মরতে মরতে এর আগেও একবার বেঁচে গেছে রহিমুদ্দি। বছর দুয়েক আগে মুয়াজ্জিন ত মসজিদের মাইকে প্রফুল্লকন্ঠে শোক সংবাদ জানিয়ে রহিমুদ্দির জানাজায় হাজির হয়ে, রহিমুদ্দির বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করার জন্য গ্রামবাসীকে বিশেষভাবে অনুরোধও করে ফেলেছিল। পরে যখন খবর এলো রহিমুদ্দি নড়েচড়ে উঠেছেন তখন অবশ্য মুয়াজ্জিনকে আবার মাইকে আরেকটা বিশেষ ঘোষনা দিতে হয়েছিল অনেকটা হতাশকন্ঠে।
আজ সকালবেলা নেপচুন পাগলা এক্সরে ফিল্মকে চোঙ্গা বানিয়ে, সে চোঙ্গায় রহিমুদ্দির রুহ টিকটিক করার কথা গ্রামময় ঘোষনা করে এলে, কিছুটা দ্বিধান্বিতচিত্তে শেষদেখাটা দেখার জন্য রুহিতপুরবাসী রহিমুদ্দির বাড়িতে ভিড় করে। এই গনগনে চৈত্রে, নিথর নিস্তেজ রহিমুদ্দিকে, সৌদি থেকে তার বড়ছেলে সফিকুলের পাঠানো নরম কম্বলের নীচে একফাঁকে উঁকি দিয়ে আবার ফিরে যাচ্ছে লোকজন। দুই একজন বিশেষ করে পুরনো রুহিতপুরবাসী উঠোনে দাঁড়িয়ে, তলপেট থেকে তুলে আনা নিঃশ্বাস বিপুল আফসুসে ফেলে, রহিমুদ্দির নতুন দালানে দৃষ্টি আটকে রেখে বলেন- আহ আল্লা! এই শানশকত থুই বুঝি আইজ মাডির ঘর চলি যাইব। তারা এসব আলোচনা তুলতেও ভুলেনা, যে একসময় রহিমুদ্দির কি দুর্দশা ছিল। আসাফ মিয়াই স্মরণ করেন- এমনদিন আছিল, রহিমুদ্দি একবেলাও খাইত হাইত্যনা। আর আইজ?
কথাটা অবশ্য মিথ্যে নয়। বকলমি রহিমুদ্দি মানুষের ঘর তৈরী করলেও তার ছিল ভাঙ্গাঘর। রহিমুদ্দির পরিবার জয়নাব বেগমের ভাষায়- ছৈয়ালের ভাঙ্গাঘর। বছর পঞ্চাশের রহিমুদ্দি সুখের মুখ দেখেছেন বছর সাতেক ধরে। সৌদি পাঠানোর শর্তে তার বড়ছেলে সফিকুল যখন কালাম মুন্সির কুচকুচে কালো, নিন্দুকের ভাষায়- কুইচ্চাকালা মাইয়া হাছিনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল তখন থেকে। বড়ছেলের সৌদি গমনের পরের বছর ছোটছেলে কবিরুলও বিমানে ছেপে বসলে গ্রামবাসী হিংসায় পুড়লেও রহিমুদ্দির তখন ঘরেবাইরে সুখ। একদিন গ্রামবাসী অবাক হয়ে দেখলো রহিমুদ্দির ভাঙ্গাঘরে ইটের গাঁথুনি শুরু হয়েছে। তখনও গ্রামবাসী হিংসায় যতই বলেছিল- সব যৌতুকের টেয়ায়, রহিমুদ্দির তাতে সুখ কিছু কমেনি বৈ উপছে পড়ছিল।
দুপুর না নামতেই গ্রামবাসীকে দ্বিধামুক্ত করে, এবারও রহিমুদ্দি উঠে বসে। হঠাৎ মাথাঘুরে চেতন হারিয়ে ফেলার চিকিৎসা করাতে সৌদি থেকে দুইছেলের তাগিদ রহিমুদ্দি আগেরবারও আমলে নেয়নি। অযথা টাকা নষ্ট করার কোন ইচ্ছাই রহিমুদ্দির নাই বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছিল দুইছেলেকে। বরং বাপের অসুস্থতার খবরে ব্যাকুল দুইছেলের পাঠানো টাকায় চিকিৎসার পরিবর্তে চারকড়া জমি রেখেছে যুগীদের উত্তর পুকুকুরের পশ্চিম পাড়ে। ছেলেরা অসন্তুষ্ট হলে রহিমুদ্দি বলেছিলেন- হয়াত যে কদিন আছে হে কদিনই বাইচকুম, হুদাহুদি ডাক্তার কবিরাজ দেয়াই কোন লাভ নাই।
