Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

মাহাফুজুর রহমান কনক

১০ বছর আগে লিখেছেন

গল্প: অবনী

 

 আমি মরে যেতে চাই! এত অবলীলায়  অবনী  কথাটা বললো, মনে হলো মৃত্যুর মত সহজ গন্তব্য জগতে আর কিছু নেই। ইচ্ছে হলেই বাইরে যাচ্ছি বলার মত করে বলে দেয়া যায় আমি মরতে যাচ্ছি। ফোনের এপাশে বসে আমি স্তম্ভিত হয়ে বসে আছি। কান পেতে আছি, ওপাশে কোন সাড়াশব্দ নেই, মনেহচ্ছে ওপাশে কবরের নীরবতা। যদিও কবরে যাবার কোন সুযোগ আমার হয়নি, তবু অনুমান করছি- অবনীর রুমটা এখন একটা স্যাতস্যাতে অন্ধকার কবর বৈ আর কিছু নয়। আর কিছু না বলে অবনী লাইনটা কেটে দিয়ে  ফোনের সুইচ অফ করে দিলে, মনেহলো আসলে আমিই কবরের মধ্যে বসে আছি। আমার জানলা দিয়ে যে আলো আসছে ওটা আসলে অন্ধকারের স্রোত, এতক্ষণ ভুলকরে আমি আলো ভেবেছিলাম। খানিক আগে বারান্দায় সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে রাস্তায় যে গাড়ীর স্রোত দেখেছিলাম, ওগুলো আসলে কবরের কীট। যে ইটের দেয়ালগুলো ঘিরে আছে আমাকে, আসলে ওগুলো মাটির দেয়াল। ক্ষণিক আগের দরজা, জানলা, ফাঁকফোকর আচমকা ক্ষণিক বিভ্রম মনেহতে লাগলো, মনেহলো অন্ধকার কবরে বসে আছি সহস্র বছর ধরে।  

আমার বেরুনো দরকার। মনিপুরিপাড়ায় অবনীর চাচার বাসায় পৌছতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, অবনী সেখানেই থাকে। অথচ আমি অসাঢ় হয়ে বসে আছি, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। চারপাশের মাটির দেয়ালগুলো আমার দিকে এগিয়ে আসছে, মনে হতে লাগলো কিছুক্ষণের মধ্যে ওগুলো আমাকে পিষ্ট করে ফেলবে। আমি দৌড়ে বেরিয়ে এসে বাইকটা স্টার্ট করি। অফিস সময় শুরু হয়েছে প্রায় দুই ঘন্টা আগে ,তবু রাস্তাজুড়ে প্রচুর ট্রাফিক। আমাকে একবার ফুটপাতে আবার রাস্তায় নামতে হচ্ছে। মনেহচ্ছে ইস্কাটন থেকে এতটুকু পথ যেন পৃথিবীর দীর্ঘতম পথ, কখনোই শেষ হবার নয়। অথচ, অবনীকে বিশ্বাস নেই। হুট করে কিছু একটা করে ফেলতে পারে।

গতকালও অবনীর সাথে দেখা হয়েছিল, বিকেলে যখন সে আমাকে ফোন দেয়।  প্রায়ই যেমন উদ্ভট এলোমেলো কথা বলে, সেরকমই বললো- পিকলু তোদের চ্যানেলে আমাকে নিয়ে কি সব আজেবাজে বলছে। আমি বিকেলের সিফটেই ছিলাম, “নজরুলের যতগান” নামে একটা নিরীহ অনুষ্ঠান যাচ্ছিল তখন। আমি বসকে বুঝিয়ে দ্রুত অবনীর চাচার বাসায় গিয়ে হাজির হই। তাকে সাথে নিয়ে ফিরে এসে বারিস্তায়, কফিতে চুমুক দিতে দিতে  কথা বলতে বলতে মনেহচ্ছিলো ও কোথাও তাকাচ্ছেনা। ডাগর চোখজোড়া চারপাশে উদভ্রান্ত ঘুরাঘুরি করলেও দৃষ্টি যেন তার চোখের ভিতর আটকে আছে। অবনীর, চোখের নীচে কালোদাগ আরো বিস্তৃত হয়েছে। মাথার চুল অযত্নে এলোমেলো হয়ে আছে। ত্বকের লাবণ্যতা কমে শুকনো পাতার মত খসখসে হয়ে আছে, যেনো হাতে নিয়ে চাপ দিলেই কুড়মুড় শব্দে ভেঙ্গে যাবে। এসব নিয়ে ওকে প্রশ্ন করার কোন কারন ছিলনা। ওর ভিতর বাহীর আমার চেয়ে বেশী ত কেউ জানেনা। তবু অবনী মরে যেতে চাইবে? এ বিশ্বাস হচ্ছেনা।


