমরা একে অপরের শত্রুতেও রুপান্তিরত হতে পারি!! এতে আবাক হবার কিছুই নেই!! স্বার্থ ইজ বিগ ফ্যক্টর ইন এ্যা হিউম্যান লাইফ!! এইটার সহিহ ইংলিশটা যেন কি? পাশে বসা ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করবো কিনা ভাবছি!! না থাক! শেষমেশ লজ্জিত হতে হবে আবার। লজ্জাটাকে আমরা ভীষণ ভয় পাই!! লজ্জা পাব বলে আমরা সর্বদাই মুর্খ রয়ে যাচ্ছি!! নতুন কিছু শিখতে যে ইচ্ছে করেই  কিছুটা বোকা সাজতে হয় সেটা মনে হয় আমরা ভুলে গেছি!! আমরা সবাই এখন চালাক!! আমরা সবাই জ্ঞানী!! মহা জ্ঞানী!!

কন্ট্রাকটর ভাড়া নিতে আসলো!! আমার গন্তব্যের জন্য নির্ধারিত ভাড়া ১৫টাকা!! পকেট থেকে এটা মলিন ২০ টাকার নোট এগিয়ে দিলাম! তার চেয়েও মলিন ও প্রায় মুমুর্ষ একটা পাচঁ টাকার নোট ফেরত পাওয়া মাত্র ওইটা পকেটে চালান করে দিলাম। পাশে বসা সেই ধনীর দুলাল অথবা আলাল পাচঁ টাকার একটি নোট এগিয়ে দিল কন্ট্রাকটর ছেলেটার দিকে, মামা কই যাইবেন? - ফার্মগেইট, ছেলেটার জবাব পেয়ে কন্ট্রাকটর "ভোদাই হয়া গেলাম" টাইপের চেহারা নিয়া তাকিয়ে আছে !! কিছুক্ষন পরে সে বলল
: মামা ভাড়া তো ১৫ট্যাকা
-স্টুডেন্ট হাফ ভাড়া জানস না??
: আপনে ১০ টেকা দেন, ৫ টেকা দিলে পোষায় না মামা
- ৫ টাকা দিছি, নিলে রাখ না রাখলে ফেরত দে, তর ভাড়া দিব না
: ভাড়া দিবেন না ক্যান?? বাসে কি মাগনা চড়বেন নাকি?
চটাশশশশশশশশশশ!!! কিভাবে কি হল বুঝলাম না ধনীর সেই দুলাল একটা চড় বসিয়ে দিল কন্ট্রাকটর ছেলেটার গালে! ছেলেটা আবার ভোদাই হয়ে গেল!!! ততক্ষনে আশেপাশের যাত্রীরা ছেলেটির পক্ষে বিপক্ষে নানা যুক্তি উপস্থাপন করতে শুরু করলো!! কন্ট্রাকটরের চেয়ে সেই ধনীর দুলালের পক্ষেই লোকজনের সাপোর্ট বেশী!! স্টুডেন্ট মানুষ (!) ভাড়া যা দিসে তা নিয়াই সন্তুষ্ট থাকতে হয়!! আমি বুঝলাম না ১৬/১৭ বছর বয়সী ওই কন্ট্রাকটর ছেলেটার দোষ কোথায়, কেন সে বিনা দোষে মার খেয়েও কোন বিচার পাচ্ছে না? ৮টাকা দিয়ে একটা বেনসন খেতে আমার এটুও গায়ে লাগে না, কিন্তু ১০টাকা বাস ভাড়া দিতে গেলে আমি এখনও স্টুডেন্ট হয়ে যাই। অবশেষে আমি মুখ খুললাম, "মামা যাও যা হবার হইসে, মন খারাপ কইরো না, কত লোকেই তো বিনা ভাড়ায় বাসে ওঠে, ব্যাপার না, যাও ভাড়া কাটো!!" প্রতুত্যুরে যা শুনলাম সেটা শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
"আমাগো পক্ষে তো কেউই কিছু কইবেন না, আমরা তো রাস্তার কুত্তার চেয়েও অধম!! যেই দিন থিকা এই গাড়ীর লাইনে কাম নিছি সেই দিন থিকা আমাগো নাম মানুষের কাতার থিকা উইঠা গেসে, এহন আমরা কুত্তা বিলাই"
চুপ করে ছেলেটার কথাগুলো শুনলাম, অত:পর আমি নিজেই ভোদাই হয়ে গেলাম............

