খুব ইচ্ছে হয় তখন নিজের হাতে রাঁধেন। কিন্তু ছেলের সংসারে রান্নাঘরে দখল নিতে বড় অস্বস্তি হয় মুন্নুজানের। কি যে হাত নিশপিশ করে তার ছেলেটাকে নিজের হাতে করে খাওয়াতে! বৌমা বুদ্ধিমতি। রান্নাঘরটা এবেলা নয় ওবেলা ছেড়ে দেয়, মা আপনি করেন। মুন্নুজান তখন বেশ স্বাধীন স্বাধীন রাঁধেন। ডায়নিং টেবিলে ছেলের তৃপ্তির ঢেঁকুর ছেলে কাছে না থাকার অপ্রাপ্তি ঢেকে দেয়।
সাত-সতেরো ভাবতে ভাবতে মুন্নুজানের মাথায় সরল সংসারী বুদ্ধি খেলে যায়। লবণের বৈয়াম ধুয়ে নিলেই বেশ মাছ রান্নাটা হয়ে যায়। দুইজন মানুষের জন্য দুই পিস করে চারপিস। আজ রাত আর আগামীকাল দুপুরের জন্য। মুন্নুজানের স্বামী নাজিমুদ্দিন ডায়াবেটিসের রোগী হওয়ায় সকালে রুটি খান। রাতেও রুটি চলে। আজ আটা শেষের দিকে দেখে মুন্নুজান ভাত বসিয়েছেন। রান্না সমস্যার সমাধান করতে পেরে তার কাজে ছন্দ চলে আসে। মুন্নুজান মসলা কষিয়ে পাঙ্গাস মাছের টুকরোগুলো ছেড়ে দেন। মুন্নুজানের ছেলে সিফাত আব্বা পাঙ্গাস মাছ দুই চোখে দেখতে পারে না। ছেলে-বৌমা বেড়াতে এলে তাই তিনি ভুলেও এই মাছ আনান না। তার সিফাত আব্বা যে খাওয়া নিয়ে কত খুঁতখুঁতে! শিং, মাগুর, শোল, টেংরা এই প্রজাতির কোনো মাছই ছেলেটা মুখে পুরে না। খেসারির ডালের ঝাল ঝাল পিঁয়াজুর সাথে নিরামিষ হলে ছেলেটা খুব তৃপ্তি করে খায়। বেশি করে তেল পিঁয়াজ দিয়ে টাকি ভর্তা আর রান্না গরুর গোশত ভুনা! তিন বেলা দিলে তাতেই সই। সেইবার তো বৌমার সামনে বলেই ফেলল, মা...কতকাল পরে খেলাম গো এই কালি ভুনা! তোমার মত কারোটা হয় না। মুন্নুজানের মনটা কী যে আনন্দে ভরে উঠেছিল! পরক্ষণেই বৌমার চোরা চাহনিতে মুন্নুজানের বুক কেঁপে উঠেছিল, বোকা ছেলে বউয়ের সামনে কেউ ওভাবে বলে? সেইবার দুই দিনের জন্য এসেছিল সিফাত। যাওয়ার সময় মুন্নুজান দুই কেজি গরুর গোশত কষিয়ে টিফিন কেরিয়ারে দিয়ে দিয়েছেন। বৌমা একটু রাগ হচ্ছিল, কেন ঝামেলা করছেন মা, ব্যাগে থাকা কাপড়-চোপড় মাখবে...আমি করে দিব ঢাকায় ফিরে! মুন্নুজান তা শুনবেন কেন? একটাই ছেলে তার। ঢাকায় থেকে সব ফরমালিন দেওয়া খাবার খায়!