অবনীর সমস্যাটার শুরু তিন বছর আগে। যেদিন অবনীর বাবা সলীম মাষ্টারের, সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে হলো মেয়েকে দেখতে যাবেন। প্রত্যহ বেশকয়েকবার ফোনে কথা বলেও একমাত্র মেয়ে যাকে তিনি বলতেন- মেয়ে আমার সাত রাজারধন, তাকে বেশীদিন না দেখে তিনি থাকতে পারতেন না। মেয়েকে সারপ্রাইজ দিবেন বলে আগে কিছু না জানিয়ে তিনি দুপুরে গ্রাম থেকে রওনা দিয়ে কাঁপানো শীতের সন্ধ্যায় এসে দাঁড়ান অবনীর হোষ্টেলের সামনে। অবনী বাবার ফোন ধরে বলেছিলো- বাবা আমি ত হোষ্টেলে। এবং শেষ পর্যন্ত যখন অবনী এলোনা এবং সলীম চাচা জানলেন তার মেয়ে একমাস ধরেই হোষ্টেলে না থেকে প্রেমিকের সাথে, একসাথে থাকছে অন্যকোথাও এবং এখন অবনী কক্সবাজার গেছে সেই ছেলেটির সাথে। তখন কতটা কষ্ট পেয়ে সলীম চাচা ফিরে গিয়েছিলেন আমি অনুমান করতে পারিনা। তবে তিনি গ্রামে ফিরেছিলেন মৃত, সে রাতেই ওয়াসার বড় অফিসার বড় ভাই কলীম সাহেবের বাসায় তিনি মারা গিয়েছিলেন। অবনী তখন বাবাকে দেখতে যাবার সাহস রাখেনি, যখন তার ছোট দুই চাচা বলেছিলো এ মেয়েকে তারা জীবিত রাখবেনা, এই মেয়ে তাদের ভাইকে হত্যা করেছে এবং তারা কখনো তাকে ক্ষমা করবেনা। রাফিনও দেশ ছেড়েছে দেড় বছর আগে। অবনীই চায়নি রাফিনের সাথে আর কোন সম্পর্ক থাকুক, যে সম্পর্ক আত্মীয়- অনাত্মীয় সকলের কাছে খুনি করে তুলেছে। এবং আশ্চর্য্য হলো অবনীর মাও যখন শোক সামলাতে না পেরে গেল বছর শেষের দিকে মরে গেল তখন অবনীর আর পৃথিবীতে কেউ রইলনা।

বাবার মৃত্যুর পর শুরু হলেও মা'র মৃত্যুর পর অবনীর একলা যাপন ও মনোবৈকল্যে জটিল হতে থাকে। কিন্তু অবনী এইসময়ে এসে মরে যেতে চাইবে? এমন কখনো মনে হয়নি আমার। বরং সে চেষ্টা করছিলো ঘুরে দাঁড়াতে। ডাক্তারের কাছেও নিয়মিত হয়েছে কয়েকদিন থেকে। বড় চাচাও পাশে এশে দাঁড়ান অবনীর, ভাতিজী'কে হোষ্টেল ছাড়িয়ে নিজের বাসায় নিয়ে আসেন কলীম সাহেব।

আজ কি হলো অবনীর? কারনটা কী আমি? অনেকটা অধিকার নিয়েই গতকাল বারিস্তায়, অবনীকে বলেছিলাম- আমার জন্য হলেও ফিরে আয়। অবনী, ক্ষণিক চুপচাপ থেকে বলেছিল- কেন? সে স্কুলের কলার উঁচানো বয়স থেকে কলেজ পেরিয়ে ভার্সিটি ডিঙ্গিয়ে সহস্র দিবস রজনী অপেক্ষার পর অবশেষে বলেই ফেললাম- আমি তোকে ভালোবাসি। অবনীর দৃষ্টি চোখের আরো ভিতরে ঢুকে গিয়েছিল। মনেহলো অন্ত:মুখী দৃষ্টিতে বাইরের জগতের কোন কিছুই কোনকালে তার চোখে পড়বেনা। নিঃশব্দে উঠে গিয়েছিল অবনী। আমি বসে থেকেছিলাম এক অন্ত:মুখী দৃষ্টিতে পথ হারাতে হারাতে।