জ্যাম কাটিয়ে এখন খালি রাস্তায় সাই সাই করে বাস ছুটে চলছে, আমার গন্তব্য এখনও অনেক পরে! এরই মধ্যে বাসে হইচই শুরু হয়ে গেছে!! নিজের সিট ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে দেখলাম, শার্ট-প্যান্ট পরিহিত সেই যুবতী কিংবা তার পাশে বসা শ্রমিক টাইপের সেই লোকটি বাসে নেই!!! আমাকে সরিয়ে দেয়া সেই মোটামত লোকটা বেশ হুংকার ছাড়ছেন!! তার প্যান্ট কেটে ২০ হাজার টাকা নিয়েগেছে পকেটমার!! সুন্দরী কে টোপ বানিয়ে লোকটির সম্পূর্ন মনোযোগ সেই মেয়েটার ওপরে ফেলে খুব সহজেই লোকটির পকেট কেটে নিজেরা কেটে পরেছে!! মনে মনে আমি বেশ খুশিই হয়েছি!! নরীদেরপ্রতি লোলুপ দৃষ্টি ফেলা এইসব লোকদের জন্য এইটা একটা উচিৎ শিক্ষা!! লোকটির হাহাকার শুনে পরক্ষনেই আমার সেই খুশি খুশি ভাবটা উবে গিয়ে মনের মধ্যে কেমন জানি একটা দু:খ দু:খ ভাব চলে এসেছে। এখন আমি দুনিয়ার দু:খী মানুষদের একজন, লোকটির দু:খে আমিও গভির ভাবে দু:খ প্রকাশ করছি!! ইচ্ছে করছে লোকটাকে পাশে বসিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে তাকে আমার এই দু:খ প্রকাশটা শোনাতে, দু:খ তো এখন বাংলালিংক দামে পাওয়া যায়, ক্ষতি কি চলতি পথে যদি তা একটু বিলিয়ে দিতে পারি!! দু:খ প্রকাশ করতে তো আজকাল টাকা পয়সা লাগে না...............

হাউকাউ শেষ হয়েছে অনেক আগেই, বাসটা এখন শাহাবাগে, এই সিগনাল টা পেরুলেই সোজা ডানদিকে মোড় নিয়ে চলে যাব আমি আমার গন্তব্যে, শরীরের ঘাম শুকিয়ে গেছে এখন শরীরটা অনেক ঠান্ডা!! প্রাকৃতিক শীতলীকরণ পদ্ধতিতে এখন আমি শীতলতা অনুভব করছি!! কিন্তু মনের মধ্যে কি যেন একটা ঘুচুর ঘুচুর করছে, কেমন জানি একটা খচরমচর ভাব :( কন্ট্রাকটর ভাড়া কেটে যাচ্ছে, আমার পাশের সেই ছেলেটা এখনও ফেইসবুকে স্ট্যাটাস আপডেট দিচ্ছে, সামনের দিকে কিছু লোক সমকালীন রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করছে, কেউ কেউ আমার মতই জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে!! কে কি দেখছে জানিনা, তবে আমি তাকিয়ে আছি শাহাবাগের ফুলের দোকানের সামনে একটা অর্ধ নগ্ন নারীর দিকে!! মানসিক ভারসম্যহীন ওই নারী পরে আছে কিছু উচ্ছিষ্ট ময়লার মাঝে, ফেলেদেয়া ওই আবজর্নার মতই মূলহীন সে, জিন্স প্যান্ট আর শার্ট পরে ঘর থেকে বের হলে বেগানা উপাধী দেয়া হয় কিন্তু অর্ধনগ্ন নারী দেহটা নিয়ে কারো মাথা ব্যাথা নাই। এখানে যৌনতা নেই, এখানে কারো লোলুপ দৃষ্টি নেই, এই দেহটাতে জৌলুস নেই, এটা পূর্ন নগ্ন থাকলেও আমাদের কিছু আসে যায় না। এখানে অশ্লীলতা নেই, তারপরেও ওই দেহটা কি যেন চিৎকার করে বলতে চাচ্ছে, অস্পষ্ট একটা কথা, আমি শুনতে পাচ্ছি না, আমি বধির হয়ে গেছি। ভয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলাম তার দিক থেকে, আমি অন্ধ!! হ্যা আমি অন্ধ!! আমি কিছু দেখিনি। ৩০০ টাকা দিয়ে সিনেমা দেখতে টিকেট কিনি, স্বল্পবসনা নারীদেহের খাজে খাজে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পুরো টাকাটাই উসুল করি কিন্তু অর্ধ নগ্ন ওই দেহটার দিকে ঘুরেও তাকাই না ১৫০ টাকা খরচ করে তাকে একটা মোটা কাপড় কিনে দেয়ার মত পর্যাপ্ত টাকা কখনোই আমাদের মানিব্যাগে থাকে না।