গোটা তিনেক নারিকেল, নারিকেলের বরফি, নিজেদের পুকুরের মাছ ভাজা, কষা মাংস, টাকি ভর্তা, কচুর শাক সেদ্ধ, মোয়া, নতুন গুড় এসব দিয়ে একটা বাজারের ব্যাগ বোঝাই করে ফেললেও ছেলে-বৌমা যাবার সময় মুন্নুজানের নিজেকে ঘুঁটেকুড়ুনি মনে হয়। বার বার চোখ ভিজে আসে, ছেলেটাকে কিছুই খাওয়াতে পারলেন না বলে। ব্যাগের ওজন দেখে বৌমা রাগ করে। তিনি চুপচাপ তার কাজ করে যান। সিফাতের বাসস্টপে যাওয়ার সি.এন.জি. না আসা পর্যন্ত আড়ালে আড়ালে তার ব্যাগ গুছানো চলতেই থাকে। বৌমার চোখ এড়িয়ে তিনি দিব্যি এই প্রতিযোগিতায় জিতে যান। এমনি মুন্নুজানের ছেলের বউ মিতু বেশ লক্ষ্মী মেয়ে। রাগটা শুধু উপরে উপরেই। ফিরে গিয়ে ফোন দেয়, মা আপনি যে কী! কোন ফাঁকে এইসব ঢুকিয়েছেন? আপনাকে নিয়ে পারি না। কেন এত কষ্ট করেন? শুনে মুন্নুজান হাসেন।
-এ্যাই শুনছো...এদিকে আস।
স্বামীর উৎকন্ঠিত ডাক শুনে মুন্নুজান দৌড়ে শোবার ঘরে ঢুকে যান।
-কী হল? শরীর খারাপ লাগছে?
-নাহ...বৌমা ফোন দিছে মাত্র, সিফাতের নাকি শরীরটা খারাপ। কোথায় নাকি দাওয়াতে গিয়েছিল দুপুরে। এসেই চার-পাঁচবার বমি করছে ছেলেটা।
-কী হইল আমার আব্বার? বেশি খারাপ শরীর? আমারে ডাকলেন না কেন কথা বলার সময়?
মুন্নুজান দুশ্চিন্তায় স্বামীর হাত থেকে মোবাইল নিয়ে নেন। কী অবুঝ লোক তো! তাকে একবার কথা বলার সময় ডাকলও না? মুন্নুজান ছেলের নাম্বারে বারকয়েক কল করার চেষ্টা করেন। ওপাশে কেউ ফোন ধরে না। নাজিমুদ্দিন তাকে শান্ত করার চেষ্টা করেন।
-আরে এত ভেবো না। বৌমা বলল, এখন ভালই আছে। ফোন দিও না। এখন ঘুমাচ্ছে।
-কী যে বলেন, আমি নিজের কানে শুনবো না ছেলের কথা! কী না কী খাইছে ছেলেটা! পেট গরম করল নাকি পেট খারাপ হইল? ছেলেটারে এখন জাউ খাওয়ান লাগবো। বৌমা বোঝেই নাকি!
নাজিমুদ্দিন স্ত্রীর উৎকন্ঠা দেখে হাসেন,
-আরে বৌমা তো আছে। নাকি? না তুমিই এখন জাউ রান্না করে পাঠাবা!
স্বামীর রসিকতায় কান দেন না মুন্নুজান। তার বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করছে। ছেলেটা উল্টোপাল্টা খেয়েছে বোধহয়। একটু জাউ আর কাঁচকলা ভর্তা খাওয়ানো দরকার রাতে। বেশি বমি করলে স্যালাইনও খাওয়ানো লাগে। কিন্তু তার সিফাত আব্বা তো স্যালাইনও খেতে পারে না। (চলবে)<
Comments (6)
ভালো লাগলো কবিতার কথামালা। শুভেচ্ছা জানবেন ভালো থাকবেন।
ধন্যবাদ
আহারে কে সেই নিষ্ঠুর নারী যে পুরুষের ভালবাসা বোঝে না ? শুভ কামনা রইলো ।
ধন্যবাদ পলি আপু