এবার অবশ্য রহিমুদ্দি অনেকটা নমনীয়। জয়নাব বেগমের কানের কাছে ফিসফিস করে বলেন- আঁই মনেঅয় বেশিদিন বাঁইচতান্ন। হোলাগরে খবর দেও, আঁরলাই ডাবেরলাইন বড় ইশটুবেরি হল হাঠাইত। হুইনছি আগামী হপ্তায় হেগুনের খালাত ভাই জব্বুইরগা দেশ আইব, হিগার কাছে দিত কইও। মরণের আগে এক্কানা ইশটুবেরি হল খাইতাম চাই।
জয়নাব বেগম জরুরী ফোনে ছেলেদের ইশটুবেরি হলের কথা বললেও ছেলেরা ঠিক বুঝতে পারলনা কি ফল খেতে চাইছে তাদের বাপ। অগত্যা বাপকে ফোনদিলে রহিমুদ্দি জানায়- আতলের মত দেখতে তবে লাল, ডাবেরলাইন বড়, ইহুদি নাসারার দেশর হল।
ছেলেরা অনুমান করে নেয়, আতাফলের মত দেখতে, লাল, মানে স্ট্রবেরী ফল। কিন্তু একদিন পর ছেলেরা ফোনে বাপকে যখন জানালো, যে জেদ্দার বড়বড় দোকান খুঁজেও ডাবের মত বড় ইশটুবেরি হল পাওয়া যায়নি তখন বিষন্ন হয়ে পড়েন রহিমুদ্দি। নিজেই ঢাকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি জয়নাব বেগমকে বলেন- টাকা থাকলে বাগেরচোকও হান যায়। আঁই ঢাকা যাইউম, ত ডাবের মত বড় ইশটুবেরি হল না খাই মইরতান্ন।
জয়নাব বেগম যখন বলেন- সোদিয়ারব হায় ন, আন্নে ঢাকা হাইবেন্নি? আর কবিরুল আঁরে কইছে ইশটুবেরি হল এতবড় অয়না, আন্নে কোনাই দেখছেন? আঁই ত জীবনেও এই হলের নাম হুনিন। তখন রহিমুদ্দি বলেন- ইশটুবেরি হল আঁই খাইন এটা হাছা কতা, কিন্তু ঘেরাণ হুঙছি, আর ডাবের মত বড় ইশটুবেরি হলও আঁই দেকছি। কোথায় দেখেছেন সেটা বললেন না।
একদিন পর সকাল সকাল ঢাকার যাবার জন্য তৈরী হন রহিমুদ্দি। রওনা দেয়ার আগে জয়নাব বেগম বলেন- আন্নে অসুইক্কা মানুষ, কোনাই মাতা ঘুরি হড়ি যান ঠিক আছেনি। শুনে রহিমুদ্দি বলেন- আঁর মরন হত লেয়া থাকলে হতই মইরগুম, ত আঁই ঢাকা যাইউমই। আরো বলেন- আঁর বাপ মরনের সময় আঙ্গুরের রস খাইত চাইছিল। আঁর হকেট এক টেয়াও আছিলনা। আঁই করিম বাচার কাছের রসিঘরের ভিডা বেইচকুম কই এক হাজার টেয়া বানা লই চমুনী গেছি আঙ্গুর আইনতাম। আই দেই আঁর বাপ মরি গেছে। তুঁই ত দেখছ। কী দেওননি? তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করে বলেন- হেয়ার একবছর হর আঁর মা মরনের সময় আঁরে কানেকানে কইছে বেদানা খাইব, আঁই খাবাইতাম হারিন। হে দুঃক্ক আঁর অন্তাই যায়ন। বলেই আকুল হয়ে কাঁদতে শুরু করেন রহিমুদ্দি। জয়নাব বেগমের শান্তনায় স্থিত হয়ে রহিমুদ্দি বলেন- আঁই ডাবেরলাইন ইশটুবেরি হল না খাই মইরতান্ন, এই আঁর শেষ কথা।
স্ট্রবেরী, রহিমুদ্দির জবানে ডাবের মত বড় ইশটুবেরি হল খাবার সখ তার অনেক পুরনো। এবার সখটা যখন তার শেষ ইচ্ছা মনে হচ্ছে তখন ঢাকা যাওয়া ছাড়া তার কাছে কোনও উপায়ও রইলনা।