সোনারগাঁও সিগন্যালে এসে গাড়ীগুলো জটলা পাকিয়ে ফেলেছে। আমি কিছুতেই বেরুতে পারছিনা, অথচ আমাকে দ্রুত পৌছাতে হবে। অবনীর ফোন এখনো বন্ধ। বসন্তের এই সকালটা মনেহচ্ছে কখনো শেষ হবার নয়। আমি অস্থির হয়ে একটা ফাঁক গলে বেরিয়ে এলাম। আর কয়েকটা মিনিট। হে দয়াল তুমি অবনীকে, অন্তত আমি পৌছানো পর্যন্ত থাকতে দাও। আমি অবনীর হাত ধরার সুযোগ ফেলে আর কোন শক্তি নেই ওকে পৃথিবী থেকে নিয়ে যায়।


আমি আর অবনী পাশাপাশি বড় হয়েছি। স্কুল, কলেজ একসাথে পার হয়েছি। ভার্সিটিতে এসে ও চলে গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর আমি জাহাঙ্গীরনগরে। তারপরও আমরা একসাথ হয়েছি নানান জায়গায় নানান অজুহাতে। ওর প্রেম, লিভটুগেদার, কক্সবাজার যাওয়া সবই আমাকে জানাত অবনী, শুধুই আমাকে। এই শহরে অবনি কী করে খোঁজ নেবার তেমন কেউ ছিলনা। ওর বড়চাচাও অতটা কেয়ার নিতেন না অথবা সময় পেতেন না। আমি কী বাধা দিয়েছিলাম কখনো অবনীকে? না মনে পড়েনা। অবনীই বা কী ভেবেছিল তখন? কখনো জানতে চাওয়া হয়নি। ও যেভাবে বেঁচে, বড় মায়া হয় ওর জন্য। নিজের সাথে কত বোঝাপোড়া হচ্ছে ওর প্রতিনিয়ত। তবু অবনী বেঁচে আছে। আমার কাছে, পৃথিবীর বুকে এরচেয়ে সুন্দর আর ত কিছু নেই।  

সে অবনী মরে যাবে? আমার অবনী? একা, আমাকে ছাড়া। এতটা স্বার্থপর অবনী হতে পারে? সোমেশ্বরি নদীর পশ্চিপ পাড়ের অবনী? কুমুদিনী হাজং'র প্রতেবেশী অবনী? টং আন্দোলনের যোদ্ধা যিনি তিন ভাই এবং স্বামিকে নিয়ে মণিসিংয়ের ডাকে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েলেন, সে কুমুদিনী হাজং এর ভক্ত অবনী মরে যাবে? যে বলতো, আমি কুমুদুনীর মত সাহসিনী, বিজয়িনী হব। সে অবনী হেরে যাবে? ওকে নিয়ে ওর বাবার স্বপ্ন, বড় অধ্যাপক হবেনা অবনী?

আমি কিছুতেই তা হতে দিতে পারিনা। সোমেশ্বরির বুকে, আমাদের ঢিলে উঠা মৃদু ঢেউ এখনো মিলিয়ে যায়নি। এখনো কান খাড়া করে আছি- অবনী এসে বলবে, পিকলু তাড়াতাড়ি আয়ে ওরা খেলার জন্য জোড়া করছে, পরে গেলে আমরা জোড়া হয়ে যাব। আমি মা'র লালচোখ উপেক্ষা করে ছুটে যাব, জোড়া হলেই আলাদা হয়ে দুইজন দুই দলে পড়ে যাব এই ভয়ে। পিঠে বেণী দুলিয়ে এইমাত্র চলে গেছে অবনী, এখনো তার মাড়িয়ে যাওয়া ঘাস মাথা তোলেনি, আর অবনী মরে যাবে? রাত একটু বাড়লেই অবনী ফোন দিবে। বলবে- আমার বড় একা লাগছে, একটু আমার সাথে থাক। আমাকে লাইনে রেখে, টেবিলে অথবা বিছানায় ফোনটা ফেলে ও ভাবে আমি তার সাথে আছি। আমি ফোন কানে ধরে অজস্র কথা বলে যাব, নিঃশব্দে। ও ভরসা পাবে। ফোনটা কানে নিয়ে হঠাৎ দুই একটা এমন কথা অবশ্য বলে- মাঝে মাঝে রাত গভীর হলে নাকি মা- বাবা দু'জনই এসে ওর জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে, ওকে ডাকে। ওর বাবা নাকি বলে- কইরে আমার সাত রাজারধন! বাবা- মা'র মৃত্যুর দায় কাঁদে নিয়ে ও নিজেকে নিজের কাছে অপরাধী করে রেখেছে। আমি ত জানি, কী নিদারুন কষ্টের দিন কাটাচ্ছে অবনী। আমি কিছু করতে পারিনা, ও কারো কথা শুনেনা এখন। আমি শুধু তার ডাকের অপেক্ষায় থাকি। অবনী ফোন করে বলবে- একটু আসবি? একটু বেরুতে ইচ্ছে করছে। আমি এমন সহস্র সহস্র ডাকের অপেক্ষায় থাকব আর এমন লক্ষ কোটি ঘন্টা অবনীর ফোন ধরে থাকব। আর অবনী বলছে- আমি মরে যেতে চাই!