রাজসিক!! শহরের বুকে ধাতব ওই মুর্তিটা আমাদের অতীত ঐতিহ্য ধারণ করে দাড়িয়ে আছে!! আর আমাদের বর্তমানটা একটু আগেই পেছনে ফেলে আসলাম!! দুইটার মাঝে বিস্তর ফারাক!! ওসব ভাবতে ভাবতে বন্ধুর ফোন! রিসভ করলাম, অপর প্রান্ত থেকে বসুন্ধরা সিটিতে যাওয়ার জন্য বলা হল। ফুড কোর্টে আমার বন্ধুরা বসে আছে! আজকে কি যেন একটা উছিলায় এক বন্ধু একটা ট্রিট দিচ্ছে!! আমি ফাও পার্টি যাই খেয়ে আসি!! খুশিতে মনটা টগবগ টগবগ করতে থাকলো!! রাজসিকের ওই ঘোড়ার মতই!! কাওরান বাজার আসতেই নানান জনকে ঠেলেঠুলে বাস থেকে নামলাম!! কড়া রোদ আর ধুলোর রাজ্যে দাড়িয়ে তাকিয়ে আছি ওই সু উচ্চু ভবনটার দিকে!! একজন পঙ্গু লোক রাস্তার পাশে শুয়ে ভিক্ষা করছে!! বাসের কন্ট্রাকটরের দেয়া ওই মলিন পাচঁ টাকার নোটটা তাকে দিয়ে সামনের দিকে হাটা ধরলাম!! আমি আমার ব্যার্থতার প্রামাণ রাখতে চাইনা। আমার চোখ বন্ধ, আমি বধির!! আমার কথা বলা নিষেধ!! আমি মানুষ, লোক দেখানো ভাল মানুষ।

Likes ১০ Comments
০ Share

Comments (10)

  • - লুৎফুর রহমান পাশা

    হুমায়ুন আহমেদের জন্ম দিনের শুভেচ্ছা।

    - সনাতন পাঠক

    তিনি শায়িত ছিলেন গাঢ় কব্বরে
    যার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ বেঁধে দেয়া,
    গভীরতা নয়।
    কব্বরে শুয়ে তাঁর হাত কাঁপে পা কাঁপে
    গভীর বিস্ময়বোধ হয়।
    মনে জাগে নানা সংশয়।
    মৃত্যু তো এসে গেছে, শুয়ে আছে পাশে
    তবু কেন কাটে না এ বেহুদা সংশয়?

    শুভ জন্মদিন হুমায়ুন আহমেদ। 

     

    ধন্যবাদ আপনাকে।

    - ফেরদৌসী বেগম ( শিল্পী )

    প্রিয় লেখক এবং কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের ৬৫ তম জন্মদিনে আমার বিনম্র শুভেচ্ছা আর শ্রদ্ধাঞ্জলী।

    Load more comments...