রহিমুদ্দির মাথায় স্ট্রবেরী ফলের পোকা ঢুকেছে অদ্ভুত ভাবে।বছর কয়েক আগে একদিন সকালবেলা সাধন ডাক্তারের কাছে আগেরদিন কেনা কনডমের প্যাকেট নিয়ে হাজির হয়ে রহিমুদ্দি বলেছিলেন- এটাত কিয়ের ঘেরাণ? সাধন ডাক্তার কিছুক্ষণ চশমার উপরদিয়ে তাকিয়ে থেকে বলেছিলেন- এটা স্ট্রবেরী ফলের ঘেরাণ। ফিরে আসার সময় রহিমুদ্দি ভেবেছিল- যে হলের ঘেরাণ এত সুন্দর হে হল জানি খাইতে কত হোয়াদ অইব।
তারপর থেকে প্রায় রাতে অস্থির জয়নাব বেগমকে অস্বস্তিকর অপেক্ষায় রেখে, গুটগুটে অন্ধকারে রহিমুদ্দি নাকের কাছে কনডম নিয়ে ঘ্রাণ শুকতেন। জয়নাব বেগম যখন বিরক্ত হয়ে বলত- কই আন্নে আইয়েন নাকা? তখন হুশ ফিরত রহিমুদ্দির। বড় অনিচ্ছায় নাক থেকে সরিয়ে এনে জয়নাব বেগমের তিরতিরে বিরক্তি লাগব করতেন। এভাবে দিনে দিনে স্ট্রবেরী ফলের প্রতি তার তীব্র আকাংখা জম্মায়। সবার আড়ালে সে আকাংখা যে তলেতলে এতটা গভীর হয়ে উঠেছে, কেউ টের পায়নি।
ঢাকায় পৌছে চাচাত ভাই জমিরের কাছে যায় রহিমুদ্দি। বড় সেয়ান মাল জমির, এটা জানে রহিমুদ্দি। ফুটপাত থেকে কেমনে কেমনে কিচেন মার্কেটে তিনটা আস্ত দোকানের মালিক বনে যাওয়া জমিরই যে তার জন্য কিছু করতে পারবে এ বিশ্বাস আছে রহিমুদ্দির। দু'জন মিলে পুরো কাওরান বাজার ঘুরেও যখন ডাবের মত বড় স্ট্রবেরী ফল পায়নি তখন রহিমুদ্দি আশাহত হয়ে পড়েন। তার ধারনা জম্মায়- এইদেশে সব চোর। সে জমিরকে বলছেও- হমন্দির হুতেরা ছোড ছোড ইশটুবেরি হল আনে হস্তায়, বেশি দামে বেচনের লাই। জমির তাকে বুঝাতে চাইলে উত্তেজিত হয়ে বলেছিল- তুইও দোয়ানদার, তুইও চোর, আঁই একলা খুঁজি বার কইরগুম বলে বেরিয়ে পড়েন।
কিন্তু ডাবের মত স্ট্রবেরী কোথাও পাওয়া যায়না। সদরঘাটে এক দোকানি ত বলেই ফেলল- হালা ত বহুত পাগল, কয় ডাবের লাহান স্ট্রবেরী। তিরস্কার করে রহিমুদ্দিকে দোকানি বলে- ঐ বেটা তোরে ছাড়ছে কোন হালায়।
অগত্যা রহিমুদ্দি পান্জাবির পকেট থেকে কনডমের প্যাকেটটা বের করেন। খানিক সময় দেখেন, প্যাকেটের গায়ে এক ললনা নগ্নবক্ষে ডাবের মত বড় স্ট্রবেরী চেপে ধরে আছে। দোকানির চোখের সামনে নিয়ে ছবিটা দেখিয়ে রহিমুদ্দি উত্তেজিত হয়ে বলেন- এই চাও মেয়া ডাবেরলাইন বড় ইশটুবেরি হল, দেকছনি হু দেকছনি এবার, বেঠিগার বড় বড় বুক দুগা হইর্যন্ত ডাকি হালাইছে এত বড় ইশটুবেরি হল, আর তোঁরা কও এত বড় ইশটুবেরি হল নাই, আঁরে কি হাগল হাইছনি। দোকানির চোখ বেরিয়ে পড়ার উপক্রম হলে চলে আসে রহিমুদ্দি।
তীব্র হতাশায়, রহিমুদ্দি এলোমেলো হাঁটতে থাকে সায়েদাবাদ টার্মিনালের দিকে। টার্মিনালের কাছাকাছি এলে রহিমুদ্দি মাথা ঘুরে পড়ে যায় পথের উপর। মূহর্তে তাকে ঘিরে ফেলে মানুষের বৃত্ত। নিস্তেজ রহিমুদ্দিকে দেখে তারা বুঝতে পারেনা লোকটা মরে গেছে না বেঁচে আছে। দু'দিকে আটকা গাড়ীর চালক আর যাত্রীরা গালাগাল দেয়- হালার হিরুঞ্চি আর মরনের জাগা পাইলনা।