অবনীর বড় চাচার বাসায় এসে দারোয়ানের কাছে শুনি, অবনীকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অনেকগুলো ঘুমের ঔষধ একসাথে খেয়েছে অবনী। অবনীর মোবাইল নাম্বার ছাড়া আর কারো নাম্বার নেই আমার কাছে। দারোয়ানের কাছ থেকে ড্রাইভার আকিদুলের নাম্বার নিয়ে ফোন দিয়ে হাসপাতালর নাম জানলাম। আমি মোটরসাইকেলের গতি বাড়ালাম। যে করেই হোক অবনীর কাছে আমাকে পৌছতে হবে। ভাবতে লাগলাম, গতকাল আমার বলা কথাগুলোই অবনীকে আরো চাপে ফেলে দিয়েছে হয়ত। ও হয়ত এধরনের কোন সম্পর্কেই আর জড়াতে চায়না। অবনীর কিছু হয়ে গেলে আমি নিজের কাছে অপরাধী ত হবই, ও ছাড়া আমার জগৎ অর্থহীনও হয়ে পড়বে। আমি নিজেকে ধীক্কার দিতে লাগলাম। সে কৈশর থেকে এতগুলো বছর গভীর গোপন কথাটা কেন হঠাৎ বলে ফেললাম। কতদিনই ত গেছে বলবো বলবো করে। কতদিন ওর চোখে চোখ রাখার অযুহাত খুঁজতে খুঁজতে ভেবেছি- চোখ আসলে মনের কথা বলেনা। যদি বলত, তাহলে যেদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে, ঘোর বৃষ্টিতে ভ্যানে মুখোমুখি বসেছিলাম, সেদিনই অবনী বুঝত আমার মনের মাঝে ও ছাড়া আর কিছু নেই। অবনী সেদিন বোঝেনি। ঠা ঠা পূর্ণিমায় নানান ছুতোয় এসে উপস্থিত হতাম ওদের ঘরে। রাজ্যের মিথ্যে বলে ওর বাবার বাধা পেরিয়ে ওর মুখোমুখি হতাম। তারপর খানিক সময় আড়চোখে পৃথিবীর সুন্দরতম মুখখানা বার কয়েক দেখে টেবিল থেকে একটা বই হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসতাম। ও তাকিয়ে থাকত, আমার এসব আচরন ওর কোন কৌতুহলই তৈরী করত না। একদিনও সে জানতে চায়নি আমার এসব পাগলামীর কী কারন? ওসবে আমার কিছু অবশ্য যেত আসতনা, আমি শুধু চেয়েছি যতটা সম্ভব ওর কাছাকাছি থাকতে। ওর চিকন বেণী যখন সাপের মত দোলে, আমি চেয়েছি ওর পিছু পিছু থেকে দু'চোখ ভরে দেখতে। বর্ষায় সোমেশ্বরি উপরে উঠে এলে, জলকাদায় পথ একাকার হয়ে গেলে, পড়ে যাবার ভয়ে ও আমার হাত ধরে হাঁটত। আমি চেয়েছি বারো মাস বর্ষা থাকুক। ও ঢাকা এলে, অন্তত অবনীর কাছাকাছি থাকব এই লোভে, বাবার সমর্থ নেই জেনেও জেদ ধরেছিলাম ঢাকায় পড়বো। তারপরও কী থেকে কী হয়ে গেল।

অবনীর জীবনে এমন সব ঘটনা ঘটল যে আমি এখন নিজেকেও অপরাধী ভাবছি। যদি সেদিন ভ্যানে বলতাম- অবনী, আমার হাতটা ধরবি? অথবা সে কালবৈশাখীর দিন? যেদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে ঝড় থেকে বাঁচতে আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম কাজীদের মোক্তবে, যদি সেদিন বলতাম- তুই ছাড়া আমি অর্থহীন। তবে আজ, এই যে অবনীর এই দুঃসময় হয়ত ওকে ঘিরে রাখতনা। আমি কেন বলতে পারলাম না? ওসব কথা ভেবে অবনীর এই অসহনীয় জীবনের জন্য আমার নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে। আমার ইচ্ছে করছে বাবাকে গিয়ে বলি- বাবা, তুমি কেন মাঝি হতে গেলে? মাকে বলি- মা তুমি কেন মাষ্টারদের বাড়ীতে ধান শুকাতে যেতে? এইসব অর্থহীন প্রশ্ন আমার ভিতর ঝড় তুললেও আমি ত জানি, আমার মা- বাবার মত মহৎ পিতা- মাতা এই জগতে নেই। দিনের পর দিন যারা না খেয়ে আধপেটে খেয়ে আমাকে খাইয়েছে। নিজেরা ছেঁড়া কাপড় পরে আমাকে ভালো কাপড় পরতে দিয়েছে। নিজেদের নিংড়ে দিয়ে আমার ভবিষ্যত গড়ে দিয়েছে। অবনীর জন্য মাঝে মাঝে অন্যায় ক্ষোভ জম্মে মা- বাবার প্রতি, যারা আমার বাড়ী ফেরার দিন এখনো ছোট নৌকাটা নিয়ে এসে বসে থাকে নদীর পাড়ে। তবু অবনী মরে যাবে? এই জগৎ থেকে কী লাভ তাহলে?


হাসপাতালের এক কোনে বসে আছে কলীম চাচা। আমাকে দেখে তিনি এগিয়ে এলেন। তার চোখে অশ্রুর শ্রোত। পাশে দাঁড়ানো অবনীর চাচীও কাঁদছেন। আমি শুধু জানতে চাইলাম অবনী কোথায়? কলীম চাচা একটা বন্ধ কাঁচের দরজার দিকে হাত বাড়িয়ে দেখিয়ে দিলেন। আমি এগিয়ে যেতে কলীম চাচা আমার কাঁদে হাত রাখেন। পাকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ আমার হাতে দেন। কাগজের উপর লেখা- পিকলু। আমি কাগজটা পকেটে রেখে দেই, আমি অবনীর সুসাইড নোট পড়তে আসিনি। জীবিত অবনীর মুখের কথা শুনতে এসেছি। ওর হাতটা ধরতে এসেছি।

আমি ছুটে যাই বন্ধ দরজার দিকে। হাসপাতালের লোকজন আমাকে আটকে দেয় দরজায়। আমি উঁকি দেই, পর্দা দিয়ে বেডগুলো আড়াল করা। আমার অনুনয়েও আমাকে ভিতরে যেতে দিলনা, বললো- ওর স্টোমাক ওয়াশ করা হচ্ছ, তবে ও অচেতন, আল্লাকে ডাকেন।

আমি আল্লাকে ডাকি। আমাকে ডাকে চিকন স্রোত বুকে নিয়ে বয়ে চলা সোমেশ্বরি নদী। যার পাড়ে পাড়ে আমরা হেঁটেছি পায়ে পায়ে। সে সব পদচিহ্ন আমাদের অপেক্ষায় আছে। অবনীকে নিয়ে ফিরে যাব এইসব সভ্যতা রেখে, অসাধারন সোমেশ্বরের তীরের অসাধারন মানুষদের মাঝে। যেখানে অবনী সোমেশ্বরির মত শান্ত, বিশ্বস্ত। শুধু অবনী এসে আমার হাতটা ধরলেই আমরা বেরিয়ে পড়বো। মা- বাবা ছোট নৌকা নিয়ে বসে থাকবে আমাদের জন্য।

Likes ১১ Comments
০ Share

Comments (11)

  • - মাসুম বাদল

    দারুণ...

    • - মোকসেদুল ইসলাম

      ধন্যবাদ

    - চারু মান্নান

    কবিকে আমার মহান একুশের শুভেচ্ছা,,,,,

    • - মোকসেদুল ইসলাম

      ধন্যবাদ কবি

    - আহমেদ রব্বানী

    আমি হাঁটি
    আমার পিছে হাঁটে সমস্ত বাংলাদেশ.......

     

    চমৎকার উচ্চারণ প্রিয়।

    • - মোকসেদুল ইসলাম

      ধন্যবাদ রব্বানী ভাই

    Load more comments...